হারাধন মাস্টারের কেরামতি
হারাধন মাস্টারের কেরামতি
সালটা ছিল ২০২১...…................
পঞ্চতন্ত গ্ৰামের কথা.............................
পরপর দু বছর দেশে দৌঁড়ে বেড়াচ্ছে করোনো। চিন থেকে বিশ্ব ভ্ৰমণে ঘুরতে বেরিয়ে ভারতকে তার এতো ভালো লেগেছে যে, নিজের গাঁয়ে ফেরবার আর নাম করে না, গেড়ে বসেছে এই ভারত মায়ের বেদীতে। শহরের অবস্থা তো তবু্ও ঠিক আছে... কিন্তু, গ্ৰাম তার তো সাংঘাতিক অবস্থা, বেকারত্বের সংখ্যা দিনদিন হাইলেভেলের মাত্ৰায় গিয়ে পৌঁছাচ্ছে। সবাই ভেবেছিল এ তো চিনা মাল.. বেশিদিন টিকবে না.. কিন্তু, কে জানতো... এই মালটাই ঘুরে ফিরে আমাদের দেশেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে টিকে গেল।
এদিকে..............................
পঞ্চতন্ত গ্ৰামের ডাকাবুকো ভয়ানক দস্যু রঘু ডাকাতের অবস্থা শোচনীয়। স্যানেটাইজার আর মাস্ক কেনার ক্ষমতা নেই বলে... কোনো দোকান থেকে রঘু ডাকাতকে কেউ নুন, তেল, চাল, ডাল, সবজি, মাছ, ডিম দিচ্ছে না। এখন আর কেউ রঘু ডাকাতকে ভয় পায় না... তারা তো এখন ভয় পায়, করোনা ডাকাতকে... যে কিনা প্ৰতি মিনি সেকেন্ডে দেশকে লন্ডভন্ড করেই চলছে। হপ্তাবাজির টাকাও কেউ দিচ্ছে না, সবাই ডিসটেন্স মেইটেন করছে... পাছে যদি করোনো এর গা থেকে আমার ট্ৰান্সপার হয়ে আসে সেই ভয়ে।
রঘু ডাকাত বোঝে... এইভাবে আর কতোদিন সিদ্ধ ডালে চালে খেয়ে বাঁচবে, কিছু একটা ফাইনাল ডিসিশন তো তাকে নিতেই হবে। তাই সে তার দলের বাকি তিন সদস্য নেপলা, হোঁদলা আর চপলকে ডেকে পাঠায়। রঘু ডাকাতের দলে কিন্তু, আরো লোক ছিল... তারা সবাই করোনা বাবাজির প্ৰসাদ খেয়ে দলছুট হয়েছে।
সন্ধ্যেবেলায়..............................
রঘু ডাকাতের দোচালা ঘরে, মিটিং বসে... কি হবে না হবে...!! হোঁদলা বলে,"দাদা আমরা যদি বিজিনেস শুরু করি... তাহলে, কেমন হয়...!!"
রঘু মুখ বেঁকিয়ে বলে,"ভিখিরির ছা... তোকে টাকা কে দেবে শুনি...!! এমনিতেই গ্ৰামের লোক এখন আমায় নয়, ওই করোনা ডাকাতকে ভয় পাচ্ছে... ওর জন্য আমাদের কাম ধান্দা সব লাটে উঠছে.. আর ওকে নাকি টাকা দেবে...!! একটা বিজনেস খুলতে কতো টাকা লাগে জানিস.. মুখপোড়া...??"
চপল বলে,"তাহলে, মাঠে চাষ করবে...??"
রঘু,"ধুরররর... ওসব চাষাপুষো আমার দ্বারা হবে না..!! আমি হলাম গিয়ে রঘু ডাকাত। ডাকাতরানী দেবী চৌধুরানী আমার দূরসম্পর্কের পাতানো মাসিদিদার মা...!! তার বংশধর হয়ে আমি এখন ডাকাতি ছেড়ে... চাষ করবো। এতো ধম্মে সইবে না... তাছাড়া, মাঝরাতে যদি ভবানী পাঠক ঠাকুরদাদার ঠাকুরদাদা যদি প্ৰশ্ন করে, কি হে ব্যাটার ছেলে...!! ডাকাতির লাইনে কম্পিটেশন করতে পারলি না বলে, রাতারাতি নিজের লাইনটাই চেঞ্জ করে দিলি..!! তখন আমি তাঁকে কি জবাব দেবো...!!"
চপল মুখ সিঁটকে বলে,"তাহলে আর কি না খেয়েই মরো।"
রঘু,"এমনধারা কাম করিস না চপল, হোঁদলা...!! একটা উপায় বাতলা... তোরাই তো আমার সব আমার আর আছে কে বল...!!"
হোঁদলা তৎক্ষণাৎ বলে,"কেন... ওই যে, তোমার আছে না.... তোমার ভবানী ঠাকুরদাদা আর চৌধুরানী মাসিদিদা...!!"
রঘু মুখ শুকনো করে বলে,"এমনি করে বলিস না... ওরা তো মরে স্বগ্গে গেছে, এবার এভাবে আর কয়টা দিন চলতে থাকে... তবে তো আমিও মরে ওদের কাছে চলে যাবো। তোরা কিছু কর...!!"
নেপলা,"দাদা আমি বলি কি... তুমি কিডন্যাপ করো। ডাকাতির পর কিডন্যাপিং-ই একমাত্ৰ তোমার প্ৰেসটিজ আর ইমেজ অনুযায়ী অকোপেশন।" নেপলা উচ্চমাধ্যমিক পাস... তাই ওদের তুলনায় একটু আধটু বেশি ভালোই বলতে পারে।
নেপলার কথা শুনে রঘু খুশি হয়ে বলে,"হ্যাঁ.. হ্যাঁ..!! নেপলা ভালো বুদ্ধি দিয়েছিস...!! এই চল.. চল। সবাই কাজে লেগে পড়।"
পরদিন সকালে.............................
নেপলা, হোঁদলা আর চপল মিলে পুকুর পাড়ের পাশের আম গাছ থেকে আম পাড়তে থাকা একটা বছর আঠেরোর মেয়েকে হাত, মুখ, হাত, পা, চোখ বেঁধে, তুলে এনে রঘুর সামনে এনে বসায়। হোঁদলা নিজের ফোঁকলা দাঁত বার হাসতে হাসতে বলে,"দেখো... দাদা.. তোমার জন্য কতো সুন্দর একটা মেয়েকে খুঁজে এনেছি। এর জন্য এর বাড়ির লোক নিশ্চয়ই বিশাল দাম দেবে..!!"
চপলও হাসতে হাসতে বলে,"যা বলেছিস... হোঁদলা...!!"
রঘু,"নে.. নে..!! অনেক কথা কয়েছিস... এবার মেয়েটার চাঁদপানা মুখটা দেখা দেখি...!!"
রঘুর কথামতো নেপলা, হোঁদলা, চপল... মেয়েটার হাত, পা বাদ দিয়ে... চোখ, মুখ খুলে দেয়। রঘু খুব আপ্লুত হয় এটা দেখে... যে, তার অকর্মন্য দলের ছেলেরা সত্যিই খুব ভালো দেখতে একটা মেয়ে তুলে এনেছে। মেয়েটা রঘুর দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বলে,"এই মুখপোড়া, হাভাতে... আমাকে তুলে এনেছিস কেন.. হ্যাঁ..!! মুখে নুড়ো জ্বেলে দেবো... শয়তানের দল। আমি আগেই বলে দিচ্ছি.. আমি কিন্তু, হারাধন মাস্টারের মেয়ে... যার তার গলায় আমি মালা দেবো না।"
নেপলা,"কেন লা... তোমার জন্য কি পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে রাজপুত্তুর আসবে..??"
