হটস্পটের ভিখারী
হটস্পটের ভিখারী
আমি শিয়ালদহ রেলস্টেশনে কল্যানী সীমান্তের ট্ৰেনে চেপেছি... মামাবাড়ি যাবো করে... আমার মামাবাড়ি হলো কাঁচড়াপাড়া, কল্যানীতে।
দুপুর বারোটা নাগাদ.... ট্ৰেনে উঠেছি, ট্ৰেনটি বেশ ফাঁকা, প্যাসেঞ্জার নেই বেশি। আমি বিন্দাস জানলার পাশে বসে বাইরের প্ৰাকৃতিক দৃশ্য দেখছি আর পা দোলাচ্ছি...!!
মিনিট দুয়েকের মধ্যে পুঁউউউউউ শব্দ করে হুইসেল বাজিয়ে ট্ৰেনটা ছেড়ে দেয়। হঠাৎ করে, একজন বছর বারোর একটা বাচ্চা ছেলে আমাদের কোচে উঠে এসে হাতে এন্ডরয়েড স্মার্ট ফোন নিয়ে বলে ওঠে,"কেউ দু-মিনিটের জন্য হটস্পট দেবেন... কেউ একটু হটস্পট দিন না... গত দুই দিন হয়ে গেলো, একবারও ফেসবুকে অনলাইন হতে পারিনি। একটু দয়া করে, কেউ হটস্পট ভিক্ষা দিন না... আমার গার্লফ্রেন্ড-টা নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে বোধহয়... আমার সাথে কথা না বলতে পেরে..."
আমার তো নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। এদ্দিন, দুই টাকা, পাঁচটাকার ভিক্ষা চাইতে শুনেছি.... আজ এই প্ৰথম হটস্পট ভিক্ষা করতে দেখলাম.. বাচ্চাটা আমার হাতে ফোন দেখে অত্যন্ত আশারত মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,"দিদি... দাও না, একটু হটস্পট...!! আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে যদি আজ কথা না বলতে পারি আর ও যদি উল্টোপাল্টা কিছু করে বসে...!!"
আমি মারাত্নক ভয় পেয়ে গেলাম... চট করে পার্সোনাল হটস্পট অন করে বাচ্চাটিকে পাসওয়ার্ডও বলে দিলাম। মিনিট পাঁচেক বসে বাচ্চাটা মনের সুখে নিজের প্ৰেমিকার সাথে লাভ-সাবের চ্যাটিং করে থাঙ্কু জানিয়ে চলে যায়।
বাচ্চাটা চলে গেছে.... প্ৰায় দশ মিনিটের বেশি হয়ে গেছে। তবু্ও, আমি এখনো মহা ভাবনায় ডুবে আছি... আজকাল হটস্পট ভিক্ষাও করা যায়, হটস্পটের ভিখারিও হয়...???
এই ঝটকার জাল কেটে বেরোতে না বেরোতে... একজন ফেরিওয়ালারা ওঠে আমাদের কম্পার্টমেন্টে...!! ভাবলাম, কিছু ভালোমন্দ ঝুড়িভাজা, বাদামভাজা, ছোলাভাজা খাওয়া যাবে... না... তা তো হবার নয়..!! ইনি তো হটস্পট বিক্ৰেতা....
বিক্ৰেতা লোকটি নিজের গলায় ওয়াইফাইয়ের তার ভালোভাবে গলায় পেঁচিয়ে রেখে... বুকের পাশে ঝুলিয়ে রেখেছে ওয়াইফাইয়ের মেশিনটা আর হাতে সুইচবোর্ড নিয়ে, মুখে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে,"হটস্পট নেবেন... হটস্পট নেবেন...!! পাঁচ মিনিট ইউজ করবেন দশটাকা...!! এতো ভালো সুযোগ আর পাবেন না... আমি চলে আর পাবেন না...!! পাঁচ মিনিটে যতো খুশি নেট ইউজ করুন কিচ্ছু যায় আসে না... বদলে, দেবেন দশ টাকা। হটস্পট নেবেন... হটস্পট...!! মাত্ৰ দশ টাকায় হাইস্পিড ডেটা, পাঁচ মিনিট ধরে.. বিন্দাস ইউস করুন। পাঁচ মিনিটে যতো ইচ্ছা যতো ইচ্ছা নেট ইউজ করুন, মাত্ৰ দশ টাকা...!!"
আমার পাশের প্যাসেঞ্জার চুপচাপ যে যার কাছে ব্যাস্ত... এরা কি কানে কালা নাকি রে বাবা...!! একটার পর একটা হটস্পট নমুনা ট্ৰেনে উঠছে... কিন্তু, এনাদের এক্সপ্ৰেশনই নেই, মুখে...
মিনিট পনেরোর পর............................
আমি জানলার দিকে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে চিপস খাচ্ছি। আগের ভিমড়ি খাওয়ার মতো ঘটনাগুলো দেখে এখন চিপস হজম করতে বিশাল সমস্যা হচ্ছে। এইবার নতুন সপ্তমাশ্চার্যের উদ্ভব ঘটে... আমাদের কম্পার্টমেন্টে...!!!
একজন বছর কুঁড়ির মেয়ে নিজের Samsung... কোম্পানির স্মার্ট ফোন নিয়ে আসেন আর কাঁদতে কাঁদতে বলে,"কেউ আম
াকে দুই লিটার হটস্পট দেবেন... আমার বয়ফ্রেন্ড আমাকে বলেছে, যদি আমি তার ফেসবুক পোস্টে লাইক, কমেন্ট করে শেয়ার না দিই... আমাকে ছেড়ে দেবে... আমার ব্ৰেকাপ হয়ে যাবে...!!"
একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ বলে ওঠেন,"হ্যাঁ গা.. মা, তোমার কি ইন্টারনেট নেই...??"
মেয়েটি বলে,"দাদু... আজই ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেছে....."
মেয়েটিকে কেঁদে কেঁদে হটস্পট চাইতে দেখে আমার মনে হচ্ছে, ওর শরীরের হয়তো... সব রক্ত শুকিয়ে গেছে, তাই রক্ত কিনতে বার হয়েছে।
মেয়েটির পাশাপাশি আরো একজন যুবক অন্য কম্পার্টমেন্ট থেকে আমাদের কম্পার্টমেন্টে এসে ডায়রেক্ট মেঝেতে ভিমড়ি খেয়েপড়ে দন্ডি কাটার ভঙ্গিতে শুয়ে শুয়ে বলে ওঠে,"আমারে.. কেউ দুই টুকরো হটস্পট দেন না... আমাকে আমার ফ্ৰি ফায়ারের অ্যাকাউন্ট-টা একটু আপডেট দিতে হবে... নয়তো, আমি হিরোইকে উঠতে পারবো না... গোল্ড কয়েন কালেক্ট করতে পারবো না।"
এদের কথাবার্তা শুনে আমার মুখে থাকা চিপস আর গলাধঃকরণ না হয়ে গলার মাঝেই আটকে যায়... ব্যাগ থেকে বোতল বার করে ঢকঢক করে জল খেয়ে কোনোমতো শ্বাসকষ্টে মরার হাত থেকে একটুর জন্য জয় কালী, জয় কালী করে বেঁচে গেছি।
এই দুই মহাপন্ডিত হটস্পট ভিখারির চাওয়াচাওয়ির ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই ব্যারাকপুর স্টেশন থেকে একজন সাদা থান পড়া বিধবা মহিলা ট্ৰেনে উঠে হাউমাউ কেঁদে উঠে বলে,"আমাকে দুই এম.বি হটস্পট দিন না... বড়ো দরকার। অনেক দূর থেকে ছুটে এসেছি। আমার বর মরে গেছে আমি ওর চিতায় যে আগুন জ্বলছে তার ভিডিয়ৈ বানিয়ে রেখেছি রাইট এঙ্গেল দিয়ে এবার সেটা ফেসবুক, টুইটার, সোশ্যাল মিডিয়া, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটস্যাপে স্টোরি, পোস্ট আর স্যাটাস দেবো....!!! আমার কাছে একফোঁটাও নেট নেই.."
মহিলার কথা শুনে চোখগুলো আমার নলেনগুড়ের রসগোল্লার মতো গোল গোল ও বড়ো বড়ো হয়ে যায়.... বৃদ্ধ এক ব্যাক্তি বলেন,"তা মা... তুমি যখন ষ্ট্যাটাসই দেবে.. তাহলে, নেটগুলো শেষ করলে কেন...??"
মহিলাটি কেঁদে বলে,"কি আর বলবো বাবা.... সকাল থেকে রান্নাবান্না, ঘরের কাজ ছেড়ে নিজের ফোনের সব নেট শেষ করে, বরের অ্যাপেল প্ৰো ম্যাক্স ফোনে ইন্সটাগ্রামে রিল আর ইউ টিউবে শর্টস্ দেখছিলাম.... তারপর কখন যে হুঁশ করে তিন জি.বি... নেট শেষ হয়ে গেলো, বুঝলামই না...!! এটা দেখেই তো আমার বর হার্ট অ্যাটাক করে পটল তুললো...."
সে হালকা হেসে বলে,"একদিকে, ভালোই হয়েছে...!! এবার আমি যতো ইচ্ছা রিল বানাবো, কেউ বলার নেই...!!" এই কথা শেষ করে আবার হাউহাউ করে বিশ্ৰীভাবে চেঁচিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,"কেউ দুই এম.পি হটস্পট দেবেন.... একটূ সাহায্য করুন।"
আমি এসব দেখে, শুনে আর নিজের মধ্যে নেই... ধপ করে সেন্স হারিয়ে উল্টে পড়ে যাই নিজের সিটটাতেই।
কিছুক্ষণ বাদে... জ্ঞান ফিরলে দেখি... আমি লোকজন দ্বারা ঘিরে আছি,আমি তাদের দিকে কয়েক সেকেন্ড ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বললাম,"আমাকে একটু দুই থেকে তিনশো এম.বি ধার দেবেন... আমি একটু আমার ব্ৰেনের গুগল ফাইল ম্যানেজারটা ক্লিয়ার করবো। বিশ্বাস করুন সব হটস্পট সুদে-আসলে শোধ দিয়ে দেবো।" মনে মনে ভাবি,"এ কোন আদব হটস্পট ভিখারির দুনিয়ায় এসে পড়লাম রে বাবা...!!"
সমাপ্ত................
.........পর্ণা দেব।