গুণধর
গুণধর


ঘাড় গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে গুণধর বড়াল | সামনে বসে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে ম্যানেজার বাবু | বেশি চেল্লালে আবার ম্যানেজারের কথা জড়িয়ে আসে | ফলে আদপে ম্যানেজার বাবু যে কি বলছেন, কিছুই মাথায় ঢুকছে না গুণধরের | শুধু চিৎকারটা মাথার মধ্যে হাতুড়ি পেটানোর মতো করে আছড়ে পড়ছে | কানের পাশ দিয়ে সাঁ করে কি একটা যেন বেরিয়ে গেলো | তারপরেই ধুম শব্দ | চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে গুণধর, মেঝে-ময় কাগজ পত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে আছে | ম্যানেজার বাবু ফাইলটা ছুঁড়ে ফেলেছেন | কপাল ভালো অত মোটা পিচবোর্ডের ফাইলটা তার মাথায় লাগেনি |
অল্পের উপর দিয়ে বেঁচে গেলো আজ গুণধর বড়াল |
- ‘হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছেন কি? কাগজপত্র গুছিয়ে তুলে বিদায় হোন আমার সামনে থেকে | এক্ষুনি |’
গুণধর আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ফাইল গুছোতে শুরু করলো | কাজে কি এমন ভুল হলো, যে ম্যানেজার স্যার এতো ক্ষেপে গেলেন ! কিছুই বোধগম্য হয় না গুণধরের |
- ‘কি হলো, যান |’
ম্যানেজার বাবুর কান ফাটানো চিৎকার উপেক্ষা করে গুণধর বলার চেষ্টা করলো,
- স্যার, সইটা তো করলেন না!’
কি যে হলো, ম্যানেজার বাবু একদম পাগলের মতো লাফালাফি কেন শুরু করে দিলেন গুণধর কিছুই বুঝতে পারছে না | গুণধরকে কেবিন থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে শুধু বাকি রাখলেন | বিপদের গন্ধ পেয়ে তালে গোলে কেটে পড়াই ঠিক মনে হলো গুণধরের | কেবিনের বাইরে ভিড় জমে গেছে এতোক্ষণে | আড়চোখে ভিড়ের মধ্যে মুখগুলো এক এক করে দেখলো গুণধর | কান এঁটো করা মিচকে হাসি লেগে আছে মুখে মুখে | ভিড় পেরিয়ে নিজের চেয়ারের দিকে যেতে যেতে ম্যানেজারের হুঙ্কার শুনলেন, ‘ যত সব অকর্মণ্য অপদার্থদের নিয়ে কাজ কারবার | বক্সী একবার এদিকে আসুন তো !’ গুণধরের মাথাটা আরো নিচু হয়ে গেলো | কোনদিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারলো, আশেপাশের মুখগুলোতে এবারে দাঁত বের করা হাসি ফুটেছে | ঠিক যেমন খাঁচার বাঁদরের কেরামতি দেখে সবাই হাসে |
চেয়ারে এসে বসে ঢকঢক করে খানিক জল খেলেন আগে | আজ সারাদিন তিনি সকলের খোরাক | সকলেই তার টেবিলের পাশ দিয়ে কারণে অকারণে বারবার আসবে যাবে, দুচারটে আলগা মন্তব্য ছুঁড়ে দেবে, মিচকি মিচকি হাসবে, কেউ আবার সহানুভুতি নিয়ে দুটো কথা বলার অছিলায় আবার ছুঁচ ফুটিয়ে দিয়ে যাবে | পুরো দুনিয়াটাই আঙুল নেড়ে নেড়ে বুঝিয়ে দেয় গুণধরকে সে কতটা অকর্মণ্য | জলের বোতল নামিয়ে রাখতে রাখতেই দেখে টেবিলের সামনে বক্সী এসে দাঁড়িয়েছে |
- ‘ফাইলটা দাও বড়াল |’
- ‘কোন ফাইল?’
গুণধর থতমত খেয়ে তাকায় বক্সীর দিকে | বক্সীর কোনো ফাইল তো ওর টেবিলে নেই |
- ‘যেটা স্যারের ঘর থেকে নিয়ে বেরিয়ে এলে |’
বাক্যব্যয় না করে গুণধর ঠেলে দিলো ফাইলটা বক্সীর দিকে | আরো একটা কাজের ভার নেমে গেলো মাথা থেকে | বক্সী গলা নামালো ..
