Sanghamitra Roychowdhury

Drama Romance Classics

4  

Sanghamitra Roychowdhury

Drama Romance Classics

জন্মান্তর না জাতিস্মর

জন্মান্তর না জাতিস্মর

5 mins
202


"মৃগনয়নী, তান্নে মান্নে ছোড়কর না যাইগ্য... ওওও, মৃগনয়নী, মৃগনয়নীইইই..."

আজন্ম নর্থ ক্যারোলিনায় বড়ো হওয়া ভারতীয় ও বাঙালি বংশোদ্ভূত অনির্বাণের মুখে এমন চিৎকার শুনে, ভোররাতের গাঢ় ঘুম ভেঙে, প্রথমেই হকচকিয়ে গেলো তার আমেরিকান বৌ ক্যাথরিন। তারপর ফোঁসফোঁস করে কাঁদতে বসলো। ভারতীয় বাঙালি পরিবারে বৌ হবার সুবাদে ক্যাথরিন এটুকু জানে "মৃগনয়নী" কোনো ভারতীয় মেয়ের নাম হওয়ার সম্ভাবনা, আর "ছোড়কর না যাইগ্য" মানে আন্দাজ করে নিলো ক্যাথরিন, "প্লিজ, ডোন্ট লিভ মি অ্যালোন!" আসলে ছোড়কর কথাটা ক্যাথরিন অনেকবার অনির্বাণের মা... দিল্লী প্রবাসী বাঙালি পরিবারের মেয়ে রূপালীর মুখে শুনেছে, ওদের নিজেদের মধ্যেকার কথাবার্তায়। ক্যাথরিন বড়ো ভালোবাসে অনির্বাণকে, সেই একদম জুনিয়র স্কুল থেকে। তারপর হাইস্কুল, ইউনিভার্সিটি সবটাই একসাথে, একক্লাসে। এমনকি পড়ানোর চাকরি আর গবেষণা... তাও একসাথে। তারপর হলো ওদের বিয়ে... তাও নয়-নয় করে বছরচারেক। ছেলেপুলের দায়িত্ব এখন দুজনেই নিতে চায়নি বলেই এখনো ওরা দুজনেই কেবল, থাকে নিউ জার্সির এক অ্যাপার্টমেন্টে। ক্যাথরিন বাকি রাত আর ঘুমোতেই পারলোনা। স্বামীর এই একটা ব্যাপারে বোধহয় সবদেশীয় মেয়েদেরই সমান প্রবল আপত্তি, যে আমার সাথে বিছানায় শুয়ে তুমি অন্য মেয়েকে ডেকে চলেছো ঘুমের ঘোরে? সুতরাং ক্যাথরিনও প্রাথমিক শোকের ধাক্কা সামলে এখন বেজায় চটেছে। ফুটছে বলাই বেশি যুক্তিযুক্ত। সকাল হওয়ার অপেক্ষায় বসে আছে। যদিও অনির্বাণ এখনো ঘুমোচ্ছে। উইকেণ্ড বলে কথা।