মেয়েটা লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে বলে,"হ্যাঁ তাই তো...!!" তারপর ঝাঁঝিয়ে বলে,"কিন্তু, কোথা থেকে এই হুন্দমুখো, শেয়ালের দলবল আমায় তুলে আনবো। এবার পুকুরের জল থেকে উঠে এসে আমার রাজপুত্তুর আমায় খুঁজে না পায়... তখন আমার কি হবে..?!!" এরপর, মেয়েটি কিছু অদ্ভুত শব্দ যেমন- এএএঁ.. অ্যাঁহহ..." মুখ থেকে বার ন্যাকি কান্না আরম্ভ করলো।
চপল,"এইইইই মেয়ে চুপ করো। এঁহহহ... শখ কতো, রাজপুত্তুর আসবে এই ঘুঁটেকুড়োনির জন্য নাকি...!! এই মেয়ে শোনো, বেশি পেঁয়াজি করবে না বলে দিলাম...!!"
হোঁদলা,"আমরা তোমার বিয়ে দেওয়ার জন্য তুলে আনিনি। আমরা তোমায় কিডন্যাপ করেছি...!!"
মেয়েটি কান্না থামিয়ে জিজ্ঞাসা করে,"কি ন্যাপ...??"
হোঁদলা,"হায়.. হায়... এই মাইয়া তো অশিক্ষিত..!! কিডন্যাপ কইতে পারে না। বলি মেয়ে... আমরা তোমায় অপহরণ করেছি, এবার তোমার বাবার কাছ থেকে টাকা চাইবো। মুক্তিপণ বুঝলে...??"
মেয়েটি হঠাৎ করে হা হা হু হু হো হো করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে... চেয়ারে বসেই বাঁয়ে ডায়ে হিলতে, দুলতে থাকে...!!! রঘু এতোক্ষণ চুপচাপ সব দেখছিল... হঠাৎ করে মেয়েটাকে হাসতে দেখে... মুখ কুঁচকে বলে,"এই মাইয়াডা পাগল নাকি হ্যাঁ...!! কখনো কাঁদে, কখনো হাসে... তোরা শেষে পাগলাগারদ থেকে পালায়ে আসা পাগলি রে তুলে আনলি...!!"
মেয়েটা রঘুর মন্তব্য শুনে গর্জে উঠে বলে,"এইইইই... আটকুড়োর ব্যাটা..!! আমাকে তু্ই পাগলি বললি.... পাগল তু্ই, তোর বাপ, তোর মা, তোর শ্বশুড়, শ্বাশুড়ী, বউ, বাচ্চাকাচ্ছা... তোর নাতি-পুঁতি সব...!! তোর চোদ্দো গুষ্ঠি পাগল... তোর পুরো সাতপুরুষ, জ্ঞ্যাতিগুষ্ঠি, আত্মীয়স্বজন, কুটুম-কুটুম্বি সব পাগল...!!"
মেয়েটার মুখ থেকে নিজের আর নিজের গুষ্ঠির এই অবিরত কম্পপ্লিমেন্ট শুনে রঘুর চোখ ছানাবড়া, সাথে তার থ্ৰি ইডিয়েট সাথীদেরও। রঘু মেয়েটার সামনে হাতজোড় করে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,"থাম... থাম.. আর কিছু কয়িস না..!! আমি আর শুনতে পারুম না...!! দয়া কর, তোর পায়ে পড়ি থাম...!!" মেয়েটা মন্তব্য করতে করতে হাঁফিয়ে ওঠে।
রঘু,"শোনো তোমার নাম আর তোমার বাপের ফোননম্বরটা দাও দিকিনি...!!"
মেয়েটি,"আমার নাম টগরী...!!"
নেপলা ভুল শুনে বলে ওঠে,"অ্যাঁ... টিটকারি...??"
টগরী আবার চিৎকার দিয়ে ওঠে,"এই হারামজাদা... পোড়ারমুখো...!! কানে কালা নাকি লা... আমি টিটাকারি বলেছি, আমি তো টগরী বলেছি।"
নেপলা কাঁচুমাচু মুখ করে বলে,"আচ্ছা আচ্ছা। চিৎকার করতে হবে না অতো। মাই মিস্টেক..!!"
রঘু আদ্যিকালের একটা নোকিয়ার কিপ্যাড ফোন নিয়ে তার রংচটা স্ক্ৰিণের দিকে তাকিয়ে বলে,"ফোন নম্বরটা বলো..."
টগরী,"ফোন নম্বর নিচ্ছো.. নাও। তবে, এক পয়সাও আদায় করতে পারবে কি দশ কিলো সন্দেহ আছে..?!!"
চপল,"কেন... কেন...??"
টগরী,"আসলে... আমার বাবা রাম কিপটে....!! সাবান, শাম্পু, সোনো পাউডার, কিরিম, গন্ধওয়ালা ফুসফুস, নোপপালিস কিচ্ছু আমায় এনে দেয় না... তায়, তোমায় নাকি দেবে মুক্তিপণ...!!"
রঘু,"ও নিয়ে তুমি চিন্তা কোরো না। আমি ঠিক ম্যানাজ করে নেবো... তুমি খালি নম্বর বলো..!! রঘু ডাকাতকে তোমার বাপ হারাধন মাস্টার চেনে না।"
টগরী,"না চিনলে তো আরোই টাকা দেবে না।"
রঘু ধমক দিয়ে বলে ওঠে,"এই মেয়ে তুমি শুধু নম্বর বলো..."
যথারীতি..............................
টগরীর কাছ থেকে ফোন নম্বরটা জেনে রঘু নিজের নড়বড়ে নোকিয়া ফোন দিয়ে কল করে...!! রঘু কথা বললেও ওপাশ থেকে ফোন একজন কথা শোনা যায় না। রঘু 'হ্যালো হ্যালো' করতে থাকে... আর টুক ফোনটাও কেটে যায়। এইরকম ঘটনা দুই থেকে তিনবার হয়...!! টগরী,"চেষ্টা চালিয়ে যাও... আমার বাবার ফোনে... একটু ডিসকাক্ট আছে..!! একবারে ফোন লাগে না।"
নেপলা,"ডিস্টার্ব...?!!"
টগরী,"ওই হলো... একই ব্যাপার..!!" রঘু আবার ফোন লাগায় হারাধন মাস্টারকে।
অন্যদিকে.........................................
হারাধন মাস্টার বারবার ফোনে কথা বলেও কিছু শুনতে পেয়ে নিজের হাফ ডেথ মোবাইলটা বারান্দার খাটিয়ায় রেখে চেঁচিয়ে ওঠে,"গিন্নী... ও গিন্নী...!! আমার জুতো জোড়া কই গো...!! আমি তখন খুঁজছি, পাচ্ছি না...!! বাজার যাবো তো...."
ওনার স্ত্ৰী রানি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে ওনাকে বারান্দার খাটিয়ার তলায় দেখিয়ে বলে,"ওই যে... খাটিয়ার নীচে দেখো... তোমার ছেঁড়া জুতো ঘুমাচ্ছে।"
হারাধন মাস্টার টুক করে সেই খাটিয়ার নীচ থেকে জুতোজোড়া বার করে পায়ে গলিয়ে নিয়ে বলে,"এই শোনো.. একদম আমার জুতোকে আজেবাজে কথা বলবে না বলে দিলাম... এই জুতো আমি আমার প্ৰথম মাইনের টাকা নিয়ে কিনেছিলাম।"
রানি,"হ্যাঁ.. তাই তো..!! তিরিশ বছর পেরিয়ে গেলো.. তবু, ঘরে নতুন জুতো বাড়িতে এলো না। বিয়েবাড়ি থেকে ছেরাদ্দবাড়ি সেই এক জুতো এই বুড়োর...!! আমার বাপ কতোই না সাধ করে আমার নাম দিয়েছিলো রানি.... আর শেষে আমায় তুলে দিলো কিনা, এই কিপটে টেঁকো বুড়োর কাছে।"
হারাধন মাস্টার বলে,"এই শোনো... একদম ফালতু নাকি কান্না কান্দবে না আমার সামনে... আমি এসব মোটে সহ্য করতে পারি না। যদি, আমায় তুমি আর একবার বলো জুতো পাল্টাতে তবে, জুতার সাথে সাথে আমি তোমারেও পাল্টাইয়া দিমু...!!"
রানি গিন্নী ঝাড়ু রণচন্ডী মূর্তি ধারণ করে রাগে চিড়বিড় করতে করতে বলে,"কি বললি.. টেঁকো, বুড়ো ভাম...!! তু্ই বউ পাল্টাবি...?? বাইরে কোনো কচিকাঁচা জুটায়ে আসছোস নাকি...?? আজ তোর একদিন কি আমার একদিন.... তোর বাপ, ঠাকুরদার নাম ভুলায়ে ছাড়ুম আমি..!!"
