NK Mondal

Abstract Inspirational Others

2  

NK Mondal

Abstract Inspirational Others

জ্যান্ত কবজ

জ্যান্ত কবজ

7 mins
164


বক্সিগঞ্জের এক পাড়াগাঁয়ে রহিম এবং করিম ছুলছুলি (ডাকনাম) বলিয়া দুইজন বসবাস করিত। উহারা গ্রামের মধ্যে নানান বিবাদে জড়িয়া পড়িত। তাহারা এক প্রকার বদমাইশ ছিল। এমনিতেই বক্সিগঞ্জ সুবিধাজনক ছিল নাই। সারাদিন চুরি চামারি হিংসা বিদ্দেষ উগ্রমেজাজ লেগেই থাকিত। উহারা মুছলমান হওয়ার জন্য উহাদের গাঁয়ের লোকে মান্য করিত। অল্প অল্প সময়ে নামাজ পড়িত। বয়স্ক ছিল মোটামুটি পঞ্চাশ কি বাহান্ন হইবে। তাহারা গ্রামে নানান অপকর্মে জড়িত ছিল। নানান মামলা মোকাদ্দামা। এক সময় বক্সিগঞ্জে ওলাওঠা রোগ হইয়া মৃত্যু হইয়াছিল অনেকের, সে সুজোগে উহারা সিঁধ কাটিয়া চুরি করিয়া কিছু কামাইয়া নিয়াছে। সেসব মালকড়ি ফুরাইতেই উহাদের চিন্তা হইল কিভাবে তাহারা সংসার চালাইবে। রহিম করিম দুই বন্ধু মিলিয়া যুক্তি করিল যে, তাহারা বিদেশে যাইবে কাজের সঁন্ধানে। বিদেশে যাইয়া কিছু কামাই করিয়া গৃহের দিকে ফিরিবে, নচেৎ ফিরিবে না। উহারা বৌ বাচ্চা রাখিয়া, একদিন প্রভাত হইবার পূর্বেই বাহির হইয়া যাইল। প্রভাত যখন হইল, তখন রেলস্টেশন পৌঁছাইয়া গিয়াছে। উহারাদের তখন উদর ভোজনের প্রয়োজন পড়িয়া গেল। শহরে কি আর বিনা পয়সায় কেইবা খাইতে দিবে। পোটলাতে কিছু খাবার ও কাজ করিবার যন্ত্রপাতি রহিয়াছে। উক্ত খাবার এখনই খাইয়া লইলে সমস্ত পথে কি খাইবে ভাবিতে লাগিল। করিম ছুলছুলি ভাবিতে ভাবিতে একটা উপায় বাহির করিল। যে উহারা বিনা পয়সায় খাইবে পেট পুরিয়া। করিম যুক্তিটা রহিমের কর্ণমূলে ফিসফিস করিয়া প্রবেশ করিয়া দিল। রহিম করিমের যুক্তিতে রাজি হইয়া একটা শহরের বড় হোটেলে যাইয়া চেয়ারে বসিয়া পড়িল। ভাত মাছ মাংস দই ইত্যাদি অর্ডার করিল। কিছুক্ষণ পরে হোটেলের এক কর্মচারি আসিয়া উহাদের সম্মুখে অর্ডার করা নানান খাবার উপস্থাপন করিয়া চলিয়া গেল। রহিম ও করিম চট জলদি গোগ্রাসে খাইতেছে। ইহা দেখিয়া আশে পাশের ভোজনকারীগণ উহাদের ভোজন পক্রিয়া দেখিতেছে। বারবার ভাত মাছ মাংস ডাল আনিতে আনিতে বিরক্ত হইয়া যাইতেছে হোটেলের কর্মচারীবৃন্দ। অনেকে হা হা করিয়া হাসিতেছে। আবার কেউ রুমাল দিয়া মুখ আবৃত করিয়া হাসিতেছে। ইহা দেখিয়া অনেকের ভোজন উঠিয়া গেল। অনেকে হাত তালি দিতেছে। কেহ সাহস দিতেছে আরো খাইবার জন্য। রহিম ও করিম উহাদের