ব্রেকফাস্ট টেবিলে ক্যাথরিনের গোমড়ামুখ দেখে অনির্বাণ ভাবলো, ছুটির দিনে রান্নাবান্নার চাপে ক্যাথরিনের মেজাজ বিগড়ে আছে। ঐকাজটি ঠিক ধাতে পোষায়না ক্যাথরিনের। তবে নিজে যথেষ্টই ভোজনরসিক। অনির্বাণের মায়ের হাতের রান্নার যেকোনো স্পেশাল ডিশের প্রথম চাখনদার ক্যাথরিন সেই পুঁচকেবেলা থেকেই। অনির্বাণের মা রূপালী আবার রন্ধনশিল্পী... তার যতরকমের উল্টোসিধে ফিউশন এক্সপেরিমেন্টাল রান্নার যোগ্য সমঝদার একমাত্র ক্যাথরিন। সে আবার শাশুড়ির এই কর্মকাণ্ড ভিডিও করে ছবি তুলে প্রিজার্ভ করে। শাশুড়ি-বৌমা দুজনেরই স্থির বিশ্বাস... এইসব রেসিপি একদিন ইউটিউবে বিশ্ব জুড়ে ঝড় তুলবে। কাজেই শাশুড়িকেই একমাত্র এই সমস্যার উপযুক্ত সমাধানকারী বলে মনে হবে ক্যাথরিনের এতে আর আশ্চর্য হবার কি আছে? ব্রেকফাস্ট টেবিলেই রূপালীর ফোন ছেলেকে, "এক্ষুণি বেরিয়ে পড় ক্যাথিকে নিয়ে... নর্থ ক্যারোলিনার বাড়িতে চলে আয়। তোদের জন্য ওয়েট করছি।" মুখটা ব্যাজার হলো অনির্বাণের, "মা, আজকে নির্ঘাত একটা ভয়ঙ্কর উল্টোসিধে কিছু রান্না করছে। তাই চটজলদি ডাকাডাকি। বাবার রাস্তাটাই নিতে হবে আজ... পেটটা ঠিক নেই বলে।" অন্যদিন ক্যাথরিন নর্থ ক্যারোলিনার বাড়িতে যাওয়া হবে শুনলেই একদম উড়তে থাকে যেন, কিন্তু আজ ওও অসম্ভব রকমের চুপচাপ। অনির্বাণ ঘুম থেকে ওঠার আগেই শাশুড়ি বৌমার ফোনাফুনি পর্ব যে মিটে গেছে মৃগনয়নী রহস্য উদঘাটনের... তাতো আর অনির্বাণ তখনো পর্যন্ত জানেইনা! সুতরাং দুদিনের জন্য তৈরি হয়ে ক্যাথরিনকে নিয়ে অনির্বাণ গাড়ি নিয়ে রওনা হলো। অন্যদিনে ক্যাথরিন কত হাসিখুশি থাকে মায়ের কাছে যাবার সময়... কারণ ওখানেই যে ওর নিজের মা-বাবাও থাকে, একদম পাশেই। এমনকি অন্যবারে অর্ধেক রাস্তা ক্যাথি ড্রাইভও করে ভাগাভাগি করে। কিন্তু আজ সেসব কিছুই হলোনা। ক্যাথরিনের হলোটা কী? অনির্বাণ অবাক, তবে কারণটা অবশ্য বোঝেনি কিছুই।


নর্থ ক্যারোলিনায় পৌঁছে প্রথমেই নিজের বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চলে গেলো ক্যাথি। তারপর বাড়িতে নানারকম গল্পসল্প হচ্ছে বটে, তবে ক্যাথরিন একদম গম্ভীর... চুপচাপ, একটু যেন অন্যমনস্কও। স্ট্রেঞ্জ! তবে ব্যাপারস্যাপার দেখেশুনে মশকরা করার সাহসও ঠিক পেলোনা অনির্বাণ। রাতে ডিনারের পরে রূপালী ছেলের মুখের দিকে কড়াচোখে তাকিয়ে কড়াগলায় সরাসরি প্রসঙ্গে ঢুকলো, "মৃগনয়নী কে? কদ্দিন চলছে এসব? কিতনে দিনো সে? আভি বাতাও!" উত্তেজিত হলে রূপালীর বাংলাতে হিন্দি মিশে যায়। অনির্বাণ ঝট করে বুঝে নিলো ক্যাথরিনের গাম্ভীর্যের রহস্য, তবে এটা কিছুতেই বুঝলোনা যে, মৃগনয়নী কে তা অনির্বাণ কিকরে জানবে? আচ্ছা ফ্যাসাদ হলোতো!