হারাধন মাস্টার কাঁচুমাচু মুখ করে বলে,"এমন কইরে.. কয়ো না বউ। আমি না তোমারে কতো ভালোবাসি... তোমায় সাতনলি হার দিয়েছি, একটা সতেরো বছরের ধারী মেয়ে দিয়েছি... তুমি চাইলে আরো একটা ছোট্ট ছেলেও দিতে পারি।"
হারাধন মাস্টারের মোন গলানো কথা শুনে রানি গিন্নী ঠান্ডা হয়, শুধু তাইই ছেলের কথা শুনে লজ্জায় নুইয়ে পড়া কন্ঠে বলে,"যাহহহহহ... তুমি খুবই দুষ্টু...!!" এইবলেই একদৌঁড় রানি গিন্নী রান্নাঘরে।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচে হারাধন মাস্টার। দীর্ঘশ্বাস ফেলতে না ফেলতেই তার পুরোনো দরকষা ফোনটা বেজে ওঠে... টুং টুং শব্দে। কল রিসিভ করে কানে ধরে বলে,"হ্যালো... হারাধন মাস্টার ইস্পিকিং...!!"
রানি গিন্নী রান্নাঘর থেকেই বলে,"আঃ মরণ...!! বাংলাতেই কথা কও না। আবার ইনজিরি বলার কি আছে....??"
হারাধন মাস্টার বলে,"না.. না... আমি হলাম গিয়ে মাস্টারমশাই। আমার একটা পেরেসটিজ আছে না..?!" ফোনের ওপাশের লোককে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,"হ্যাঁ... তুমি কে গা..??"
রঘু,"নমস্কার হারাধন মাস্টারমশাই... আমি হলাম গিয়ে পঞ্চতন্ত গ্ৰামের রঘু ডাকাত।"
হারাধন মাস্টার কপাল কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে,"কি কইলে... জগু চাপাত...!! না... না.. আমি এই নামে কাউকে চিনি না।"
রঘু,"না.. না.. আমি রঘু ডাকাত। আমি আপনার মেয়ে টগরীকে কিডন্যাপ করেছি।"
হারাধন মাস্টার খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,"তাই নাকি বাবা.. বেঁচে থাকো, ভালো থাকো, সুস্থ থাকো... সুখে সংসার করো। দশগন্ডা বাচ্চা পয়দা করো.... আর বুড়ো বয়সে নাতি পুঁতিদের সাথে খেলা করে জীবন কাটাও। আমি তোমায় প্ৰাণ ভরে আশীব্বাদ করি।"
রঘু চিৎকার করে ওঠে,"আরে.. কাকু.. আমি আপনার মেয়েকে কিডন্যাপ করেছি।"
হারাধন মাস্টার,"হ্যাঁ আমিও তাই বলছি। সুখে সংসার করো ওর সাথে।" বিড়বিড়িয়ে বলে,"যাক, মা মেয়ের একটা আপদ তো বিদায় হলো। আমার খরচাটা একটু কমলো। নয়তো, সারাদিন... এটা কিনে দাও, ওটা কিনে দাও.. করেই গেলো, মাইয়াডা...!!"
রঘু,"আমি কেন আপনার মেয়ের সাথে সংসার করতে যাবো..!! আমি কি বিয়ে করবো বলে, আপনার মেয়েকে তুলে এনেছি..!! আমি ওকে অপহরণ করে তুলে এনেছি... এবার আপনি মুক্তিপণ দিয়ে নিজের মেয়েকে নিয়ে যান।"
হারাধন মাস্টার মুখ বিকৃত করে বলে,"মুক্তিপণ..." মনে মনে বলে,"এই সেরেছে... এ আবার মুক্তিপণ চাইছে। ওই বেহিসেবি মেয়েকে বাঁচাতে কতো টাকা গচ্চা দিতে হয় কে জানে....!!" প্ৰকাশ্যে বলে,"তা বাবা...;কয় পয়সা নেবে বলো...!! আমার মেলা কাজ আছে... তাড়াতাড়ি এই ঘাপলা মেটাও দেখি।"
রঘু,"বেশি নয়... মাস্টারমশাই, দশ..."
হারাধন মাস্টারমশাই রঘুকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়েই আনন্দে বলে ওঠে,"দশ টাকা...?? তা, বাবা আমি তোমায় দিয়ে দেবো... নো চাপ।"
রঘু,"আরে... মাস্টারমশাই কি বলছেন...!! দশ টাকা দিয়ে কি হবে...!! আমার দশ লাখ টাকা চাই..."
রঘুর কথা বলতে দেরি, হারাধন মাস্টারমশায়ের রাগে চিৎকার করতে দেরি হয়নি,"এই কি বললে তুমি ছোকরা... আমার মেয়ের দাম দশ লাখ টাকা..?? হতচ্ছারা, হতভাগা, হাভাতে.. ছ্যাঁড়া..!!"
রঘু,"মাস্টারমশাই দাম কম বল ফেললাম নাকি...!! আচ্ছা... বাড়িয়ে দিচ্ছি..!! দশ কোটি...!!"
হারাধন মাস্টারমশাই হার্ট অ্যাটাক করতে খালি বাকি রাখে... রঘুর ওপর গাঁখগাঁক করে চেঁচিয়ে ওঠে,"কিহহহ.. কি বললি তু্ই হারামজাদা, শয়তান। দশ কোটি...!! তু্ই জানিস দশের পিছনে কয়টা শূন্য বসালে... দশকোটি হয়...!! আয় তুই আমার পাঠশালায়... কান মুলে তোকে আমি অঙ্ক শেখাবো, তোকে যদি আমি অঙ্কে ফাস্টো না বানাতে পারি... তবে, আমিও পঞ্চতন্ত গ্ৰামের পাঠশালার গণিতের মাস্টারমশাই হারাধন দাস না।"
রঘু,"তবে, আমি এখন কি করবো... আপনি কতো টাকা মুক্তিপণ দেবেন বলুন।"
হারাধন মাস্টার,"উমমমম... সর্বোচ্চ একশো... এর বেশি একটা টাকাও দেবো না।"
রঘু,"কি বলছেন... মাস্টারমশাই..!! একশো টাকা নিয়ে করবো...?? আপনার মেয়ের দাম কমসেকম.. একলাখ তো হবেই।"
হারাধন মাস্টার,"দেখো বাছা...!! যদি তাইই হয়..!! তবে, ওকে রেখে দাও নিজের কাছে... পাঠাবার দরকার নেই এখানে। বিয়ে করে নাও... দরকার হলে, আমি মাসে মাসে তোমায় একশো টাকা করে দেবো। যৌতুক... হ্যাঁ বাবা, রাখি।"
রঘু চেঁচিয়ে বলে ওঠে,"এই নেপলা, হোঁদলা, চপল... বিয়ের ব্যাবস্থা কর। আমি এই মেয়েকেই বিয়ে করবো।"
নেপলা, হোঁদলা আর চপল একসাথে বলে,"কেন দাদা...??"
রঘু,"এর বাপ একশো টাকার বেশি দিতে রাজি হচ্ছে না, বিয়ে করলে মাসে মাসে একশো টাকা দেবো। একশো টাকা নিয়ে পাখি ফুড়ুৎ না করে... পাখিকে খাঁচায় বন্দি করে রাখলে... অন্তত, প্ৰতিমাসে নগদ একশো টাকা মাসোহারা তো পাবো।"
টগরী চেঁচিয়ে বলে,"না... আমি তোমার মতো আনইস্মাট ডাকাতকে বিয়ে করবো না। আমি পারলে.... দড়ি কলসি নিয়ে আমগাছের পাশের পুকুরে ডুবে মরবো।"
রঘু নিজের ডাকাতি করা ছুঁড়ি এনে টগরীকে দেখিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বলে,"আর একবার ফটরফটর করে দেখিস... সিধা গলার নলি কেটে পটলডাঙার টিকিট কেটে বিনা পয়সায় যমের বাড়িতে পাঠিয়ে দেবো গে....." নেপলাদের উদ্দ্যেশ্য করে বলে,"যা রে, তোরা বিয়ের ব্যাবস্থা কর।"
তিনদিন বাদে.................................
হারাধন মাস্টারের বাড়ি মেয়ে আসে দ্বিরাগমন সারতে... কিন্তু, এ কী..!! মেয়ে একা... এতো কস্মিনকালেও ঘটেনি, বাঙালি হিন্দুর রীতি রেওয়াজে। রানি গিন্নী টগরীকে আদর করে জিজ্ঞাসা করে,"মাগো... তুমি একা এলে যে, জামাই কই...!!"
টগরী,"মা তোমার জামাই হাসপাতালে... তার তো প্যাটের ব্যামো হইসে...!!"
হারাধন মাস্টার বলে,"আরে.... তাই নাকি...!! এমন হয়েছে...?? তবে, তো আমায় হাসপাতাল যেতে হয়...!!"
হাসপাতালে.................................
জেনারেল বেডে রঘু ডাকাত শুয়ে শুয়ে আহা উহুহু করছে। হারাধন মাস্টার জামাইয়ের এই হাল দেখে বেদানার্ত স্বরে বলে,"আহারে.... আমার জামাই এ কি কুঅবস্থা...!! কেমনে হলো.. জামাই এসব..!!"
রঘু দুর্বল কন্ঠে বলে,"আর কি বলি... শ্বশুড়বাবা। আমি বড়ো দুঃখী মানুষ...!! আপনার মেয়ে কাল রাতে কি যে, মাছের ঝোল রাঁধলো... আমার লুজ মোসান ছাড়ছে... তারপর আমি খালি কলতলা যাচ্ছি আর আসছি, ঢুকছি আর বেরোচ্ছি...!! গতরের সব জল শেষ... তাই নেপলারা তুলে হাসপাতাল নিয়ে এলো... বিলে ডাক্তার খালি সুঁচ ফুটিয়ে ফুটিয়ে সালাইন দিচ্ছে।"
হারাধন মাস্টার,"বাবা... আমার মেয়ে রাত্ৰে একটু কম দেখে... হয়তো, মাছে জল দিতে গিয়ে ভুল ভিনিগারের বোতল উল্টে দিয়েছে... তাই তোমার এমন হাল...!!"
রঘু উত্তেজিত হয়ে বলে,"কি বললেন আপনি...!! আপনার মেয়ে রাতাকানা..." বিলাপ করে বলে,"হায়..!! হায়...!! আমার কপালে কিনা শেষে এই লেখা ছিল..."
হারাধন মাস্টার নিজের পকেট থেকে একশত টাকা বার করে রঘুর বালিশের তলায় গুঁজে দিয়ে বলে,"এই নাও... জামাইবাবা... তোমার এই মাসের একশো টাকা।"
রঘু,"একশো টাকা নিয়ে আমি কি করবো... আমার তো হাসপাতালে এক হাজারের বেশি টাকার বিল হয়ে গেছে...!!!"
হারাধন মাস্টার,"কেন বাবা... তুমিই বলেছিলে, আমার মেয়ের দাম নাকি কমসেকম এক লাখ টাকা...!! তাহলে, আমি তোমাকে যৌতুক দিলাম... এক লাখ একশো টাকা। এবার তুমি যদি এক লাখ টাকা মূল্যের আমার মেয়েকে ধরে রাখতে পারো... তাহলে, আমি আর কি করতে পারি...!! আজ চলি হ্যাঁ....." যাওয়ার আগে আবারও বলে,"এখন বুঝলে তো তুমি.... কেন মেয়েকে নিতে চাইছিলাম না..!! ও না তো হোমে লাগবে আর যগ্গেও না.... ওর জন্য দশ লাখ কেন দশ হাজার চাওয়াটা গর্হিত আপরাধ।"
হারাধন মাস্টার চলে যেতেই রঘু মুখে শব্দ করে, বিছানায় উঠে বসে হাত পা ছড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। রঘু,'যেমন বাপ তার ঠিক তেমনি মেয়ে।"
নেপলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,"কাইন্দো না.... রঘুদা...!! তোমার ভাগ্যে শেষে এই ছিল...!! রঘু ডাকাতের হাল বেহাল..."