উৎসাহ দেখিয়া জোরে জোরে খাইতে লাগিল। কিন্তু তাহাদের পকেটের পয়সার দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। তাহারা পয়সার কথা ভুলিয়া গিয়াছে, উহারা মনে করিতেছে ইহা গ্রাম্য মুছলিম পরিবেশের বিবাহ অনুষ্ঠানের আহার খাইতেছে। মনে হইতাছে করিম ও রহিম ভোজন পূজার প্রতিযোগিতা করিতেছে। ভোজন পক্রিয়া শেষ হইল। ওয়াশরুমে হাত মুখ ধৌত করিয়া গোছগাছ করিতেছে হোটেলের বাহিরে। ওই মহুর্তেই হোটেল কোষাধ্যক্ষ খাতা খুলিয়া হিসাব বলিল। উহাদের মোট দুইশো নব্বই টাকা হইয়াছে। হঠাৎ করিয়া মাথায় হাত রহিম ও করিমের। করিম কোষাধ্যক্ষক কে কহিল, আমরা দুই মিত্র টাকা দিতেছি কিছুক্ষণ পরে, একটু এই মাচাটায় শুইয়া লই। আমাদের শরীর আর চলিতেছে না। হাসফাস করিতেছে। কোষাধ্যক্ষ মনে মনে ভাবিল, ইহারা প্রচুর খাইয়াছে ইহার জন্যই অসুবিধে বোধ হইতেছে । বিশ্রামের প্রয়োজন রহিয়াছে। এই ভাবিয়া কোষাধ্যক্ষ হোটেলের অন্দরমহলে চলিয়া গেল। রহিম ও করিম দুই মিত্র মিলিয়া শুইয়া পড়িল হোটেলের মাচায়। পাশেই রহিয়াছে বড় নদী। নদীটা চলিয়া গিয়াছে সূদূর রাজধানীতে। নদীর ওই তীরে শহর রহিয়াছে। উহারা ওখানে যাইবার জন্যিই আসিয়াছিল। দুই মিত্র মিলিয়া ফিসফিস করিয়া কি যেন ওরা দুইজনে কহিল। এবং কিছুক্ষণ পরে দুই মিত্র মিলিয়া বিবাদে লিপ্ত হইয়া গেল। তাহাদের কর্মকাণ্ড হোটেলের লোকেরা দেখিতে লাগিল। একজন মিত্র কহিল ওই যে দূরে তালগাছ দেখা যাইতেছে উহা ছুঁইতে হইবে। তাহলেই জানিব খাওয়ার পরে দৌড়াইতে কে বেশি পারে। ইহায় আলোচনা হইতেছে দুজনের মধ্যে । দুজনেরই পিঠে রহিয়াছে ব্যাগ। সকলে বলিল ঠিক আছে একসঙ্গে প্রতিযোগিতা হউক। ফলে বুঝিতে পারিব কে প্রতিযোগিতায় প্রথম হইল, আর কে হারিলো। ইহা সবার মনব্রত হইল। উহারা একসঙ্গে দৌড়াইতে লাগিল। দৌড়াইতে দৌড়াইতে তাহারা তালগাছ ছাড়িয়া স্টেশনের দিকে পলায়ন করিল। তাহাদের পলায়ন দেখিয়া সবাই বুঝিতে পারিল যে, উহারা বাটফার। কেহ কেহ মুছলিমদের জাত তুলিয়া গালি দিল। জাত তুলিয়া গালি দিতেই আরো মুছলিম খদ্দেরেরা খেঁপিয়া উঠিল। হোটেল মালিক ও কর্মচারিগণকে মারিবার উপক্রম হইয়া উঠিতেই হোটেল পক্ষ ক্ষমা স্বিকার করিল। এবং উক্ত প্রসঙ্গেই উহারা হোটেলের বিল না মিটিয়া উগ্র মেজাজ হইতে বাহির হইয়া গেল। হোটেল মালিকের আজ বড় লোকসান হইয়া গেল, সে বুক ফাটাইয়া ক্রন্দন করিতে লাগিল। রহিম ও করিম সময় বুঝিয়া রেলে উঠিয়া পড়িল।