রূপালী হুঙ্কার দিলো আবার, "ক্যাথরিন নিজে কানে শুনেছে, তুই মৃগনয়নীকে ডেকে বলেছিস ছোড়কর না যাইগ্য... একদম অস্বীকার করার চেষ্টা করবিনা। মিথ্যেবাদী কোথাকার? এতোদূর আস্পর্দ্ধা? এই গোটা পুরুষজাতটাই বেইমান! সুযোগ পেলেই হলো... সর্বক্ষণ ছোঁকছোঁকানি!" এতোক্ষণের নীরব দর্শক-শ্রোতা অনির্বাণের বাবা অনিরুদ্ধ বলেই ফেললো, "এখানে আবার গোটা পুরুষজাতি ধরে টানাটানি কেন? তোমার ছেলের কুকর্ম তোমার ছেলের একারই!" স্বামীর দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে রূপালী আবার হুঙ্কার ছাড়ে, "তোমার মতামত কেউ চায়নি।" অগত্যা অনিরুদ্ধ বৌয়ের দাবড়ানি খেয়ে আবার বক্তা থেকে শ্রোতা-দর্শক, "রহস্য কোনদিকে গড়ায় সেটাই দেখার! মনে হচ্ছে ব্যাটাচ্ছেলে ঘটিয়েছে নির্ঘাত কিছু একটা।"


অনির্বাণ অসহায় হয়ে তাকায় বাবার দিকে একবার। ঠিক এমনসময় ক্যাথরিনের মা-বাবার মঞ্চে আগমন। হায়রে, এটাই বাকি ছিলো! এমনিতেই অনির্বাণের মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে মায়ের কথা আর বৌয়ের অভিযোগ... তারমধ্যে আবার এরাও? ক্যাথরিনের বাবা পিটার আর মা অ্যানি, একটা ট্র্যাভেল এজেন্সি চালায়। তারা এসে যা ঘোষণা করলো তার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, "অনির্বাণ নিশ্চিতরূপেই জাতিস্মর। কারণ মৃগনয়নী কোনো এখনকার ভারতীয় মেয়ে নয়। ওরা খোঁজখবর নিয়েছে। মৃগনয়নী হলো ভারতের গোয়ালিয়রের ইতিহাসে মহারাজা মানসিংহ তোমরের গুর্জরী পত্নী। ইতিহাসে মৃগনয়নীর কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। আজও গোয়ালিয়রে প্রাসাদ, মন্দির, মহল, চিত্রশালা, সঙ্গীতশালা সবজায়গায় মৃগনয়নী আর মানসিংহ তোমরের প্রেমগাথা। তবে মৃগনয়নীর আসল নাম নিন্নি। গোয়ালিয়রের কাছেই রাইগ্রামে কিছু গরীব গুর্জর কৃষকের বাস। সেই রাইগ্রামের পুরোহিত অনাথা নিন্নি ও তার দাদা অটলসিংহকে সন্তানস্নেহে মানুষ করছিল। ভাইবোন নিপুণ শিকারী ছিলো, রাইগ্রামের সবাই ওদের ভালোবাসতো, কারণ ওরাও যে রাইগ্রামের সবাইকে খুব ভালোবাসতো। রাজা মানসিংহ তোমর একবার রাইগ্রাম লাগোয়া জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে দেখেন একটি মেয়ে বিদ্যুৎগতিতে শিকারের পিছনে ছুটে শেষপর্যন্ত শিকারকে ধরাশায়ী করে নিয়ে চলে গেলো। মানসিংহ মুগ্ধ হলেন। তারপর দুজনের প্রাথমিক পরিচয় হলো। আর রাজা মানসিংহ তোমরের হৃদয়ে প্রেম জন্ম নিলো। তারপর শিকার উপলক্ষ্যেই পরবর্তী সাক্ষাতেই রাজা মানসিংহ তোমর সবার সামনেই নিন্নিকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। তবে সেই বিয়েতে রাজী হওয়ার আগে নিন্নি নিজের তিনটে শর্ত মহারাজকে দিয়ে অনুমোদন করিয়ে নেয়। শর্তগুলি:- বিয়ে রাইগ্রাম থেকেই হবে, মহারাজকে আসতে হবে বরবেশে। আর শঙ্ক নদীর জল সবসময়ে নিন্নির নিজের মহলে পাওয়া যাবে।

