Ananya Podder

Romance Classics Inspirational

4  

Ananya Podder

Romance Classics Inspirational

জাদুকর

জাদুকর

6 mins
342


মাস দুয়েক হয়েছে সোহম হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছে | শরীরে ব্যথা যত না আছে, তার চেয়েও বেশি আছে মনের বেদনা| সেই ঘা টা এখনও দগদগে হয়ে আছে | কয়েক মাস আগেও তার আর তৃণার জীবন কতো সুন্দর ছিল !!


দুই শিল্পী তাদের শিল্পের ভালোবাসার টানে একে অপরের কাছে আসে | সোহম ছিল একজন পেইন্টার | রঙ আর তুলি দিয়ে সে প্রতিটা ক্যানভাসে জাদুর সৃষ্টি করতো | সেই জাদুতেই ধরা পড়েছিল তৃণা | এক বন্ধুর সাথে সোহমের এক্সিবিশনে এসে তৃণা নিঃসংকোচে বলেছিল, " আমি আপনার ছবির প্রেমে পড়ে গেলাম | এ প্রেম থেকে আমার মুক্তি নেই | "


উঠতি পেইন্টার সোহম হেসে বলেছিল, " তাহলে তো এবার অটোগ্রাফও চাইবেন!! "


"না, আজ কিছুই চাইবো না | যেদিন আপনি আপনার কোনো পছন্দের ছবি আমায় উপহার দেবেন, সেদিন সেই ছবিতে আপনার অটোগ্রাফ নেবো | ".... তারপর ডায়েরির পাতা ছিঁড়ে নিজের ফোন নাম্বারটা দিয়ে বলেছিল, " এটা আমার কন্টাক্ট নাম্বার | এরপর যখনই আপনি এক্সিবিশন করবেন, আমায় ডাকবেন প্লিজ | আমি আপনাকে বিরক্ত করবো না | ক্যানভাসে আপনার রকমারি জাদু দেখেই চলে যাব | "


তখন থেকেই শুরু | সোহম আর তৃণার সম্পর্কের ক্যানভাসটাও আরও রঙীন হতে থাকে ভালোবাসার জাদুতে |


তিন বছরের প্রেমের পরে যখন সোহমের কথা বাড়িতে জানায় তৃণা, তখন তৃণার বাবা মা বেঁকে বসেন | একজন শিল্পীর সাথে বিয়ে হবে মেয়ের !! যেখানে বিয়ের পাত্র চাই-পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনে এত ভালো ভালো ছেলের খোঁজ আসছে, সেখানে সামান্য একজন আর্টিস্ট কিছুতেই তৃণার স্বামী হতে পারে না !! যদিও সোহম ছবি আঁকার সাথে সাথে একটা অ্যাড কোম্পানিতেও কাজ করতো |


তৃণা বাবা মায়ের আপত্তিকে আমল দিলো না| সে সোহমের হাত ধরলো | কিন্তু বিপত্তি তখনও তাদের পিছু ছাড়েনি | সোহম-তৃণার বিয়েতে মত দিলেন না সোহমের বাবা মাও | তাঁদের মনেও রাগ এলো | তাঁরা বললেন, " আমাদের ছেলেকে যদি উনারা মেনে না নেন, তাহলে উনাদের মেয়েকেই বা আমরা মানবো কেন?? "


সোহম আর তৃণা কোনো পক্ষের মেনে না নেওয়াকে পাত্তা না দিয়ে সংসার পাতলো | বিয়ের পরে তৃণা যখন হেঁসেলের কাজে আর সংসার সাজানোতে ব্যস্ত ছিল, তখন একদিন হঠাৎ, সোহম মনীশ আর পল্লবীকে নিয়ে এলো | মনীষ এর একটা ব্যান্ড আছে , নাম, " বন্ধু, তোমার সঙ্গে | " এবং ব্যান্ডটা খুব নাম করা |


সোহম মনীষ এর সাথে তৃণার আলাপ করিয়ে দিয়ে বলল, " মনীষ আমার হাফ প্যান্ট বয়সের বন্ধু | একসঙ্গে ফুটবল খেলা দিয়ে শুরু করে, প্রথম সিগারেটে টান, মদের গেলাসে চুমুক আর নীল ছবির প্রথম অভিজ্ঞতা সব একসাথেই ভাগ করেছি আমরা |... মাঝখানে কিছু বছর হারিয়ে গিয়েছিলাম আমরা যে যার পথে| আজ আবার স্প্লানেড মিলিয়ে দিলো আমাদের | "