টিকিট না কাটিয়া রেলে উঠিয়া পড়িল। যাইতে যাইতে কর্মস্থলে নামিয়া পড়িল। পূর্ব হইতেই কর্মক্ষেত্র পাকা হইয়াই ছিল, ইহাতে নতুন করিয়া কর্মস্থল খুঁজিতে হইল না। উহারা ধান কাটিবার জন্য লাগিয়া পড়িল। প্রতিদিন মালিকের ধান কাটাই বাছাঁই করিতে হয়। ওই গ্রামটা অনেকটা আবাং ছিল, কেন না গ্রামটি ছোট জাতী দিয়া বেষ্টিত। উহারা খুবই সহজ সরল। একদিন হইল কি মালিকের বাড়ির পাশেই একজনের কন্যার ভূতে ধরিল। উহারা বদ্দি, হেকিম দেখাইয়া ভালো করিতে পারিতেছে না। ইহা শুনিয়া দুই মিত্র দেখিতে যাইল। এবং দেখিয়া বুঝিল মেয়েটির ভূতে ধরিয়াছে। করিম ছুলছুলি একটু আধটু নামাজ টামাজ পড়িত। ভূত টুত তাড়াইতে পারিত। তাহার কিছু মুছলমানি মন্ত্র জানা আছে। করিম কহিল ইহা আমি এক চুটকিতে ভালো করিয়া দিতে পারি। তাহার জন্য বিস্তার খরচ হইবে। রোগীর পরিবারেরা সু অবস্থাজনক থাকায় মোটা টাকার দাবি করিল করিম। তাহারা কহিল সুস্থ করিতে পারিলেই উহাদের ধার্যিত টাকা দেওয়া যাইবে। করিম ও রহিম রুগীকে একলা নিয়া চলিয়া গেল একটি কক্ষে। দরজা বন্ধ করিয়া দিল। রহিম কহিল, এই ব্যাটা তুই কি পারবি ইহার রোগ সারাইতে। করিম কহিল ইহা তাহার কাছে জলভাত। করিম একখানা নিম পাতা সহ ডাল আনিয়া মুছলমানী মন্ত্র পড়িয়া পড়িয়া ডালের বারি মারিতেছে। তাহার সঙ্গে কি বিড়বিড় করিতেছে। রুগীর আওয়াজ বাহির পর্যন্ত শুনা যাইতেছে। কিসব আজে বাজে বকিতেছে। কিছুক্ষণ পরে রুগী বেহুস হইয়া পড়তেই তাহাকে জল ছিঁটিয়া জ্ঞান ফিরিয়া আনিল। পরেরদিন হইতে রুগী পুরাপুরি সুস্থ হইয়া যাইল। স্বাভাবিক হইয়া গেল। মাঝেমধ্যে ঝাড়ফুঁক করিতে আসিতেছে গ্রামের বাসিন্দাগণ । ইহাতে তাহাদের রোগ সারিয়া যাইতেছে। তাহাদের মোটা মোটা টাকা দিতেছে। মাঝেমধ্যে মাঠে ধানের জমিতে চলিয়া যাইতেছে রুগীগন, আর উহাতে ধানজমি মালেকের লোকসান হইয়া যাইতেছে । কাজ কম হইয়া যাইতেছে। তবুও জমি মালিক তাহাদের কিছুই বলিতেছে না। ইহা দেখিয়া রহিমের একটা কুচিন্তা মাথার মধ্যে চলিয়া আসিলো। সে রাত্র হইলে বলিবে করিমকে। সারাদিন কাজে লিপ্ত ছিল। সঁন্ধ্যা বেলায় কোন প্রকার কাজ না থাকায় তাহারা দুজনে পাড়া বেড়াইতে লাগিল। তাহাদের কথা লোকমুখে প্রচার হইয়া গিয়াছিল বলিয়া উহারা গ্রামে যথাযথ সম্মান পাইতেছে। যেখানে যাইতেছে সেখানেই খাতির যত্ন পাইতেছে। কেহ মিষ্টি খাওয়াইতেছে, আবার কেহ মোটা মাছ ভাত খাওয়াইতেছে। উহাদের আনন্দ আর ধরে না। রাত্রে রহিম কহিল করিমকে। এই সময়ে আমাদের কিছু কামাই করার সুযোগ রহিয়াছে। কামাই করিতে হইবে। করিম কহিল, কি করিয়া কামাইব। রহিম যুক্তি দিল যে, বাজার হইতে কিছু ঔষধ আনিতে হইবে। যেমন জ্বর, পাইখানা, আমাশা, কাশি, চুলকানি, গ্যাস। যন্ত্রণা। ইহা আনিয়া রাইখা দিতে হইবে আর কিছু মুছলমানী তাবিজ কবজ বাইনাইতে হইবে।


