জনগণের রায়
জনগণের রায়


সকাল থেকে আপামর ভারতবাসীর নজর দূরদর্শনের পর্দায়। মাসাধিক কাল সময় ধরে যে ভোট যুদ্ধ চলেছে আজ তার শেষ অধ্যায়। জনগণের রায় জানতে সবাই আগ্রহী। প্রতিবারের মতো সবার আশা নতুন সরকার এলে একটা আমূল পরিবর্তন আসবে দেশে। দ্রব্যমূল্য কমবে, বেকার সমস্যার সমাধান হবে, হানাহানি খুনোখুনি দূর হবে, আরও কত কি! উচুঁ-নীচু সব শ্রেণির মানুষ তাদের একরাশ প্রত্যাশা নিয়ে সবাই তাকিয়ে আগামীর দিকে।
পড়াশুনো শিখেও কোন চাকরি না পেয়ে শেষ অবধি নিজের শখটাকেই পেশা হিসাবে নিয়েছে অনিকেত। সে এখন পাড়ার ড্রয়িং টিচার।
এখনকার বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েদের সব বিষয়েই ওস্তাদ বানাতে উৎসাহী। প্রতিদিন বিকালেই তার কাছে জনা দশ-বারো কুচো-কাঁঁচা বা তাদের থেকে একটু বড়োরা আঁকা শিখতে আসে।
সারা দেশ জুড়ে আজ অঘোষিত বনধের আমেজ। তবু আজকের ব্যাচটাকে ছুটি দেয়নি অনিকেত। মাত্র কটা টাকা দিয়ে আঁকা শিখতে আসে সবাই। সপ্তাহে একটা দিন, তাও যদি ছুটি দেয় গার্জেনরা বেশ অসন্তুষ্ট হন। ছাত্রছাত্রীরা তো গৌণ, অভিভাবকরাই আসল লক্ষ্মী!তাঁদের চটাতে চায় না অনিকেত।
বাইরের ঘরটাতে আঁকা শেখায় অনিকেত। দু-একজন করে আসতে শুরু করেছে। বাইরের গেটের সামনে থেকে ছেলেমেয়েদের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে যান গার্জেনরা। অনিকেত আজ ভোটের রেজাল্ট দেখতে ব্যস্ত। অন্যদিন এতক্ষণে বসে পড়ে আঁকা শেখাতে। আজ একটু দেরী হতেই ছেলেমেয়েগুলো কলর-বলর করে একেবারে মাছের বাজার বসিয়ে ফেলেছে। বাধ্য হয়ে টিভি বন্ধ করে উঠে যেতে হয় অনিকেতকে। আজকের ব্যাচের ছেলেমেয়েগুলো একটু বড়ো, ঐ ক্লাস সিক্স-সেভেনে পড়বে। অনিকেত বাইরে থেকে শুনতে পায় ওরাও ভোটের রেজাল্ট নিয়ে আলোচনা করছে। অবাক হয় অনিকেত। এরাও ভোট বোঝে! এই বয়সে অনিকেতরা তো বোধহয় ভোটের 'ভ' টাও বুঝতো না।
হাসতে হাসতেই ঘরে ঢোকে অনিকেত।
---বাব্বা! তোরাও ভোট নিয়ে আলোচনা করছিস্? কি বুঝিস্ তোরা ভোটের?
নীলাঙ্ক ক্লাস সেভেনে পড়ে, বয়সের তুলনায় একটু বেশিই পাকা বলে মনে হয় অনিকেতের। ওর মধ্যে বড়োলোক বাপের বখাটে ছেলেকে দেখ
তে পায় অনিকেত। নীলাঙ্কই জবাব দেয়,
---আজ তো চারদিকে শুধু ভোটেরই রেজাল্টের খবর স্যার। আমাদেরও তো একটু একটু করে সব বুঝে নিতে হবে। আমরাই তো দেশের ভবিষ্যতের নাগরিক।
আচ্ছা স্যার, ইউপির রেজাল্টের লাষ্ট আপডেট কি?
উফ্ ইউপির রেজাল্ট জেনে দেশোদ্ধার করবে যেন! একরাশ বিরক্তি নিয়েই জবাব দেয় অনিকেত,
---জানিনা। তোমরা তো আজ সবাই ভোটের রেজাল্ট নিয়ে আলোচনা করছিলে, আজ তবে তোমরা নিজের মন থেকে এমন একটা ছবি আঁকো যেটার ক্যাপশন হবে "জনগণের রায়"।
সবাই খাতা, পেনসিল, রঙ বের করে আঁকা শুরু করার প্রস্তুতি নিতে লাগল। ঘরের এককোণে বসেছিল পিকলু। পাশের বাড়ির রঞ্জনদার ছেলে। কারও সাথে কথাবার্তা বলে না সেভাবে। নিজের জগতেই যেন বাস করে সবসময়। স্কুলে গিয়েও পড়াশুনো ঠিকভাবে করতে পারেনা। ডাক্তারি পরিভাষায় "অটিস্টিক বেবী"!তার রাইফেল থেকে বুলেট বেরলে, টার্গেট একটা হিট হবেই। বেবী"। তবে পিকলু ছোট থেকেই ছবি আঁকতে ভালোবাসে বলে, ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মতোই রঞ্জনদা মাসদুয়েক হলো অনিকেতের কাছে আঁকা শিখতে পাঠাচ্ছে পিকলুকে।
ছেলেটার আঁকার হাত সত্যিই ভালো।
কিন্তু এইসব ভোট, তার রেজাল্ট এসব কি আর পিকলু বুঝবে! সেই ভেবেই অনিকেত পিকলুকে বলে,
---তুই আজ তোর খুশি মত একটা ছবি আঁক। এই সবাই নিজের মন থেকে আঁকবে। আমি ঠিক একঘন্টা পর খাতা জমা নেব।
যে যার কল্পনা মত ছবি এঁকেছে। কেউ এঁকেছে টিভিতে ভোটের রেজাল্ট, কেউ এঁকেছে ভোটে জিতে বিজয় মিছিল, কেউ ব্যালট বাক্স, কেউ বা তার পছন্দমত দলকে নিয়ে পার্লামেন্টে সভাই বসিয়ে ফেলেছে। পিকলুর খাতাটা নিয়ে অবাক হয়ে যায় অনিকেত। সে ভেবেছিল "জনগণের রায়" কথাটা পিকলু বুঝবে না। অথচ কি অদ্ভুত ভাবে বিষয়টা ভেবেছে ছেলেটা!
জনগণ হাতে হাত মিলিয়ে একটা ভোটের কালি লাগানো হাতকে উঁচুতে তুলে ধরেছে। এমনটা অনিকেত নিজেও ভাবতে পারত না।
এর থেকে সুন্দর ভাবে "জনগণের রায়"কে আর বোধহয় বোঝানো যেত না....