কাল্পনিক না কি ভৌতিক??
কাল্পনিক না কি ভৌতিক??
কাল্পনিক না কি ভৌতিক, একটি ছোট্ট ভূতের গল্প
---
**আমার নাম পলাশ, আমি মধুডাঙ্গা নামে একটি ছোট্ট গ্রামে সরকারী চাকরি করতাম।
আমার বাড়ি বেলেপুকুর, বেলেপুকুর থেকে মধুডাঙ্গা ট্রেনে করে যেতে এক ঘন্টা সময় লাগে, সকালে সাত টায় ট্রেন ধরি আর আট টার সময় পৌঁছে যাই। ফেরার সময় সন্ধ্যে সারে ছোটা ট্রেন ধরে সারে সাতটায় বেলেপুকুর পৌঁছে যাই। বেশি ট্রেনের যাতায়াত নেই, হাতে গোনা দুটো-চারটে ট্রেন আছে। তাই আমি রোজ এই ভাবেই যাতায়াত করতাম। আমি দুটো বছর ওই অফিসে কাজ করেছি, কোনোদিনই এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু এক দিনের এক ঘটনা আমার সারাজীবন মনে থাকবে।
আজ সেই ঘটনা আপনাদের বলবো, আপনারা শুনে হয়তো বলবেন বানানো ঘটনা, বা কাল্পনিক ঘটনা।
আপনাদের আর দোষ কি? আমার নিজের যখন এই ঘটনা মনে পড়ে তখন আমি নিজেই বুঝতে পারি না কল্পনা নাকি ভৌতিক, কিন্তু সেই রাতে আমার যে অনুভূতি হয়েছিল তা তো কল্পনা হতে পারে না!
আপনারাই শুনে ঠিক করুন, কল্পনা নাকি সত্যি ভৌতিক? তাহলে শুরু করা যাক।
আমি আগেই বলেছি, আমার বাড়ি থেকে অফিস যেতে ১ ঘন্টা লাগতো, সকালের ট্রেনে বেরিয়ে বিকালের ট্রেনে বাড়ি ফিরতাম। শনিবার আর রবিবার ছুটি থাকতো। তেমনই এক শুক্রবারে রতন বললো, "দাদা, আজ একটা ছোটখাটো পিকনিক হোক, কাল তো শনিবার ছুটি, কোনো চাপ নেই।"
রতন হলো আমাদের অফিসের কেয়ারটেকার, খুব ভালো ছেলে। আমি বললাম, "ঠিক আছে, কিন্তু জোস্টি দা?"
জোস্টি দা হলেন আমাদের অফিসের সিনিয়ার অফিসার, আমার থেকে বয়সে বড়, কিন্তু উনি আমাকে 'স্যার' না বলে 'দাদা' বলে ডাকার জন্য বলেছিলেন।
রতন বললো, "তুমি যদি রাজি থাকো, তাহলে উনিও রাজি থাকবেন।"
আমাদের অফিসে বেশি কর্মচারী নেই, গ্রামের ছোট্ট সরকারি অফিস তো তাই, আমাকে নিয়ে মোট পাঁচজন হবে। বাকিদের কথা বলে লাভ নেই, তাহলে গল্প বড় হয়ে যাবে।
আসল কথায় আসা যাক। আমি বললাম, "সবই তো ঠিক, কিন্তু আমার বাড়ি ফেরার কী হবে?"
রতন বললো, "কেন? নয় টার লাস্ট ট্রেনে ফিরে যেও।"
আমি ভাবলাম, ঠিক আছে, কাল শনিবার, অফিস ছুটি, ভোরে ঘুম থেকে উঠে ট্রেন ধরার চাপ নেই। আমি বললাম, "ঠিক আছে, তাহলে পিকনিক হোক।"
রতন ই সব বাজার করে সব ব্যবস্থা করলো। অফিস টাইম শেষ হওয়ার পর আমাদের রান্নাবান্না শুরু হলো। ভাত, ডাল, আলুভাজা, মুরগির মাংস আর চাটনি, আর শেষে একটা রসগোল্লা।
রান্নাবান্না, খাওয়া-দাওয়া যখন শেষ হলো তখন ৮:৩০ বেজে গেছে। আমি তাড়াতাড়ি স্টেশনে যাওয়ার জন্য রেডি হতে লাগলাম, কারণ পায়ে হেঁটে স্টেশনে যেতে হবে, গ্রামে এত রাতে কিছু পাওয়া যাবে না। পায়ে হেঁটে স্টেশন ২০ মিনিটের পথ।
আমি যখন বেরিয়ে যাব, তখনই জোস্টি দা বলে উঠলো, "পলাশ, এত রাতে তোমায় যেতে হবে না, তুমি আমার সাথে আমার বাড়িতে চলো, কাল ভোরের ট্রেনে চলে যেও।"
আমি বললাম, "না জোস্টি দা, আমাকে রাতে বাড়ি ফিরতে হবে, কাল সকালে একটা কাজ আছে।"
জোস্টি দা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন, তারপর বললেন, "ঠিক আছে, তবে যাও, কিন্তু সাবধানে।"
আমি জোস্টি দা আর রতনকে গুড নাইট বলে বেরিয়ে পড়লাম। রাতে গ্রামের রাস্তা অন্ধকার, ঠিক করে কিছু দেখা যায় না, মোবাইলের আলো যতটুকু দেখা যায়, আর পেট ভরে থাকার জন্য জোরে চলতেও পারছি না।
যেমন তেমন করে যখন স্টেশনে পৌঁছলাম, ঘড়িতে দেখি ৯:৩০ বেজে গেছে। প্ল্যাটফর্ম একদম ফাঁকা, কেও কোথাও নেই। খালি ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ।