চা, আর জলখাবারের পরে সোহম বলে, " জানিস, ভাই, তৃণা খুব সুন্দর গান করে | "


সোহমের কথা শুনে মনীষ বলল, " তাই নাকি !! তাহলে তো একটা গান শুনতেই হয় আজ | "


তৃণা একটু লজ্জিত ভাবে বলল, " আজ এতদিন বাদে তোমাদের দেখা হোলো, তোমরা গল্প করো| আমি না হয়, আরেকদিন শোনাবো | "


সোহম বলল, " না, এখনই শোনাবে | তুই কি বলিস মনীষ?? "


" হ্যাঁ, হ্যাঁ, এখনই হয়ে যাক একটা| "


তৃণা আর কোনো বাহানা না করে গান ধরলো, " লাগ্ যা গলে কে ফির ইয়ে হাসিন রাত হো না হো| "


তৃণার ওই পাঁচ মিনিটের গানের মূর্ছনায় ওদের ড্রয়িং রুমটাতে স্বর্গ নেমে এসেছিল যেন |


গান শেষ হলে মনীষ আবেগতাড়িত হয়ে বলে, " এ তো হীরা রে !! কোথায় পেলি এমন হীরা ?? "


" তবে!! কিন্তু কি বলবো রে, ওর ঠাকুমার খুব আপত্তি নাতনির এই গান বাজনায়| তাই কখনো কোনো ফাঙ্কশনে গানই গাইতে দেয়নি ওকে | "


"তুমি গাইবে আমার ব্যান্ডে, তৃণা?? "


"ওকে জিজ্ঞেস করছিস কি !! আমাকে জিজ্ঞেস কর | গাইবে, গাইবে, আলবাত গাইবে | এভাবে একটা প্রতিভা নষ্ট হয়ে যেতে পারে, নাকি !! "


"তাহলে, ওর শুরুতে ভোকাল ট্রেনিংয়ের দরকার | "


"তুই বল কি করতে হবে, ও করবে | একটা প্রতিভা শুধু রান্নাবাটি খেলে জীবন কাটিয়ে দেবে, এটা মেনে নেওয়া যায়, বল?? "


স্বপ্নের পথে চলা সেই শুরু | তৃণার সেই চলার পথে সোহম যোগ্য বন্ধু, যোগ্য সাথী হয়ে পাশে থেকেছে সবসময় | সংসারের বেড়ি ওদের ভালোবাসার বেড়ির কাছে খুব ঠুনকো ছিল | তাই জীবন কেটে যাচ্ছিলো বেশ সুখেই | পরের চার বছর তৃণার আর সোহমের যশ আর সাফল্য পাবার বছর ছিল | ইউ টিউবে ছেয়ে গেল তৃণা, তার সাথে প্রচুর স্টেজ শো, তার উপর ছিল নতুন গানের রেকর্ডিং | এর মধ্যেও সোহমের রঙের জাদু দেখায় কোনো খামতি ছিল না তৃণার | "


কিন্তু জীবন বোধহয় তখনও আরও পরীক্ষা নিতে চেয়েছিল ওদের ভালোবাসার | বাইকে করে বাড়ি ফেরার সময় পিছন থেকে একটা টেম্পো ধাক্কা মারে সোহমের বাইককে | প্রাণে বেঁচে গেলেও সোহমের জাদু কাঠিটা কেড়ে নেন ভগবান |


ছেলে মেয়ের জীবনে এমন দুর্যোগের কথা শুনে ছুটে এসেছিলেন দু জনেরই বাবা মা | কিন্তু সোহম ওই স্বল্প সময়েই তৃণাকে বলেছিল, " যা পারবে, তুমি করবে | কিন্তু যারা আমাদের ত্যাগ দিয়েছেন, তাঁদের করুণায় আমাকে বাঁচিও না যেন | তবে সে জীবন হাজার মৃত্যুর চেয়েও কঠিন হবে| "


তৃণা তার সোহমের ভালোবাসা আর সম্মানের অমর্যাদা করেনি | সে তাদের সঞ্চিত অর্থ দিয়েই সোহমকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে, শুধু ফিরিয়ে আনতে পারেনি সোহমের ডান হাতটাকে |


হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পরে সোহমের মা এসেছিলেন ছেলের কাছে | আদর করে বলেছিলেন, " তোর দেখভালের জন্য তো কাউকে চাই | তোর বউ তো সারাদিন গান নিয়েই মেতে থাকে | তাই আমাকে মাঝে মধ্যে আসতে দে, আমি এসে তোর কিছু কাজ করে দিয়ে যাব | "


