জন্মশতবর্ষের আলোকে টেনিদা
জন্মশতবর্ষের আলোকে টেনিদা
বাংলা সাহিত্যে তখন দাদা ও মানিক জোড়ের যুগ শুরু হয়েছে । ইত্যবসরে সেই সব চরিত্রের মধ্যে হাজির হল পটলডাঙ্গা নিবাসী এক পেটুক ও তাঁর সাকরেদ বাহিনীর উপর কর্তৃত্ব করা এক দাদার । তাঁর তিন সাকরেদও তাঁর থেকে পিছিয়ে ছিল না । এদের মুখে ছিল সেই অবিস্মরণীয় সোল্লাস চিৎকার – ‘ ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস । ........ ইয়াক্ ইয়াক্ । ‘
বাংলা সাহিত্যে টেনিদার মানস পিতা ছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ( ০৪.০২.১৯১৮ – ০৬.১১.১৯৭০ ) । তাঁর জন্ম হয়েছিল অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার বালিয়াডাঙ্গীতে । তাঁর মূল নাম ছিল তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় । কিন্তু তিনি তাঁর ডাক নামে বেশী পরিচিত ছিলেন । তাঁর পিতা প্রমথনাথ গঙ্গোপাধ্যায় পুলিশে কর্মরত ছিলেন । পিতৃদেবের বদলির চাকরির নিমিত্ত তিনি বাংলাদেশ ও পরবর্তীকালে কোলকাতায় এসে পড়াশোনা করেন । তাঁর পড়াশোনার পথ খুব মসৃণ ছিলনা । স্বদেশী আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে কলেজ থেকে তাঁকে পরীক্ষায় বসার অনুমতি দেওয়া হয়নি । পরবর্তীকালে তিনি বরিশালের বি.এম. কলেজ থেকে I.A. ডিগ্রি অর্জন করেন । ১৯৩৮ সালে তিনি ওই একই কলেজ থেকে বাংলা বিষয়ে স্নাতক হন । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য , সেই সময় তাঁর শিক্ষক ছিলেন বিখ্যাত কবি জীবনানন্দ দাশ । ১৯৪১ সালে কোলকাতার ব্রহ্মময়ী কলেজ থেকে স্বর্ণ পদক সহ তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন । ১৯৬০ সালে বাংলা ছোট গল্পের উপর গবেষণার কারণে ডি.ফিল. লাভ করেন । তিনি পশ্চিমবঙ্গের অনেকগুলি কলেজে অধ্যাপনা করেন । তাঁর মধ্যে আনন্দ চন্দ্র কলেজ , কোলকাতাঁর সিটি কলেজ উল্লেখ্য । ১৯৫৬ সাল থেকে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত হন । অধ্যাপক থাকাকালীন বিখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় , বিখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ তাঁর ছাত্র ছিলেন । তাঁর এই সুদীর্ঘ জীবনে তিনি অনেক ছোট গল্প , নাটক ও উপন্যাস লিখেছেন । সাহিত্যে অমূল্য অবদানের জন্য ১৯৬৪ সালে তাঁকে ‘ আনন্দ পুরষ্কার’ –এ ভূষিত করা হয় ।
ছোটবেলা থেকেই তাঁর লেখা নানা পত্র-পত্রিকাতে প্রকাশিত হত । সন্দেশ , শুকতারা প্রভৃতি বিশিষ্ট শিশু-কিশোর পত্রিকাতে তাঁর লেখনী পাঠককূলকে প্রভূত আনন্দ প্রদান করেছে । ছোটদের পাশাপাশি বড়দের জন্যও তাঁর কলম সমানভাবেই সচল ছিল । সাপ্তাহিক ‘দেশ’পত্রিকাতে ‘ সুনন্দর জার্নাল ‘ নামে বাংলাতে একটি লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হত । বলাই বাহুল্য , এই বিশেষ লেখাটিরও স্রষ্টা ছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় । এই জার্নালে তৎকালীন রাজনীতি , সমাজব্যবস্থা , জীবনচর্চা , সংস্কৃতি প্রভৃতির প্রকাশ ছিল । বড়দের জন্য লেখা তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘উপনিবেশ’ প্রকাশিত হয় ‘ মাসিক ভারতবর্ষ’তে । ১৯৪৩ সালে এই উপন্যাসটি গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয় । উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, সুধাংশুকুমার রায় চৌধুরী, বিজয় লাল চট্টোপাধ্যায়, মন্মথ সান্ন্যাল, সজনীকান্ত দাস ও ফনীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর অনুপ্রেরনা । ছোটদের জন্য তাঁর রচিত পদ্মপাতার দিন, পঞ্চাননের হাতি, লালমাটি, তারা ফোটার সময়, ক্যাম্বের আকাশ,কাবলু কাকা, খুশির হাওয়া, কম্বল নিরুদ্দেশ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য । কৃষ্ণপক্ষ, গন্ধরাজ, পন্নন্তর, ট্রফি, তিমির তীর্থ, দুঃশাসন, গদসঞ্চার, বনজ্যোৎন্সা, বিদিশা, বীতংস, বৈতালিক, ভাঙাবন্দর, চন্দ্রমুখর, মহানন্দা, রামমোহন, শিলালিপি, শ্বেতকমল, সাগরিকা, স্বর্ণ সীতা, সূর্যসারথী, সঞ্চারিণী, সম্রাট ও শ্রেষ্ঠী, সাপের মাথায় মণি, আশিধারা প্রভৃতি তাঁর রচিত বড়দের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ।
লেখকরা সাধারণত তাঁদের লেখার রসদ তাঁদেরই আসপাশ থেকেই সংগ্রহ করে থাকেন । নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও এর ব্যাতিক্রম হয়নি । একবার কোনও পারিবারিক আড্ডাতে তাঁকে কেউ বড় ঘুড়ির গল্প শুনিয়েছিলেন । পরবর্তীকালে সেই গল্প থেকেই ‘ ঢাউস ‘ গল্পের সৃষ্টি হয়েছিল । তাঁর অমর সৃষ্টি টেনিদার ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয়নি । প্যালারাম ছিল তাঁরই মুখপাত্র । হাবুল নামটা এসেছিল তাঁরই এক ভাই হাবু-র থেকে । ক্যাবলাও ছিল তাঁরই আরেক সম্পর্কের ভাইয়ের নাম । আর টেনিদা ! তাঁর নিজের চরিত্রের বিভিন্ন ছাপ দেখা যায় টেনিদার মধ্যে । তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী “ আমি তখন মিলিটারি অ্যাকাউন্টসে কাজ করি । অফিস-ক্লাব গোলকিপার কাউকে না পেয়ে ধরে-বেঁধে নামিয়ে দিল । আমি সাক্ষীগোপালের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে । ওদিকে অন্য দলের খেলোয়াড়রা গোল করতে ছুটে আসছে । আমাকে বন্ধুরা যত বলে ‘ ডাইভ দে , ডাইভ দে ‘, আমি নড়ি না । ডাইভ দেব কেমন করে , ওখানে কাদা ছিল যে ! পর পর দুটো গোল খেয়েই চোঁ চাঁ দৌড় মেরে ট্রামে উঠে সোজা বাড়ি । পরদিন অফিস যেতেই চেঁচামেচি , গালাগাল । আমি বললাম , তোমরা দশজন মিলে যাকে আটকাতেই পারলে না , তাকে আমি একা আটকাব , আশা কর কী করে ? “ এই ঘটনাই টেনিদার ক্ষেত্রে হয়েছিল – ‘ গড়ের মাঠে তিন তিনতে গোরার হাঁটু ভেঙে দিয়ে রেকর্ড করেছেন ।‘ তিনিও বাস্তব জীবনে টেনিদার মতোই ভীতু ছিলেন ।
টেনিদা ও তাঁর তিন সাকরেদের সঙ্গে আমার পরিচয় ‘ চারমূর্তি’র হাত ধরে । স্বর্ণেন্দু সেন , কুশল মিত্র আর কমলেশ ব্যানার্জি ছিল যেন আমারই ভিন্ন রূপান্তর আর ভজহরি মুখার্জি ছিল আমাদেরই অভিভাবক । জানতাম চিনতে পারবেন না । আরে বাবা ! এরাই তো হল হাবুল , ক্যাবলা , প্যালারাম আর টেনিদা । আসলে এগুলো হল ওদের ভালো নাম । তৎকালীন শিশু সাহিত্যে এই চারমূর্তি ছিল শীতকালের এক চিলতে রোদ । কৌতুকের সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চার যুগলবন্দী এই চারমূর্তির হাত ধরে আমি দেখতে পেলাম । ক্লাস সিক্স – সেভেনের বাংলা ব্যাকরণ বইয়ের প্রবাদ-প্রবচনের লিস্টের বাইরেও যে আরও প্রবাদ-প্রবচন হয় , সেটা চিনিয়েছে টেনিদা স্বয়ং । কোনও সমস্যাই যে সমস্যা নয় , সেটাও আমাকে শিখিয়েছিল টেনিদাই । স্কুল –কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে আমি এসে পড়লাম চাকরি জীবনে । বলাবাহুল্য ওই তিন বন্ধু আর টেনিদাকে সঙ্গে করে । এই ক্ষুদ্র জীবনে যখনই কোনও সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি তখনই স্মরণ করেছি মহাপুরুষরূপী টেনিদাকে । টেনিদার বয়সের দিক থেকে সদ্য দুর্দান্ত একটা সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন । নিত্য ব্যায়াম করা সুঠাম শরীরের অধিকারী মহান টেনিদা অবলীলায় বয়সের বলকে অনায়াস ভঙ্গিতে ওভার বাউন্ডারি মেরে ব্যাট উঁচিয়ে দর্শককুলের শতকীয় অভিনন্দন কুড়োতে ব্যাস্ত । আর তাঁর তিন সাকরেদ গেছে তাদের প্রিয় টেনিদার জন্য আলু কাবলি আনতে । এই ফাঁকে চুপিচুপি আপনাদের একটা কথা বলে রাখি । আমি কিন্তু এখনও কোলকাতা গেলেই টেনিদার সঙ্গে দেখা করে আসি । টেনিদাও আমাকে কথা দিয়েছেন তিনি আমাকে তাঁর সাকরেদ বানিয়ে নেবেন । আর আপনাদেরও ঠিকানাটা দিয়ে দিচ্ছি । কিন্তু খবরদার ! আমার নাম কিন্তু কেউ টেনিদার সামনে করবেন না , তাহলেই উনি গাট্টা মেরে আমার মাথা ফুলিয়ে দেবেন । টেনিদার ঠিকানা হল – ২০,নম্বর , পটলডাঙ্গা স্ট্রীটের চাটুজ্জ্যেদের রোয়াক । অনেক কথা হল । চলুন এবার সবাই মিলে যাই টেনিদার চিরসবুজ ব্যাটিং দেখতে ।