- ‘দুপুরে ক্যান্টিনে বসবো বড়াল | তুমি চলে যেও না ভায়া | কথা আছে কিছু |’
গুণধর সাড়া দেয় না কোনো | কি আর নতুন করে বলবে বক্সী | মিষ্টি কথায় ছুরি মারবে বড়জোর | আগে বড় ব্যথা পেতেন গুণধর | অপমানে মাথা নিচু হয়ে থাকতো সর্বক্ষণ | বুকের মধ্যে অম্বলের মতো জ্বালা ধরা অনুভুতি চিপকে থাকতো সারাক্ষণ | এখন আর গায়ে লাগে না কিছু | সইতে সইতে চামড়াটা বোধহয় গন্ডারেরই হয়ে গেছে | সরকারী চাকরির মেয়াদ তো ফুরিয়েই এলো একপ্রকার | রিটায়ারমেন্টের আর বছর তিনেক | এতো বছর এতো জ্বালা অপমান যখন সয়ে আসতে পেরেছেন, বাকি দিনগুলোও যেমন তেমন কেটে যাবে | বেসরকারী চাকরি হলে বুঝি এতদিনে হাতে বাটি নিয়ে রাস্তায় বসতে হতো | সরকারী বলেই টিকে গেছে কোনমতে | গুণধরের যেমন কামাই নেই, তেমন কাজও নেই কোনো | কেউই আর ভরসা করে কোনো কাজের ভার চাপায় না তার উপরে | আর কাজই বা আর তেমন কি ! শুধু তো কলম পেষা | কেরানীর আর কিছু থাকুক আর না থাকুক, কলমখানা আছেই | যে কাজই ধরে গুণধর, সবেতেই ভুল ছাড়া ঠিক কিছু খুঁজে পায় না কেউ | অতএব, একে একে সব মোহ মায়া ফাইলের বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে গুণধর | উন্নতিও নেই, অবনতিও নেই | মাসান্তে টাকা কটা পকেটে এলে সারা মাসের জন্য কিছু নিশ্চিন্ততা থাকে শুধু | জীবনের প্রাপ্তির ঝুলিতে এই টুকুই সঞ্চয় মাত্র |
শরীরটা ভারী ম্যাজম্যাজ করছে | বিকালে একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে পরে আপিস থেকে গুণধর | দুপুরে ক্যান্টিনে যায়নি সে আর | ইচ্ছা করেনি বক্সীর মুখোমুখি হতে | হয় ফাইলের ভুল ত্রূটি নিয়ে খানিক আলোচনা করতো, নয় ম্যানেজারবাবু কত ভরসা করে বক্সীকে সেই কিস্যাই শোনাতো | এ আর নতুন কি ! গুণধরের মনে হিংসা, রাগ, কিছুই যে নেই এ কথা সবার জানা | শত অপমান গিলে নিতে জানে গুণধর | কিন্তু আজ অবধি রাগতে কেউ দেখেনি তাকে |
বাসস্ট্যান্ডে এসে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে সে | যাওয়ার জায়গা বলতে তো ওই বাড়ি | এর বাইরে কোথায়ই বা যাবেন ! আত্মীয় স্বজন বলতেও তেমন কেউ নেই | থাকার মধ্যে একটা গুছোনো সংসার ছিলো, এখন তো সবই অতীত | নির্মলা আছে বাড়িতে | মেজাজ তার সর্বদাই সপ্তমে | অপদার্থ স্বামীকে নিয়ে তার আফসোসের সীমা পরিসীমা নেই | দিবারাত্র উঠতে বসতে গুণধরকে গালিগালাজ না করলে নির্মলার খিদে ঘুম হয় না | গুণধর কোনো কাজ করতে পারে না ঠিক করে | লেখাপড়াতেও চিরকাল সাধারণ ছিলো, পড়াশোনাও ঘষে ঘষে ওই বি.এ পাশ | সরকারী চাকরি পাওয়া আজকের মতো তখন এতো কঠিনও ছিলো না | বাপ কাকা একে তাকে হাতে পায়ে ধরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো কাজে | কটা টাকাই বা পেতো তখন সে ! তবে হ্যাঁ, চলে যেতো ঠিক ঠাক | ভাত কাপড়ের অভাব হয়নি কোনদিন | সেই গাড়ি আজও চলছে ঘষটে ঘষটে | বাবা বিয়ে দিলেন সুলক্ষণা কণ্যা দেখে | নির্মলা ঘরে এলো | প্রথম প্রথম বেশ শান্ত নির্বিবাদী মেয়ে ছিলো নির্মলা | সারাদিনের পরে হাসি মুখে নির্মলার সাথে গল্প করতে ভারী ভালো লাগতো গুণধরের | গোবেচারা নিরীহ বরটার যত্নআত্তিও করতো নির্মলা | কিন্তু ওই যে, কপাল! সময়ের সাথে সাথে সবই বদলে যায় | শুধু বদলায় না কপাল | কত ডাক্তার কত বদ্যি কত দোর ধরা, কিছুতেই কিছু হলো না | নির্মলার কোল জুড়ে কেউ এলোই না কোনদিন | নির্মলা বদলাতে থাকলো, দুষতে থাকলো গুণধরকে, গুণধর আড়াল খুঁজতে খুঁজতে ক্রমে ক্রমে দেওয়াল দরজা জানলা মেঝের সাথে মিশে যেতে থাকলো | শুধু আজও নির্মলার ওই একটা কথা কি করে যেন নিরীহ গুণধরের রক্তে আগুণ জ্বালিয়ে দেয় | অনর্গল ধোঁয়া আর জ্বালাপোড়া নিয়ে দগ্ধাতে থাকে অহরহ ভেতরে ভেতরে |
- ‘তুমি পুরুষ মানুষ তো! ওই একটা যন্ত্র থাকলেই পুরুষ হওয়া যায় না গো | ওটার কর্মক্ষমতা থাকাও চাই | বুঝলে? জেনে এসো ডাক্তারের কাছে, আদৌ পুরুষ তো তুমি?’
একবার, শুধু একবার ছুঁড়ে দিয়েছিলো শব্দগুলো নির্মলা | সব আশাতে তখন জল ঢেলে দিয়েছে ডাক্তারের দল | ক্ষমতাহীন স্বামীর ঔরসে সন্তান আসে না যে ! আর নির্মলার মতো সতী-সাধ্বী রমনী যে অন্য পথ অবলম্বন করবে না, সেতো সবাই জানে | চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক উন্নত | হয়তো চাইলে একটা ব্যবস্থা হলেও হতে পারতো | কিন্তু গুণধরের সে সামর্থ্য কই? ভগবান মেরেছেন যখন, সব দিক দিয়েই মেরে রেখে দিয়েছেন | শুধু দিয়ে রেখেছেন কোমলকান্তি রূপ ক্ষতিপূরণ হিসাবে |
বাস স্ট্যান্ড থেকে উল্টো দিকে হাঁটতে থাকে গুণধর | আগে ভাগে বাড়ি গিয়ে লোকসান বই লাভ কিছু নেই | এমনিতেই খোরাক কিছু কম হননি আজ আপিসে | বাড়ি গিয়ে এই মুহুর্তে গিন্নির রণংদেহী মূর্তি আর মুখের অশ্রাব্য ভাষা শোনার ইচ্ছা নেই | উদ্দেশ্যহীন ভাবে চলতে চলতে যদি কোনো গন্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়, মন্দ কি?
- ‘কই গো বাবু? এদিকে নতুন নাকি?’
চিকন গলা শুনে ফিরে তাকায় গুণধর | চোখে মুখে রং মেখে একটা ছাপা কাপড়ের আঁটোসাটো জামা পরে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে | গুণধরের ধন্দ লেগে গেলো | তাকেই বলছে নাকি মেয়েটা? মেয়েটা তো তার দিকেই তাকিয়ে আছে |
- ‘আমাকে বলছেন?’
- ‘ওমা! বাবু দেখি আপনি আজ্ঞা করছে | তোমাকেই বলছি গো | এই পাড়ায় আগে দেখিনি কোনদিন |’
- ‘কোন পাড়া এটা?’
- ‘ওগো, তুমি পথ ভুলে এসেছো নাকি গো? তুমি ত
াহলে পথ ভোলা পথিক আমার |’
গুণধর ভেবে পায় না কি বলবে | পথ তার কোনদিন ছিলো কিনা আদৌ, তাই সে জানে না | তার আবার মনে রাখা আর ভোলা ! মেয়েটা খপ করে হাতটা ধরে গুণধরের |
- ‘এসো বাবু |’
- ‘কোথায় যাবো?’
- ‘হাড়িকাটা গলিতে এসে এমনধারা প্রশ্ন কেউ করে নাকি? আমার ঘরে এসো | অতিথি সেবা করি | অতিথি নারায়ণ বলে কথা !’
গুণধর এতক্ষণে বুঝে গেছে, তালেগোলে সে কোন খপ্পরে এসে পরেছে | ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে, গলা শুকিয়ে গেছে | মেয়েটা শক্ত করে হাতটা ধরে টানছে | কি করবে ভেবে পায় না গুণধর | ঘামতে ঘামতে মেয়েটার পিছু নেয় সে |
একটা ছোট্ট মতো টিনের চাল দেওয়া ইঁটের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় মেয়েটা | রঙচটা পর্দা সরিয়ে ঘরের মধ্যে আদর করে ডাকে গুণধরকে | গুণধরের মাথা কাজ করে না | বাক্যব্যয় না করে পায়ে পায়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে গুণধর | একটা ছোট ঘর | ঘর জুড়ে একটা বিছানা | আধা বন্ধ একটা জানলার পাশে একটা টেবিল রাখা আছে | তার উপরেই মেয়েটার সংসার জুড়ে আছে | জলের বোতল গ্লাস পাউডার লিপস্টিক আয়না কি নেই সেখানে ! এমনকি, সিনেমার ম্যাগাজিনও আছে একটা | ঘরের অন্য কোনে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত বরাবর একটা দড়ি ঝুলছে | তাতে হরেক কিসিমের জামাকাপড় | গুণধরের চোখ চলে গেলো একটা লাল রঙের লেসের কাজ করা ব্রেসিয়ারের উপরে | সস্তা চটকদার জিনিস, সে দেখলেই মালুম হয় | গুণধর মুখ নামিয়ে নেয় | শরীর জুড়ে একটা অস্বস্তি ঘোরাফেরা করতে থাকে তার |
- ‘এমন লাজুক বাবু দেখিনি বাপু কখনো | কি নাম গো বাবু তোমার?’
- ‘গুণধর বড়াল |’
খিল খিল করে হেসে গড়িয়ে পরে মেয়েটা |
- ‘গুণধর ! বাব্বা, কি বাহারি নাম গো | গুণ টুন আছে তো, নাকি পুরোটাই বেগুন গো বাবু?’
দপ করে জ্বলে ওঠে ভেতরটা গুণধরের | বাইরে থেকে আপাত শান্ত চেহারাটা দেখে কিছুই বোঝা যায় না | মেয়েটা হাসতে থাকে খিলখিলিয়ে | গুণধরের ভেতরে দাবানলের আছাড়ি পিছাড়ি চলতে থাকে বীর বিক্রমে |
- ‘ না আমার গুণ নেই | আমি নিস্ফল | আমাকে দিয়ে তোমার কোনো কাজ হবে না মেয়ে | আমাকে যেতে দাও |’
- ‘ওমা গো ! এতো নরম সরম মাখন মাখন চেহারা তোমার | কাজের নও? মাকাল ফল নাকি গো? দেখি তো, তোমাকে দিয়ে কাজ হয় কিনা আমার !’
গুণধর উঠে দাঁড়ায় | ভয়ডর সব কেটে গেছে তার | এখানে বসে সময় নষ্ট করার মানে নেই কোনো | মেয়েটি যে আশায় আছে, সে আশা তো মিটবেই না, উপরন্তু মেয়েটার চোখে সেই তাকে এক দলা ঘেন্না দেখতে হবে | নির্মলার চোখের ঘেন্না গা সওয়া হয়ে গেছে | অন্য কারোর ঘেন্না আর সইবে না তার |
- ‘ যেও না বাবু | গতকালও কোনো খদ্দের পাইনি | এইভাবে আমার কেমন করে চলবে বলো | গতর খেটেই তো পয়সা কামাই | পরখ করে দেখো, খুব খারাপ জিনিসপত্র নেই আমার !"
গুণধরের গা ঘিনঘিন করতে থাকে | চূড়ান্ত অসফল মানুষ হতে পারে সে, কিন্তু অসৎ নয়, দুশ্চরিত্র নয় সে | এই টুকু চারিত্রিক দৃঢ়তা আছে তার | মেয়েটা পথ রুখে দাঁড়ায় তার | গুণধর পিছিয়ে যায় |
- ‘আমাকে না ছুঁতে চাও, না ছোঁবে | কিন্তু বসে যাও বাবু | বউনির সময়ে এভাবে ঘর থেকে বাবু বেরিয়ে গেলে আমার ব্যবসা আজকের মতো লাটে উঠবে | এই লাইনে বড় কম্পিটিশন গো বাবু |’
- ‘আমি এখানে বসে কি করবো?’
- ‘মাল খাবে? আমার কাছে ভালো মাল আছে গো | এক বাবু রেখে গেছিলো |’
গুণধর ভাবতে থাকে, মাল? মদ খাবে? জীবনে কোনদিন কোনো নেশা করেনি সে | এতে কি তার চরিত্র হনন হবে? চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবে গুণধর | তারপর বসেই পরে মেয়েটার বিছানার উপরে | মদ খেলে যদি তার সমাজের চোখে তার চরিত্র বয়ে যায় কিছুটা, তবে যাক | নিজের চোখে অন্তত নোংরা বোধ করবে না কখনো |
নিপুন হাতে ঢেলে দেয় মেয়েটি তরল পানীয় | গ্লাস হাতে নিয়ে রঙিন পানীয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে গুণধর | মনে মনে বলে, ‘চিয়ার্স তরল গরল | আমার জীবনে স্বাগতম |’
সময় যে কিভাবে বয়ে যায়, কিছুই টের পাওয়া যায় না | ঝিম ধরা ভাব ক্রমে ক্রমে মাথার ভিতরে রঙিন নেশার আস্তরণ ছড়িয়ে দিতে থাকে | রাত বাড়তে থাকে | নেশা হলেও গুণধরের জ্ঞান টনটনে | তাকে ফিরতে হবে | না চাইলেও তাকে ফিরতে হবে নির্মলার কাছে | পকেট হাতড়ে যা কিছু পেলেন, তার কিছু তুলে দিলেন মেয়েটির হাতে | হয়তো মেয়েটির পোষালো, কিংবা পোষালো না | কিন্তু গুণধরের এই টুকুই যে ক্ষমতা |
কিভাবে বাড়ি পৌঁছালো গুণধর জানে না | রাত যে অনেক গড়িয়েছে, সেটা টের পেতে তাকে ঘড়ি দেখতে হলো না | শুনশান পাড়ার নিস্তব্ধতা নিমেষেই খানখান হলো নির্মলার তীক্ষ্ণ চিৎকারে |
- ‘ বাহ বাহ, গুণের তো ঘাট নেই দেখছি গুণধরের | রাত পেরিয়ে বাড়ি ফিরলো বাড়ির পুরুষ মানুষ নেশা করে | কোন মুলুক থেকে এলে তুমি? সেখানেই থেকে গেলে না কেন রাতে? কেন এলে মাঝরাতে আমার মুখ পোড়াতে? ছি: ছি:, কোনো কম্মেরই তো নও | থাকার মধ্যে ছিলো একটা চরিত্র | সেটাও খুইয়ে এলে? মদ ছুঁলে তুমি শেষ অবধি? বেশ্যাবাড়ি সময় কাটিয়ে এলে?’
জামার কলার ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে বাড়ির ভিতরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নির্মলা গুণধরকে | গুণধরের শরীর থেকে মদের গন্ধের সাথে সস্তা সেন্টের গন্ধে গা গুলিয়ে উঠছে নির্মলার | বাড়ির সামনে লোক জড়ো হচ্ছে একে একে | এ পাড়ার সবাই জানে গুণধর সাত চড়ে রা কাড়ে না | নির্মলা কেন, অন্য কেউ এসে দুচার কথা শুনিয়ে তাকে দু চার ঘা দিয়ে গেলেও গুণধর চুপ করে থাকবে | ভিড়ের ভেতর থেকে কানে আসে গুণধরের নানান কন্ঠস্বর; ‘আহা রে’/‘বৌটা দজ্জাল একেবারে’/’মদ খেয়ে বাড়ি ঢুকলে ওরকমই করা উচিত’/ ‘লোকটা সারাজীবন পরে পরে মার খেয়ে গেলো’/ ‘ধুর, ওটা পুরুষ মানুষ নাকি? বউ কলার ধরে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছে সেটাও দেখতে হলো | কালে কালে আর কি দেখবো বাবা!’
........পুরুষ মানুষ নাকি? গুণধর তুমি পুরুষ মানুষ তো? তোমার ওই যন্ত্রটার আদৌ কোনো কর্মক্ষমতা আছে তো? গুণধর.. বলি গুণধর শুনছো? তুমি কি মাকাল ফল গুণধর? ...........
বাজছে , কানের কাছে বেজেই চলেছে.. কাঁসর ঘন্টার মতো বেজেই চলেছে সমানে | তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে ছড়িয়ে পরছে কাঁসর ঘন্টা |
....... পুরুষ নাকি ? তুমি আদপে পুরুষ তো গুণধর?...........
ছিটকে পরে নির্মলা | অমন জোরে তাকে কেউ ঝটকা দিতে পারে, এ তার জ্ঞানের বাইরে | পর মুহুর্তেই যন্ত্রনায় কোঁ কোঁ করতে থাকে, গুণধর সর্ব শক্তি দিয়ে নির্মলার গলা চেপে ধরেছে | যেভাবেই হোক, কানের কাছে বেজে চলা ওই কাঁসর ঘন্টাটা বন্ধ করতেই হবে | নির্মলার চোখদুটো ঠেলে বেরিয়ে আসছে, মুখ দিয়ে ফেনা উঠে আসছে | গুণধর আরো জোরে চেপে ধরছে নির্মলার গলা | সব জ্বালার আজকেই পরিসমাপ্তি হয়ে যাক |
পাড়ার লোক এগিয়ে না এলে নির্মলা যে ফটো হয়ে যেতো, এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই কারুর | রাত টুকু কেটে যেতেই সমস্ত পাড়া আবার কর্মমুখর | মাঝে মাঝে চুটকির মতো গুণধরের নতুন গুণের আলাপ আলোচনা চায়ের দোকানে, পাড়ার মোড়ে | এতো দুদিনের গল্প | মানুষের ভুলতে তেমন সময় লাগে না | সব কিছু আবার আগের মতই চলতে থাকে, যেন কোনদিন কিছু ঘটেইনি |
শুধু মস্ত বদল এসেছে গুণধর নির্মলার সংসারে | নির্মলাকে কেউ আর চিৎকার করতে দেখেনি গুণধরের উপরে | নিজের বিয়ে করা বৌয়ের এমন শান্ত কোমল রূপ দেখে গুণধর নিজেই অবাক হয়ে যায় | নির্মলা এখন বিকেল হলেই গা ধুয়ে পাটভাঙ্গা শাড়ি পরে মাথা আঁচড়ে, টিপ পরে অপেক্ষা করে গুণধরের জন্য | নির্গুণ স্বামী সে মেনে নিতে পারে, কিন্তু অন্য মেয়েছেলের গন্ধ বয়ে বাড়ি ফিরবে তার স্বামী এ মেনে নেওয়া বড় কষ্টের যে ! গুণধর আপিস থেকে ফিরলে দুজনে মিলে চা মুড়ি খায় , খানিক সুখ দু:খের গল্প করে | কত কথা যে জমা হয়ে ছিলো বুকের ভেতরে, এতদিনে টের পায় গুণধর |
মাঝে মাঝে ভাবে গুণধর, একদিন ওই টিনের চালার বাড়িতে গিয়ে মেয়েটাকে একটা ধন্যবাদ দিতে আসতে হবে | জীবনটা এখন আর অত অসহ্য লাগে না | শুধু আপিসের ম্যানেজার বাবুর গলাটা যদি একদিন............ |