আমার বুঝতে একটুও দেরি হলো না যে, ট্রেন মিস করে ফেলেছি। এবার ভোর ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এবার বাকি রাতটা এই স্টেশনে কাটাতে হবে।
আমি একটা বেঞ্চের উপর বসে পড়লাম, আর জোস্টি দার কথা ভাবতে লাগলাম। জোস্টি দা ঠিকই বলেছিলেন, ওনার সাথে ওনার বাড়িতে চলে গেলে ভালই হতো।
এইসব কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই।
হঠাৎ একটা মেঘ ডাকার শব্দে আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। চমকে উঠে দেখি চারিদিক নিস্তব্ধ অন্ধকার, এক-দুটো প্ল্যাটফর্মের লাইট জ্বলছে, তাতে ভালো করে কিছু দেখা ও যায় না। তার সাথে বিদ্যুতের ঝলকানি আর মেঘ ডাকার আওয়াজ পরিবেশটা কেমন ভীতিকর করে তুলেছে।
আমি গা মুড়াতে মুড়াতে ঘড়ির দিকে দেখি ১২ টা বেজে গেছে।
প্ল্যাটফর্মের চারপাশে চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ চমকে উঠলাম।
প্ল্যাটফর্মের এক কোণায় একটা লোক স্যুট-বুট, আর মাথায় কালো টুপি পরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভাবলাম, যাক, কেউ তো আছে, আমি একা নই।
তখনই আমার মনে হলো, আমি যখন প্ল্যাটফর্মে এসেছি তখন তো কাউকে দেখতে পাইনি, তাহলে এই লোকটা এলো কোথা থেকে? হয়তো আমি যখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তখন এসেছে।
কিন্তু এই গ্রামে স্যুট-বুট পরা লোক!
চোর নয় তো?
এইসব ভাবতে ভাবতে যখন লোকটার দিকে আবার তাকিয়েছি, তখন আমার শরীর দিয়ে যেন একটা ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল।
দেখি লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
অন্ধকারে ঠিক ভালো করে কিছু দেখা না গেলেও লোকটার চোখের চাওনির যা তেজ, সেটা বুঝতে আমার বেশি সময় লাগলো না।
আমি দেখলাম, লোকটার দৃষ্টিতে কেমন যেন আগুন জ্বলছে, যেন প্রচুর রেগে আছে।
আমি ভয়ে উঠে যেতে চাইলাম, কিন্তু উঠতে পারলাম না। মনে হলো কেউ যেন আমাকে ধরে রেখেছে।
ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেছে, আর হাত-পা কাঁপছে।
চিৎকারও করতে পারছি না, গলার আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেছে।
ঠিক তখনই দূর থেকে ট্রেনের আওয়াজ কানে এলো।
মনে হচ্ছে কোনো ট্রেন আসছে স্টেশনের দিকে।
এতে আমি একটু সাহস ফিরে পেলাম।
ট্রেনের দিকে চোখ ঘোরাতে দেখি ঝড়ো গতিতে একটা মালগাড়ি ধেয়ে আসছে প্ল্যাটফর্মের দিকে।
আমি ইঞ্জিনের আলোতে লোকটাকে ভালো করে দেখবো বলে যেই তাকিয়েছি, অমনি দেখলাম লোকটা এক দৌড়ে ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিল।
ওই দেখা মাত্রই আমার আর কোনো জ্ঞান ছিল না।
যখন জ্ঞান হলো, তখন দেখি স্টেশন মাস্টারের ঘরে শুয়ে আছি, আর সামনে স্টেশন মাস্টার আর লাইনম্যান দাঁড়িয়ে আছে।
আমাকে চোখ খুলতে দেখে বললো, "কী পলাশ বাবু, আপনি রাতে স্টেশনে কী করছিলেন?"
আমি আস্তে আস্তে পুরো ঘটনাটা জানালাম।
তখন আমার সব কথা শুনে স্টেশন মাস্টার বললেন, "আপনি তাহলে ওনার দেখা পেয়েছেন।"
আমি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম, "ওনার দেখা মানে?"
তখন স্টেশন মাস্টার বলে উঠলেন, "আরে, অনেক বছর আগে এই স্টেশনে এক সাহেব স্টেশন মাস্টার ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে সুইসাইড করেছিল। ওনাকে নাকি রাতে দেখা যায় ঝাঁপা তে।"
আমি শুনে তো কিছু না বলে চুপচাপ ট্রেনে চেপে বাড়ি চলে আসি।
তারপর থেকে এই ঘটনা যখনই মনে পড়ে বুঝতে পারি না, আমার মনের ভুল, না সত্যিই ভৌতিক?
এরপর অনেক চেষ্টা করে আমি অন্য জায়গায় ট্রান্সফার নিয়ে নি।**