এছাড়া নিন্নি কখনো পর্দায় থাকবেনা, যুদ্ধেও সবসময়ে মহারাজের সঙ্গী হবে। নিন্নির সব শর্ত মেনে নিয়ে রাজা মানসিংহ তোমর এক শুভদিনে নিন্নিকে বিয়ে করেন। নিন্নির রূপ-গুণমুগ্ধ রাজা মানসিংহ তোমর নিন্নির নামকরণ করেন 'মৃগনয়নী'।

মৃগনয়নী ক্ষত্রিয় নন...গুর্জর, তাই মানসিংহের অন্যান্য রানীরা ঈর্ষান্বিত হয়ে মৃগনয়নীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে মহারাজ মানসিংহের সামনে মৃগনয়নীকে হেয় করার চেষ্টা করছিলেন। তবে মানসিংহ এসবে কান দেননি। তিনি সভাগায়ক বৈজনাথের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন মৃগনয়নীর। মৃগনয়নীর গুর্জরী রাগিণীর সাথে টোড়ী রাগসঙ্গীতের মিশ্রণ ঘটিয়ে বৈজনাথ গুর্জরী-টোড়ী রাগিনী সৃষ্টি করলেন। এছাড়াও মঙ্গল-কৌশিকী কানাড়াকেও নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করলেন। মৃগনয়নীর সান্নিধ্যে সঙ্গীতের সাথে স্থাপত্যেও কীর্তি রাখেন রাজা মানসিংহ। মৃগনয়নীর জন্যই গুর্জরীমহল নামে একটি স্বতন্ত্র প্রাসাদ তৈরি করিয়েছিলেন। এরফলে রাজা মানসিংহের বড়রানীর ভয় হলো, বুঝিবা মৃগনয়নীর ছেলেকেই গোয়ালিয়রের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী করে দেওয়া হয়। তবে মৃগনয়নী নিজেই বড়রানীর এই অমূলক ভয় দূর করেন। মৃগনয়নী নিজেই মহারাজকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নেন যে বড়রানীর ছেলেই বংশের জ্যেষ্ঠপুত্র হিসেবে হবে গোয়ালিয়রের উত্তরাধিকারী। জনশ্রুতি... রাজা মানসিংহের মৃত্যুর পর মৃগনয়নী আবার নিজের সমাজে রাইগ্রামে ফিরে যান, এবং আমৃত্যু সেখানেই থাকেন।"

মৃগনয়নী রহস্যের এমন সহজ সরল সমাধান ক্যাথরিনের মোটেও মনে ধরেনি। ও জানে ওর বাবা-মা একটু পাগলাটে হলেও মেয়ের ব্যাপারে বড্ডই সংবেদনশীল। মেয়ের মন থেকে প্রমাণছাড়া অহেতুক সন্দেহ তাড়াতেই হয়তো সত্যিকারের ইতিহাসের সাথে মনগড়া করে অনির্বাণকে জুড়ে দেবার একটা চেষ্টা করছে। জাতিস্মর বললেই হলো? ইতিহাসে আছে ভালোকথা... কিন্তু তার সাথে অনির্বাণের কি সম্পর্ক? সেবারই ভারতে গোয়ালিয়রে বেড়াতে এলো অনির্বাণরা। গুর্জরীমহলে ঘুরতে ঘুরতে ক্যাথরিনের চোখ আটকায় রাজা-রানীর এক তৈলচিত্রে। শুধু একজোড়া গোঁফ আর রাজকীয় পোশাক... জুড়ে দিলেইতো অনির্বাণ অবিকল রাজা মানসিংহ তোমর। তবেকি সত্যিই অনির্বাণ জাতিস্মর? এর সঠিক উত্তর কিছু নেই। তাহলে? তবে অনির্বাণও অবশ্য ঐ একদিন বাদে আর কখনো মৃগনয়নীর নামও উচ্চারণ করেনি। কী বিচিত্র!


Rate this content
Log in