উহাদের জ্বর জ্বালা হইলে দু চারটে বড়ি আর একটা দুটা মুছলমানী তাবিজ কবজ দিতে হইবে। ইহার জন্য বসিয়া বসিয়া মোটা টাকা রোজগার করা যাইবে। করিম রহিমের কথা শুনিয়া একশো কোশ দূরে বাজার হইতে ঔষধ, তাবিজ কবজ কিনিয়া নিয়ে আসিলো। উহারা প্রতিদিন বিকালে বসিয়া যায় একটি ঘর ভাড়া লইয়া। বিকেল বিকেল ঝাঁকে ঝাঁকে রুগীরা আসিতেছে। জ্বর সর্দি, পাইখানা, বমি ইত্যাদি হইতাছে। উহারা ওই ঔষধ দিতেছে আর তাবিজ কবজ দিতেছে। আর অনেক অনেক টাকা রোজগার হইতাছে। উহারা একদিন এক ফঁন্দি বাহির করিল, যাহারা রুগী নয় তাহাদের কাছ হইতে কিভাবে রোজগার করা যাইবে। উহারা বাঁশতলা হইতে কিছু কুকুরমাছি ধরিয়া তাবিজের মধ্যে চালান করিয়া দিল এবং উহাতে কিছু পরিমাণ খাদ্য প্রবেশ করিয়া এবং তা বাহির থেকে সিল করিয়া দিল। এবং সবার মাঝে বলিতে লাগিল যে, ইহা যে ব্যক্তি ধারণ করিবে উহার বড় বড় রোগ হইবে না এবং উহাদের অল্প অল্প রোগ হইবে। কম রোগ হইবে। ইহা বলিয়া সারা গ্রামে খবর বাষ্ট করিয়া দিল। একদিনের মধ্যেই হাজার হাজার লোক আসিয়া উহা কিনিতেছে। রহিম ও করিম বলিতেছে নিয়ে যান নিয়ে যান রোগ নিরাময়ী জ্যান্ত কবজ। তাহারা প্রচুর পরিমাণে অর্থ উপার্জন করিল। তাহাদের পূর্বে বিশ্বাস করিয়াছে গ্রামের মানুষ। এই করিয়া অনেক টাকার মালিক হইয়া গেল তাহারা। একদিন ইহাদের কর্মকাণ্ড ফাঁস হইয়া যাইতেই উহাদের মারতে আসিতেছে গ্রামবাসী। উহারা তা শুনিতে পাইয়া দৌড়াইয়া পলায়ন করিল শহরের দিকে। তাহারা স্বগৃহে আসিয়া বিঘা বিঘা জমি কিনিল, বাড়ি বানাইল। ব্যাবসা করিল, তবে রহিমের ভাগ ছিল মাত্র দেড়ভাগ। আর সবই করিম ছুলছুলির। কিন্তু গোণ্ডক গ্রামের রোগ আসলেই ভালো হইতেছিল, কিন্তু তাবিজ কবজ করিতেই উহাদের ব্যবসা উঠাইয়া গেল। এখন তাহারা পস্তাইতেছে উহাদের তাড়াইয়া কি ভূল করিয়াছে। আর রহিম করিম দুই মিত্র মিলিয়া সুখে বসবাস করিতে লাগিল। তাহাদের গ্রামের লোকে খুব মান্য করিতে লাগিল। দোতলা বাড়ি, অনেক ধানিজমি, ব্যবসা। উহাদের পূর্বের জঙ্গিপনা কাজ অর্থাৎ চুরি, ডাকাতি, ধর্ষন, খারাপ কাজ ধনী হওয়ার তাগিদে সব ঢাকিয়া পড়িল। এখন উহারা গ্রামের মাতব্বর হইয়া দেশ চালাইতেছে। তাহারা সমাজের বিচার করিয়া অর্থ কামানোর উপায় বাহির করিয়াছে। গ্রামের ভোলাভালা মানুষগুলিকে পাইয়া মজা করিতেছে। উহার সঙ্গে সামাজিক অর্থ নিয়া নিজেদের উদর ভর্তি করিতেছে।


শ্রেষ্ঠ কথা ইহা হইল যে, মন্দ স্বভাবের লোক হাজার ভালো কর্ম করিব ভাবিলেও উহা ভালো হইবে না মন্দই হইবে। কেননা উহাদের অন্তর হইতে এখনো লোভ পরিত্যাগ হয়ে উঠেনি। আর যদিও বা হয় তা হয়ত লক্ষে একটি বা একজন হইতে পারে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract