শূন্যতা
শূন্যতা
২৫ শে ডিসেম্বর,
বড়দিন, শীতের রাত, দুজনের দেখা হলো।
২৭ শে ডিসেম্বর,
তাদের মধ্যে অনেকক্ষন কথা হল।
১ লা জানুয়ারি,
Happy new year,
দুজন দুজনকে wish করল। অনেকক্ষন ধরে দুজন একসঙ্গে সময় কাটালো, ঘুরলো, মজা করলো, গরম কফি খেলো।
৩১ শে জানুয়ারি,
ছেলেটি মেয়েটির ফোন নম্বর চেয়ে নিল।
এইভাবেই দুজন দুজনের সাথে প্ৰায় প্ৰতিদিন কথা বলতো।
১২ ই ফেব্ৰুয়ারি,
ছেলেটি মেয়েটির ফোন করে পরশুদিন কফি সপে দেখা করতে বলল। মেয়েটিও রাজি হলো।
১৪ ই ফেব্ৰুয়ারি,
Valentine's day. প্ৰথমে ছেলেটি wish করল, পরে মেয়েটিও wish করল। তারপর নানা কথার পর ছেলেটি বলে বসল- 'I love you' ভালোবাসি তোমায়'।
মেয়েটি লাজুক স্বরে বলল-'এটা বলার জন্য বুঝি আমায় ডেকেছিলে'??
ছেলেটি: হ্যাঁ।
মেয়েটি: তবে আমি যাচ্ছি।
ছেলেটি: আর আমার কথাটার উত্তর?????
মেয়েটি কিছু না বলে মৃদু হেসে এগিয়ে গেল।
২৬ শে ফেব্ৰুয়ারি,
ছেলেটির জন্মদিন,
মেয়েটি একটা গোলাপ গাছ একটা সুন্দর টবে পুঁতে ছেলেটিকে উপহার দিল, সাথে একটা ছোট্ট কার্ড নিজের হাতে বানানো।
ছেলেটি: ফুলগাছ কেন দিলে?? একদিন তো সেই মুষড়ে যাবে। তারপর তো তোমার উপহার ও নষ্ট হয়ে যাবে।
মেয়েটি: জন্মদিন সবসময় এইরকম প্ৰাণবন্ত উপহারই দেওয়া উচিত। তাছাড়া এই গাছটা তো আমি। যেদিন দেখবে গাছটা মারা যাচ্ছে, বুঝবে সেদিন আমিও......!!!!
আর কিছু বলার আগেই ছেলেটি মেয়েটির মুখে হাত রাখে।
ছেলেটি: এইরকম কথা আর কখনো বলবে না।
মেয়েটি: তবে তুমি প্ৰতিদিন আমার খেয়াল রেখো কেমন???
ছেলেটি: তোমার???
মেয়েটি: হ্যাঁ। বললাম যে!! গাছটাই তো আমি।ছেলেটি: আচ্ছা। তবে আমি কোথায়???
মেয়েটি: তুমি?? তুমি তো আমার বাতাস, জল, আলো আর শক্তি।
ছেলেটি: তবে এই গাছে ফোটা ফুটা কে হবে??
মেয়েটি: কে আবার?? আমাদের বাচ্চা...।
দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে উচ্চঃস্বরে হেসে ফেলল।
১২ ই মার্চ,
মেয়েটি শরীর অসুস্থ। বারবার বমি হচ্ছে। মাথা যন্ত্রণা করছে তার। মাথা ঘুরছে।
১৬ ই মার্চ,
ছেলেটি মেয়েটির সাথে দেখা করতে এল তার বাড়িতে। ছেলেটি মেয়েটির হাত ধরে পাশে বসে তাকে জিজ্ঞাসা করে- কি হয়েছে তোমার?? কোথায় কষ্ট হচ্ছে তোমার?? ডাক্তার দেখিয়েছো?? কি বলেছেন তিনি??
মেয়েটি মুচকি হেসে উত্তর দেয়- হ্যাঁ দেখিয়েছি। বিশেষ কিছু নয়। ঔষুধ খাচ্ছি। ঠিক হয়ে যাব আবার। তুমি অত চিন্তা-ভাবনা করো না তো.....।
১৮ ই মার্চ,
সুস্থ হয়ে মেয়েটি ছেলেটির সাথে দেখা করল।
ছেলেটি: ভালো আছো তো এখন???
মেয়েটি: হ্যাঁ,হ্যাঁ। ভালো আছি আমি। আচ্ছা তুমি আমায় ভালোবাসো কেন???
ছেলেটি: কেন আবার??? ভালোবাসি মানে ভালোবাসি। এর কোনো উত্তর হয় নাকি আবার???
মেয়েটি: আমি সুন্দরী তাই? নাকি অন্য কিছু??
ছেলেটি: বললাম যে এর কোনো উত্তর হয় না।
মেয়েটির হাতে হাত রেখে ছেলেটি আবার, বলে- শোনো আমি কিন্তু ২ দিনের মধ্যে তোমার বাড়ি যাব, বিয়ের প্ৰস্তাব নিয়ে।
মেয়েটি লাজুক হেসে বলে- আচ্ছা যেও।
২০ ই মাৰ্চ,
বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। দুই পরিবারই খুশি। ১৪ ই মে ঠিক হয় বিয়ের তারিখ।
৩০ ই মার্চ,
আশীর্বাদ হল, আংটি বদল সবই আনন্দের সঙ্গে সম্পন্ন হলো।
২ রা এপ্ৰিল,
মেহেন্দি, সঙ্গীত-এর অনুষ্ঠানও খুব ভালোভাবে সম্পন্ন হলো।
৩ রা এপ্ৰিল,
প্ৰেসক্রিপশনের সাথে থাকা একটা কাগজের উপর চোখ রেখে মেয়েটি চমকে উঠল। তার বুকের রক্ত ছলকে উঠল। আয়নার দিকে তাকিয়ে মেয়েটি কেঁদে ফেলল উচ্চঃস্বরে।
৪ ই এপ্ৰিল,
ছেলেটির সাথে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা করে মেয়েটি বলল- প্লিজ!! এই বিয়েটা বন্ধ করে দাও। আমি তোমাকে বিয়ে কৱতে পারবো না।
মেয়েটির এমন কথা শুনে ছেলেটির মাথায় বাজ পড়ার মতো অবস্থা।
ছেলেটি শুকনো স্বরে বলে ওঠে- কেন?? তুমি এমন কথা বলছ কেন??
মেয়েটি স্পষ্ট বলে- তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করো। আমি তোমায় বিয়ে করতে পারব না।
ছেলেটি মেয়েটির হাত ধরে বলে- আমি ভালোবাসি তোমায়। তোমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কেন তুমি এসব বলছ???
মেয়েটি: তুমি আমাকে সেদিন বলোনি যে তুমি আমাকে কেন ভালোবাসো??
ছেলেটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে- ওহ্!! এই কারণ। সবসময় যার কথা ভাবি, যাকে সবসময় চোখে দেখি, যার জন্য পাগল তাকে ভালোবাসব না তো কাকে ভালোবাসব শুনি??
মেয়েটি তখন কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে ওঠে- যেদিন যেইসময় তুমি জানতে পারবে আমার Brain tumor হয়েছে, সেদিন সেইসময় আমাকে একইভাবে ভালোবাসবে যেরকমটা আগে বাসতে।
মেয়েটির জলভৰ্তি চোখের দৃষ্টি ছেলেটির আশ্চর্য দৃষ্টিতে গিয়ে মিশেছে। ছেলেটি মেয়েটির হাত আরো শক্ত করে ধরে বলল- আমি তোমাকেই বিয়ে করবো, আর কাউকে নয়।
মেয়েটি: না আমি জেনে শুনে তোমার জীবন বরবাদ করতে পারবো না। তুমি প্লিজ এই বিয়েটা cancel করে দাও।
ছেলেটি: না আমি তোমাকে ভালোবাসি আর তোমাকেই বিয়ে করবো।
মেয়েটি: কিন্তু...!!!
ছেলেটি: আর কোনো কিন্তু নয়, এটাই আমার শেষ কথা।
মেয়েটি: আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না। তুমি কেন বুঝতে চাইছো না????
ছেলেটি: তোমার দেওয়া সেই গোলাপ গাছটাতে জানো, অনেকগুলো ছোট ছোট গোলাপ ফুল ফুটেছে। আর তুমিই তো বলেছিলে ওরা আমাদের সন্তান। তবে তুমি কিভাবে বলছ বিয়েটা ভাঙতে?? আর যতদিন ওই গাছটা সতেজ আছে ততদিন তোমার কিছু হতে পারে না, কারণ ওই গাছটাতো তুমি।
হাত দিয়ে ঈশারা করে গোলাপ গাছটিকে দেখালো। মেয়েটি দেখল মৃদু বাতাসে গোলাপ ফুলগুলো দুলছে। মেয়েটি অন্যমনস্কভাবে বলে- সত্যিই আমাদের সন্তান একদিন জন্মাবে???
ছেলেটি: হ্যাঁ অবশ্যই। আর বিয়েও ধুমধাম করে ভালোভাবে হবে। এবার তুমি এই বিয়েতে রাজি তো???
মেয়েটি: হ্যাঁ। রাজি।
১৪ ই এপ্ৰিল,
ছেলেটি মেয়েটিকে ফোন করে বলে- আমি অফিসের কাজে খালি দিল্লি যাচ্ছি।
মেয়েটি ধীরস্বরে বলে- কবে ফিরবে???
ছেলেটি: ফিরে আসবো খুব তাড়াতাড়ি। বেশিদিন সময় লাগবে না। ২-৩ সপ্তাহ বাদেই চলে আসবো।
মেয়েটি: আচ্ছা। নিজের অযত্ন কোরো না। সাবধানে থেকো। কোনোরকমে অনিয়ম করবে না কিন্তু।
ছেলেটি: না না। করবো না। তুমি কিন্তু নিজের যত্ন নেবে। খাওয়ার আর ঔষুধ সময় মতো খেয়ে নেবে।
২০ ই এপ্ৰিল,
মেয়েটির শরীর অত্যন্ত খারাপ হল। ক্রমাগত রক্ত বমি হতে লাগল। মাথা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে। কান-নাক থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। মাথা ঘুরে অবশেষে মেয়েটি সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গেল। তখনই তাকে হাসপাতালে ভৰ্তি করা হল।
২১ শে এপ্ৰিল,
হাসপাতালে ICU-র বেডে শুয়ে শুয়ে মেয়েটি ছেলেটির কথা ভাবছিল আর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা অশ্ৰু। মেয়েটি ভালোভাবে কথা বলতে পারছিল না। কোনোমতে নার্সের থেকে একটা পেন, কাগজ সংগ্ৰহ করে ছেলেটির জন্য কাঁপাকাঁপা হাতে একটা চিঠি লেখে। তারপরই হঠাৎ মেয়েটির শ্বাসকষ্ট শুরু হল সে বুঝতে পারল যে তার সময় শেষ। মেয়েটির শারীরিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে দেখে নার্স ছুটে এসে তাকে অক্সিজেন মাস্ক পড়াল।
২২ ই এপ্ৰিল,
মেয়েটি মারা গেল। তার বালিশের পাশে থাকা চিঠিটা তার মা খুব যত্ন সহকারে তুলে রাখল ছেলেটির জন্য।
২৪ ই এপ্ৰিল,
মেয়েটির মারা যাওয়ার খবর ছেলেটিকে জানানোর অনেক চেষ্টা করা হল কিন্তু ছেলেটিকে ফোনে পাওয়া গেল না। কখনো not reachable বা কখনো switch off শোনা গেল।
৪ ই মে,
মেয়েটির শ্ৰাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন হলো। মেয়েটির বাড়িতে বিয়ের সানাই বাজার বদলে মৃত্যুর দুন্দুভিনাদ বেজে উঠল।
৬ ই মে,
ছেলেটি ফিরে এল দিল্লি থেকে। ফিরে এসেই মেয়েটির সাথে দেখা করতে তার বাড়িতে গেল। কলিংবেল বাজাতেই মেয়েটির মা দরজা খোলে বিষণ্ণ চেহারায়। ছেলেটিকে দেখে মেয়েটির মা তাকে কিছু না বললেই একটা কাগজ এনে দিল। ছেলেটি কাগজ পড়ে চোখ তুলতেই মেয়েটির মায়ের চোখে জল দেখে থমকে গেল।ছেলেটি বিষ্ময়ের সাথে তাকে জিজ্ঞাসা করে উঠল- ও কোথায় আন্টি?????
মেয়েটির মা: ও তো আর নেই। আমাদের সকলের চোখে ফাঁকি দিয়ে সে তো চলে গেছে।এই বলেই মেয়েটির মা কান্নায় ভেঙে পড়ে। তখনই ছেলেটির চোখে পড়ল ডাইনিং রুমে থাকা মেয়েটির ছবির দিকে। ছবির গলায় একটা সুন্দর রজনীগন্ধার মালা। আর একটা সুন্দর গোলাপফুল তার ছবিটার সামনে রাখা। গোলাপফুলটা দেখে ছেলেটি সেখানে এক মুহুর্তও সেখানে না দাঁড়িয়ে নিজের বাড়ি পৌঁছাল। নিজের রুমে পৌঁছাতেই ছেলেটি দেখল একটা হঠাৎ আসা দমকা ঝোড়ো হাওয়ায় লাল গোলাপের পাপড়িগুলো উড়ে গেল জানালা দিয়ে, সাথে সেই কার্ড ও।
ছেলেটির মা ছেলেটিকে বলল- ও তো চলে গেছে। এবার তোকে তো বাঁচতে হবে নাকি??ছেলেটি তখন তার মাকে বলে- না মা, ও আমাকে ছেড়ে যায়নি। ও আমাকে ছেড়ে যেতে পারে না। শুধু ওর দেহটাই আগুনে জ্বলেপুড়ে চাই হয়ে গেছে। কিন্তু আত্মাটা তো আমার কাছেই তো রয়ে গেছে। আমাদের তো বিয়েই হয়নি তাই হয়তো তাই আমাদের সন্তান, ওই গোলাপফুলগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু আমার কাছে থেকে গেছে.....
ছেলেটির মা: কে???
ছেলেটি: আমার ভালোবাসা.......
এই বলে ছেলেটি গোলাপের টব টাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে অঝরে কাঁদতে লাগল।
আসলে, ওই গোলাপফুল গাছটা ছেলেটি, ওর জীবন আর ফুলগুলো ওর ভালোবাসা, খুশি, সুখ। এই ফুলশূন্য গাছটা প্ৰমাণ করে দিল যে, ছেলেটির জীবনও এখন থেকে ভালোবাসা শূন্য। এরপর থেকে ছেলেটির জীবনও শূন্যতা-র গহীণ অতলে তলিয়ে যাবে।
সমাপ্ত।
লেখনীতে- পর্ণা দেব।