মায়ের অভিসন্ধি বুঝে সোহম হেসে বলেছিল, " তুমি কি ভাবছো মা, আমি নিজের কাজ নিজে করতে পারি না?? আমি সব পারি, নিজের কেন, অন্যের কাজও করে দিতে পারি | তোমার যদি কখনো আমাকে দরকার পড়ে, তাহলে বোলো| আমি আছি তোমাদের পাশে | আর তুমি আসলে আসতেই পারো| তবে যেদিন আসবে, একা এসো না, বাবাকে নিয়ে এসো | তৃণা দারুণ দারুণ সব ডিশ বানায়| ফোন করে আসলে তোমরাও সে খাবারের ভাগীদার হবে | "


ছেলের কথায় রেগে গিয়েছিলেন সোহমের মা | রাগে পড়ে বলেছিলেন, " একসিডেন্টে হাতটাকেই খুয়েছিস শুধু, নাকি মেরুদন্ডটাকেও হারিয়েছিস !!  স্বামী দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে বাড়িতে বসে, আর বউ কিনা স্টেজ শো করে বেড়াচ্ছে!! ছিঃ, ছিঃ, লোকে ভাববে কি?? "


" সেটা আমি কি করে জানবো?? লোকের ভাবনাটা আমি ভাবলে লোকের যে আর ভাবার কিছু থাকবে না মা !! আর তৃণা আগেও যেভাবে গান গেয়েছে, আজও সেভাবেই গান গাইবে | আমাদের ভালোবাসার এই সংসারের দুটো চাকার একটা আমি, আরেকটা তৃণা | একটা চাকা সাময়িক বসে গেছে, কিন্তু আরেকটা চাকা ঠিক চালিয়ে নেবে সব, গড়িয়ে গড়িয়ে হলেও | "


মা ছেলের এই কথোপকথন তৃণা না জানলেও জেনেছিলো পল্লবী | এমনিই এসেছিল সেদিন সোহমদের বাড়িতে, সোহমের সাথে আড্ডা দিতে | কিন্তু ওদের দুজনের হৃদয়ের হৃদ্যতার আবেশ টুকু নিয়ে নিঃশব্দে চলে গিয়েছিলো |


এখন আকাশে বাতাসে ভালোবাসা বহমান | ভালোবাসার মাস এটা| ভালোবাসার প্রতি মুহূর্তে সবাই একে অপরকে রাঙিয়ে যাচ্ছে | শুধু তৃনাই নেই আজ সোহমের পাশে | এই সময় প্রচুর স্টেজ শো হয় | তৃণা যে এখন মনীষের ব্যান্ডের লিড সিঙ্গার!!


সবাই যখন সোহমকে করুণা করেছে, তখন তৃণা বলেছে, " সোহম আমি তোমার জাদু ছাড়া বাঁচতে পারবো না | এত ইনকাম করার চেষ্টা করছি এই সংসারটা চালানোর জন্য নয়, আমরা ভালো থাকবো তার জন্যও নয় , তোমাকে কিছু করতে হবে না বলেও নয়, করছি নিজের জন্য, নিজেকে বাঁচাবো বলে| আমি ডক্টর মুখার্জীর সাথে কথা বলেছি| উনি বলেছেন, তোমাকে আর্টিফিশিয়াল হাত লাগিয়ে দিলে তুমি আবার আঁকতে পারবে | তুমি নিজে তোমার জাদু ছাড়া বাঁচতে পারো সোহম, আমি বাঁচতে পারবো না | "


সোহম বিশ্বাস করে তৃণার স্বপ্নকে | অনেকেই পাশ থেকে অনেক কথা বলে, মনের মধ্যে ঘুণ ধরাতে চায় | কিন্তু ভালোবাসাটা যখন ওদের, ভালোবাসার লড়াইটাও না হয়, ওদেরই একান্ত নিজেদের হোক |


এমন সময় হোয়াটস্যাপে একটা ম্যাসেজ আসে, " খুব মিস করছি তোমায় | "


মাঝখানের এই দিনগুলিতে ঘর থেকে সেভাবে না বেরোলেও আজ সোহম উঠে পড়ে | পার্কস্ট্রিট তো এই খানেই | তৃণা তার কাছে থাকতে পারলো না তো কি হোলো, সে তো তৃণার কাছে থাকতেই পারে !! তার জাদু কাঠি না থাকলেও তৃণার জাদুকর যে সে !! এখনও যে অনেক জাদু দেখানো বাকি আছে তার


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance