Saswati Choudhury

Romance Tragedy

2  

Saswati Choudhury

Romance Tragedy

ভালোবাসার রঙ - বেরঙ

ভালোবাসার রঙ - বেরঙ

14 mins
952



১..


মাথা নিচু করে বেরিয়ে যাচ্ছে কুহেলী অফিস থেকে | কাঁধের ব্যাগটা চামড়া কেটে বসে যাচ্ছে | হাতের কার্টুন বক্সের ওজনটাও কম নয় | ওজনের ভারে বেঁকে যাচ্ছে সে | আসলে হয়তো বেঁকে যাচ্ছে অপমান লজ্জা ধিক্কারের ওজনে | তার পাশে জাগতিক সবকিছুর ওজনই যে ভীষণ তুচ্ছ |

রাস্তার মোড় পেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডের ছাউনিতে এসে দাঁড়ায় কুহেলী | ভর দুপুরে বাস স্ট্যান্ড খালি | এমনিতে জায়গাটা শান্তই থাকে | অফিস টাইমে সকালে বিকালে সরগরম হয়ে ওঠে শুধু | আসে পাশের খাবারের গুমটিগুলোও ছাউনি ফেলা | লাঞ্চ টাইম কিছুক্ষণ আগেই ওভার হয়ে গেছে | দোকানগুলোতে তাই সেই ভাবে আর ভিড় নজরে আসছে না | দু চারজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে নিজের খেয়ালে | যেটুকু লোক সমাগম, সেটুকুও চা সিগারেটের দোকানের সামনে | বেশিরভাগই স্থানীয় মানুষ | বাস স্ট্যান্ডের সাজানো চেয়ারগুলো খালি | কয়েকটা মাছি ভনভন করছে | একটা চেয়ারে কার্টুন বক্সটা রাখলো কুহেলি | কাঁধের ব্যাগটাও নামিয়ে রেখে অন্য একটি চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো | পেটে কিছু পরেনি সকাল থেকে | গত কয়েকদিন অফিসে আসেনি সে | সারাদিন বাড়িতে নিজেকে অন্ধকারে বন্দী করে রেখে দিয়েছিলো | কি যে খেয়েছে, কখন ঘুমিয়েছে, সে হিসাব বুঝি নিজেও রাখতে পারেনি কুহেলী | অন্ধকারে শান্তি পাওয়া যায় | আবার এই অন্ধকারই যখন গিলে খেতে আসে, তখন বাঁচার রাস্তা খুঁজে পেতে মরিয়া হয়ে আলোর সন্ধানেই নামতে হয় | তাই এসেছিলো কুহেলী অফিসে | একা একা নিজের সাথে লড়াই করার ক্ষমতা আর ছিলো না ওর | অনাথ হওয়ার জ্বালা অনেক | বোঝার বয়স শুরু হওয়ার আগে থেকেই লড়াই শুরু হয়ে যায় | কুহেলি সেই ব্যতিক্রমী অভাগাদেরই একজন | অনাথ ট্যাগ লাইনটা চিপকে থেকে গেলো সারাজীবনের মতই | আত্মীয় স্বজন দয়াপরবশ হয়ে কোনো এক অনাথ আশ্রমে দিয়ে এসেছিলো | তাই আর পাঁচজনের সাথে আঁচড়ে কামড়ে খেয়োখেয়ি করে বড় হয়েছে | কেড়ে খেতে শিখেছে, দেওয়া নেওয়ার বিনিময় প্রথাটি ভালভাবেই আয়ত্তে এসেছে তার | লেখাপড়ায় মাথাটা পরিস্কার ছিলো, ভগবানের দেওয়া এইটাই একমাত্র পজিটিভ পয়েন্ট বলে মনে করে কুহেলি | তাই একটার পর একটা ডিঙ্গি অতিক্রম করতে সমস্যা হয়নি মোটেও | স্কলারশিপ হোক আর দান খয়রাত; তাই সম্বল করে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী জোটাতে পেরেছিলো সরকারী কলেজ থেকে | নাহলে কুহেলীর মতো সাধারণ অনাথ একটা মেয়ের তো রাস্তায় ভিক্ষা করে অথবা কারুর বাড়ি ঝি-গিরি করে খাওয়ার কথা ছিলো | বদলে এমন ঝাঁ চকচকে অফিসে বসে কাজ করার কথা ভাবনাতেই আসার কথা নয় | কিন্তু কুহেলি পেরেছে | অসম্ভবকে সম্ভব করতে পেরেছে কুহেলি | 


এই ঝাঁ চকচকে অফিস, গ্ল্যামারই বা রইলো কই আর | নিজের দিকে ভালো করে চেয়ে দেখে কুহেলি | রাস্তাতেই বসে আছে সে | ‘রাস্তার মেয়ে’ এই কথাটা বলেছিলো না আত্রেয়ী ! রাস্তার মেয়ে, হ্যাঁ সে রাস্তার মেয়ে | নিজের জায়গাটা চিনতে এতো দেরী হলো কুহেলীর ! আত্রেয়ী আঙুল তুলে দেখিয়ে না দিলে কি সত্যিই নিজের স্বরূপটা আয়নায় দেখা হয়ে উঠতো না? মাথাটা দুহাতে চেপে ধরে কুহেলী | কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরোচ্ছে | চোখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা গরম জল ঝরে মিশে যাচ্ছে রাস্তার ধুলোয় মুহূর্তের মধ্যেই | এতো অপমান বুঝি রাস্তার মেয়েদের জন্যই বরাদ্দ থাকে | 


একটানা গাড়ির হর্ন শুনে মাথা তুলে তাকাতে একপ্রকার বাধ্য হয় কুহেলী | অন্য সময় হলে এই অসভ্যতামির জন্য দুচার কথা শুনিয়ে দিতে পিছপা হতো না সে | কিন্তু যেখানে মাথা থেকে পা পর্যন্ত নিজেই চূড়ান্ত অপমানিত হয়ে পথে নামতে হয়েছে তাকে, সেখানে অন্যকে কিছু বলার এক্তিয়ার তার নেই | সামনে তাকিয়ে দেখে একটা হালকা সবুজ রঙের আই টেন দাঁড়িয়ে আছে বাস স্ট্যান্ডে | ঠিক কুহেলীর সামনেই | ড্রাইভিং সিটে যিনি বসে আছেন, এই সমানে হর্ন বাজানোর কুকীর্তিটা তিনিই করছেন | সোজা হয়ে বসে কুহেলি | দরজা খুলে নেমে আসে যে, তাকে অন্তত এখানে কিছুতেই আশা করেনি সে | অফিসে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আরো একবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে কুহেলীর | দীপ্যমান কি করতে এসেছে এখানে? তার কি কিছু বলার বাকি আছে? এবার কি রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়েও অপমানিত হতে হবে তাকে? 


কিছু বোঝার আগেই কার্টুন বক্স আর ব্যাগটা তুলে নেয় দীপ্যমান | কুহেলিকে কিছু বলার সুযোগটুকুও দেয় না | গাড়ির পিছনের সিটে রেখে দেয় জিনিসপত্র | সামনের দরজা খুলে কুহেলিকে ইশারা করে গাড়িতে ওঠার জন্য | কিছুক্ষণের জন্য কুহেলীর মাথা শূন্য মনে হয় | কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে কিছুই তার মস্তিস্কগোচর হয় না | দীপ্যমান এসে কুহেলীর হাতটা ধরে আলতো করে | কুহেলি বাধা দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে | চুপচাপ দীপ্যমানের সাথে এসে উঠে পরে গাড়িতে | গাড়ি স্টার্ট দেয় দীপ্যমান | 


- আমার বাড়ি যেতে আপত্তি হবে কি?


কুহেলী অবাক হয় | দীপ্যমান তাকে নিজের বাড়ি নিয়ে যেতে উৎসাহী কেন? এও কি অপমান করার নতুন কোনো ছল?

কুহেলীর বিস্মিত দৃষ্টি নজর এড়ায় না দীপ্যমানের |


- অ্যাকর্ডিং টু মাই নলেজ তুমি একাই থাকো একটা রেন্টেড ফ্ল্যাটে | এই মানসিক অবস্থায় তুমি সেখানে যাও, আমি চাই না কুহেলী | আমার বাড়িতে আমার মা আছেন | অন্তত তুমি সিকিওর ফিল করবে বলেই আমার বিশ্বাস |


- আমি বাড়ি ফিরতে চাই | কাছাকাছি কোথাও দাঁড়ালে আমি একটা ট্যাক্সি ডেকে নেবো |


- আমি তোমাকে জোর করতে পারি না কুহেলী | কিন্তু চাইছি সেটাই | অ্যাটলিস্ট এই মুহুর্তে তো বটেই |


কুহেলীর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না | সে জানে এক জমাট বাঁধা ভয়ংকর অন্ধকার অপেক্ষা করে আছে তার জন্য | আগামী মুহূর্ত তার জন্য আর নতুন কি সারপ্রাইজ রেখেছে সে কিছুই জানে না | 


কুহেলীর উত্তরের অপেক্ষা করতে থাকে দীপ্যমান | মেয়েটা কয়েকদিনেই শুকিয়ে গেছে | অসম্ভব বিধ্বস্ত অবস্থায় মেয়েটিকে কিছুতেই সে একলা ছেড়ে দিতে পারে না | দীপ্যমানের ভয় আছে, একা একটি বাড়িতে কুহেলি যদি ভুল কোনো স্টেপ নিয়ে ফেলে! তখন? দীপ্যমান সিদ্ধান্ত নিয়েই নেয় | 


- মাকে আমি ফোন করে দিয়েছি কুহেলী | তোমার জন্য মা অ্যারেন্জমেন্ট করে রাখছে | তোমার কোনো সমস্যা হবে না |


- আর তোমার? আমাকে তোমার বাড়িতে এনে রাখলে কাল তোমার মুখ থাকবে অফিসে? আমি একটি আদ্যোপান্ত অপয়া মেয়ে দীপ্য | সো প্লিজ লিভ মি অ্যালোন |


- কে কি ভাবলো, কে কি বললো; তাতে দীপ্যমান ঘাবড়ায় না কুহেলী | আমরা অন্তত বছর দুই একসাথে কাজ করছি | কিছুটা তো আমাকে চেনো |


- চিনি | একজন নিপাট ভদ্র ভালোমানুষ তুমি | কারোর সাতে পাঁচে থাকো না | সেখানে আমি কখনোই চাইবো না, আমার মতো একটা মেয়ের সাথে সাথে তোমার বদনাম হোক |


- আমার বদনাম বা সুনামের ব্যাপারটা আমার হাতে ছেড়ে দাও | তবে তুমি যে আজকেই বেরিয়ে আসবে ভাবতে পারিনি |


- হ্যাঁ, নিয়ম অনুসারে আমার হাতে সময় ছিলো | কিন্তু ফাইনালি টার্মিনেশন লেটার তো ধরিয়ে দেওয়াই হয়েছে | সুপ্রিয়দা ভদ্রভাবে বলেছে ঠিকই, কিন্তু আদপে তো সেই চোখে আঙুল দিয়ে অপমান ছাড়া কিছু নয় ! কাজের গাফিলতির জন্য যদি আমাকে স্যাক করা হতো, তাহলে আমার কিছু বলার ছিলো না দীপ্যমান | কিন্তু আমাকে কি গ্রাউন্ডে স্যাক করা হয়েছে, সেটা জানলে আমাকে আর তোমার বাড়ি নিয়ে যাবার কথা ভাবতে না |


- আই নো এভরিথিং | মে বি আমি অন্য গ্রুপে আছি | স্টিল, খবর রাখি |


- তোমার সাহস তো কম নয় দীপ্যমান! এতো কিছু জানার পরেও আমার মতো নোংরা মেয়ের সাথে তুমি কথা বলছো?


- নোংরা আবার কি? এসব মাথা থেকে হটাও | সকাল থেকে ব্যাক টু ব্যাক মিটিং | সুপ্রিয় আমাকে টাইমলি খবর না দিলে তোমাকে পেতাম না বাস স্ট্যান্ডে | 


- সুপ্রিয়দা?


- ইয়েস | অফিসে সবার হাত পা একটা লেবেলের পরে বাঁধা থাকে, সেটা তুমি জানো | সুপ্রিয়র কিছু করার ছিলো না | উপর থেকে ওকেই এই কাজটা করতে বলা হয়েছে | হি ওয়াজ ফিলিং হেল্পলেস | 


- জানি না | কিন্তু তুমি কেন এলে আমার খোঁজে? অফিসে তোমার নাম কথা উড়বে এবারে |


- আমি এসব নিয়ে ভাবি না | আর কেন এলাম তোমার খোঁজে, সেটা তুমি জানো কুহেলী | বাট দিস ইস নট দ্যা রাইট টাইম টু ডিসকাস |


- আত্রেয়ী এমন বেইমানি করবে ভাবতে পারিনি আমি | 


- ভুলে যাও |


- ভুলতে পারবো না দীপ্যমান | এতো বড় অন্যায় আমি মেনে নিতে পারবো না |


- প্রতিশোধ নিতে চাও? তাতে তোমাকেই ছোট হতে হবে | বেটার মুভ অন | এগিয়ে চলো | শুধু এগিয়ে চলো |


- চলবো আর কি করে? সব তো থেমে গেলো | জমানো টাকা কটা শেষ হলে জানি না কি খাবো আর কোথায় থাকবো |


- নতুন চাকরি খুঁজতে থাকো | আই শ্যাল হেল্প ইউ |


- আমাদের ইন্ডাস্ট্রির খবর জানো না? আমার নাম যা এলিগেশন এলো, সে খবর চাউর হতে ক’সেকেন্ড লাগে? কেউ আমাকে চাকরি দেবে না আর |


- সে দেখা যাবে | চেষ্টা করলে কিছু না কিছু একটা হবেই | বাড়ি এসে গেছে | চলো এবার |


কুহেলী কুঁকড়ে যায় ভিতরে ভিতরে | দীপ্যমানকে একটা সময়ে কম তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেনি সে | বেচারা প্রপোজ করতে এসেছিলো | নির্মম ভাবে ফিরিয়ে দিয়েছে সে | কুহেলী তখন আত্রেয়ীর নেশায় বিভোর | এক ফ্ল্যাটে থাকতো তারা | এক অফিসে চাকরি | দিন রাত সব কিছুই স্বপ্নের মতো ছিলো | দীপ্যমানকে ফিরিয়ে দিতে এক মুহূর্তও ভাবতে হয়নি কুহেলীকে | কোনো রাখঢাকও সে রাখতে চায়নি | পরিস্কার করেই জানিয়ে দিয়েছিলো, তার ওরিয়েন্টেশন একদম আলাদা | পুরুষের প্রতি সে আকৃষ্ট হয় না, হয়নি কোনদিন | নারীর প্রতিই চরম মোহগ্রস্ত কুহেলী | তীব্র বিশ্বাস তার, একজন মেয়েই পারে প্রকৃত অর্থে একটি মেয়েকে ভালবাসতে | শরীরী আদরের চরম উত্তেজনা একমাত্র একটি মেয়েই দিতে পারে আর একটি মেয়েকে | পুরুষের সে ক্ষমতা কোথায়? দীপ্যমান বিস্মিত হয়েছিলো, কিন্তু মেনেও নিয়েছিলো | কথা বাড়ায় নি সে, নি:শব্দে ফিরে গেছিলো | কিন্তু কোথাও যে সে কুহেলীর আশেপাশেই ছিলো, আজকের ঘটনাই তার বড় প্রমাণ | 


গাড়ির দরজাটা খুলে দাঁড়ায় দীপ্যমান | কুহেলীর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় সে | 

.........................................................................................................


২.. 


- কি ভাবছো?

- এই এমনি | তুমি কফি করে আনলে?

- খাও | ভালো লাগবে | জ্বরটা আর আসেনি দেখছি |

- ভাইরাল তো | কটা দিন জ্বালাবে |

- কি এতো মন দিয়ে দেখছো বলতো?

- ভাবছি, বাইরের ওই সাদা বরফের স্তুপের মতই তোমার লাইফটা বেরঙিন হয়ে গেলো আমার জন্য | 

- তোমার পার্সপেক্টিভ সেটা | আমার তো মনে হয় না একবারও |

- কি দিতে পেরেছি তোমাকে? বরং নিয়েই গেছি তোমার থেকে | আফসোস হয় মাঝে মাঝে | কিন্তু পারি না কিছুতেই |

- জোর খাটাচ্ছ কেন নিজের মাথার উপরে? কফি খাও |

- নিজেকে অপরাধী মনে হয় দীপ্য |

- সি কুহু , একটা সিম্পল কথা বলি | সার সত্য এটাই, আমি ভালোবেসেছি তোমাকে ফ্রম দ্যা ভেরি বিগিনিং | তোমাকে হ্যাপী দেখাটাই আমার লাইফের একমাত্র চাওয়া |

- আর তোমার হ্যাপী হওয়া?

- হু সেইড আই এম নট হ্যাপী?

- কি জানি! বুঝতে পারি না সব সময়ে | অলওয়েজ মনে হতে থাকে, তোমাকে ঠকাচ্ছি | এই যে আমাদের এই রিলেশন; এটা থেকে তোমার কিছু পাওয়ার আছে কি? দীপ্য, আমি অনেকবার ভেবেছি জানো | আমরা নতুন করে একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি হয়তো | পারি না? 

- এভরিথিং ইজ পসিবল | কিন্তু নিজের মনের উপর জোর খাটিয়ে কিছুই নয় | স্বত:স্ফুর্তভাবে না হলে সেটা আরো যন্ত্রনাদায়ক হয়ে উঠবে যে কুহু | তার থেকে যেটাতে তুমি আনন্দ পাও, সেটা করাই তো বেটার | তাই না!

- আমি.. আমি... আমি যে কিছুতেই...

- আমি জানি কুহু | আমি বুঝি | এই যে তুমি আমার পাশে আছো; নিজেদের একটা ছোট জগত আছে আমাদের | এন্ড ইয়েস, উই লাভ ইচ আদার আ লট | এর থেকে আর বেশি কি চাই বলো?

- দীপ্য ! তুমি আমার জন্য এখনও সম্পূর্ণভাবে জীবনকে অনুভব করতেই পারলে না | এই যন্ত্রণা আমাকে খুব হার্ট করে | আরো একটা ব্যাপারে গিলটি ফিলিং আসে, যেটা কিছুতেই ওভারকাম করতে পারি না | তুমি জানো সেটা |

- কাম অন কুহু | আমরা ক্লিয়ার পরস্পরের কাছে | শুরু থেকেই এটা স্পষ্ট, তোমার আর আমার চাওয়া আলাদা | এটা ঠিক, ঘটনাচক্রে আমরা স্বামী-স্ত্রী এই মুহুর্তে | তার থেকেও বড় পরিচয় আমরা বন্ধু | বন্ধু বিনে কিন্তু জীবন চলে না | তুমি যদি মারিয়ার সাথে সময় কাটালে আনন্দ পাও, সেটা নিয়ে কেন অপরাধবোধ থাকবে তোমার? সকলের পছন্দ সমান তো হয় না কুহু | 

- আর তুমি? 

- সি | সেক্সুয়াল রিলেশনই শেষ কথা নয় একটা সম্পর্কের | হ্যাঁ, এটা জরুরি মানুষের জীবনে | কিন্তু তার মানে এই নয়, এটাই একমাত্র সত্যি লাইফে আর বাকি সবের দাম নেই কোনো | তোমার আমার আর্জ আলাদা | এই নিয়ে তো কোনো দ্বিমত বা ভুল বোঝাবুঝির জায়গা নেই | তুমি কষ্ট পাচ্ছো এই ভেবে যে তুমি আমাকে ফিজিকাল প্লেজার থেকে বঞ্চিত করছো | আমি কিন্তু একবারও সেভাবে ভাবছি না | তুমি পাশে আছো, সুখে দু:খে আমরা আছি, তোমাকে ছুঁতে পারি চাইলেই, তোমাকে একটা চুমু দিতে পারি, এর থেকে সত্যিই বেশি কিছু চাইনা আমি কুহু | এই যে তোমাকে যখন জড়িয়ে ধরে রাতে ঘুমাই, কি মনে হয় আমি কষ্ট পাচ্ছি?

- তুমি নিজেকে আটকে রাখো |

- রাখি | ইয়েস কুহু, আমি আটকে রাখি নিজেকে | কারণ তোমাকে হার্ট করতে চাই না | জোর করে হয় না যে |

- আমি কোনদিন স্বাভাবিক হবো না? আপাত দৃষ্টিতে আমরা হ্যাপিলি ম্যারেড কাপল | কিন্তু, অসম্পূর্ণ দুজনেই | অথচ ইচ্ছা পরিপূর্ণ দুজনের মধ্যেই | শুধু চাওয়ার তফাত | আমি একবার চেষ্টা করতে চাই দীপ্য | প্লিজ হেল্প মি |

- ওকে | যা চাও, যেভাবে চাও; সেটাই হবে | কিন্তু নিজের মনের সাথে আপোষ নয় একেবারেই | আর একটা পরিস্কার কথা তুমিও জানো কুহু | আমরা যে দেশে আছি, সেখানে সেক্স ব্যাপারটা ইজি, মানুষ এসব ব্যাপারে ভীষণ ফ্রি এবং তাদের চিন্তাধারাও খুব স্পষ্ট | অতএব এটা নিয়ে অত ভাবনা চিন্তা করার কোনো মানেই হয় না | আমি চাইলে পেতেই পারি কোনো মহিলার সান্নিধ্য | তাই না? তাই এসব নিয়ে ফালতু চাপ নিচ্ছো তুমি | জ্বরটা হওয়ার পর থেকে আরো আজেবাজে বকছো | সবার আগে সুস্থ হয়ে ওঠো | এখন এসব আলোচনা একদম নয় | তুমি রেস্ট নাও, আমি চট করে স্যুপ বানিয়ে ফেলি | ডিনারে ভালো লাগবে |


দীপ্যমান উঠে পরে | কুহেলীকে অসুস্থ শরীরে কিছুতেই কাজ করতে দেবে না সে | এই জন্য ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছে সে গত দুদিন ধরে | কুহেলী দীপ্যমানের হাতটা চেপে ধরে |


- দীপ্য !

- বলো |

- আমি তোমাকে সত্যিই ভালবাসি |

- আমিও কুহু |


মিঠে হাসি ছড়িয়ে কিচেনে যায় দীপ্যমান | মা মারা গেছেন বছর ঘুরে গেছে | ঘটনা পরম্পরায় মায়ের জীবদ্দশাতেই কুহেলীকে নিজের স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছে দীপ্যমান | আসলে সে জানে, কুহেলী তাকে স্বামীর মর্যাদা দিয়েছে | শুরু থেকেই মায়ের খুব পছন্দ ছিলো কুহেলী | আর দীপ্যমানের কথা আলাদা করে বলার কিছুই নেই | সেদিন যদি মা বুকে করে কুহেলীকে নিজের করে কাছে টেনে না নিতেন, দীপ্য জানে না সে কি করতো | হ্যাঁ, মাকে সত্যি কথা বলার সৎসাহস তার হয়নি | পুরোনো ধ্যান ধারণার মানুষ মা, হয়তো সম্পূর্ণ বিষয়টি অনুধাবন করতে পারতেন না, সমস্যা, ভুল বোঝাবোঝি বাড়তে পারতো | মা শুধু জানতেন, অফিসের রাজনীতির স্বীকার হয়ে চাকরি খুইয়েছে কুহেলী | কুহেলীকেও বারংবার অনুরোধ করেছিলো দীপ্যমান, এইটুকু যেন সে নিজের মধ্যেই রাখে | 


মা মারা যাবার পরে সেই অর্থে কোনো পিছুটানই ছিলো না দীপ্যর | দেশের বাইরে কাজের সুযোগ আসতে আর দ্বিতীয়বার ভাবেনি সে | এখানে এসে বরং কুহেলীও নতুন করে নিজের কেরিয়ার নতুন করে আবার শুরু করতে পেরেছে | ভালো আছে তারা | ভীষণ ভালো আছে পরস্পরের মধ্যে নিজেদের খুঁজে পেয়ে | নাই বা থাকলো তথাকথিত শারীরিক আরাম টুকু | সেই টুকু বাদ দিয়েও শুধু ভালবাসায় ভর করে কি জীবন চলে না? নিশ্চয় চলে |


আরামকেদারায় মাথাটা হেলিয়ে দেয় কুহেলী | কতবার যে ফিরিয়ে দিয়েছে সে দীপ্যকে ! আড়ম্বরহীন সই সাবুদের বিয়ে তাদের | কিছুটা নিরাপত্তার লোভেই বিয়েটা করেছিলো কুহেলী | দীপ্যর নি:স্বার্থ ভালোবাসা নাড়িয়ে দিয়েছিলো কুহেলীকে | দীপ্যর মা বিয়ের প্রস্তাব রাখতে না বলতে পারেনি কুহেলী| এমনিতেই পরিবার হারা সে ছোট থেকেই | মায়ের আদর কাকে বলে দীপ্যর মাকে কাছে না পেলে হয়তো জানাই হতো না জীবনে | সেদিন যদি দীপ্য ওর পাশে না থাকতো, তাহলে হয় আজ সে ছবি হয়ে থাকতো, নয়তো জীবন্ত লাশ | সেই সব মাতামাতির দিন, আত্রেয়ী আর কুহেলী; কুহেলী আর আত্রেয়ী; এর বাইরে জগতের অস্তিত্ব কোনদিন মানেনি কুহেলী | শত শত প্রতিশ্রুতি, বাঁধ ভাঙা ভালবাসার জোয়ার সব কিছুই হয়তো এক তরফা খাঁটি ছিলো | তলে তলে আত্রেয়ী যে নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে, এক মুহুর্তের জন্যও আন্দাজ পায়নি কুহেলী| দিনের পর দিন যা বলেছে আত্রেয়ী, সব মেনে নিয়েছে কুহেলী | ফ্ল্যাটের ভাড়া সে একাই দিয়েছে, তাদের রোজের জীবনের খরচও একাই বয়ে গেছে কুহেলী | নিজের ভবিষ্যত নিজের সঞ্চয়ের কথা সে এক বারের জন্যও ভাবেনি | আত্রেয়ীই ছিলো তার একমাত্র ভবিষ্যত| সেই আত্রেয়ী যখন খবর দিলো, অফিসের বসের সাথে তার বিয়ে আসন্ন; পাগল হয়ে গেছিলো কুহেলী| কিভাবে সম্ভব হতে পারে এটা? আত্রেয়ী যে শুধুই তার; একান্তই তার সঙ্গী| সে কি ভাবে তার বসের অঙ্কশায়িনী হতে পারে? কিভাবে? 


শুধু এই টুকু জবাব চেয়েছিলো কুহেলী | অপরাধ করেছিলো সে| মারাত্মক অপরাধ| বসের ভাবী সহধর্মিনীর দিকে আঙুল তোলার খেসারত তো দিতেই হবে তাকে | চাকরি ছেড়ে গেলো, জুড়ে থেকে গেলো লাঞ্ছনা আর অপমান | সাথে আত্রেয়ীর ভালবাসার শেষ চিহ্ন: ‘রাস্তার মেয়ে’ তকমা | 


দীপ্যকে মেনে নিয়েছে কুহেলী | কিংবা দীপ্য মেনে নিয়েছে তার কুহুকে| হ্যাঁ, দ্বিধা নেই বলতে ভালো সে বাসে তার দীপ্যকে| শুধু কোথায় যে একটা অদৃশ্য লাইন টানা আছে ! দীপ্য কাছে আসতে চাইলে কেন যে শক্ত হয়ে যায় সে কিছুতেই ভেবে পায় না | পুরুষের আদর তো সে চায়নি কোনদিন | দীপ্য পাশেই থাকে, তবু তো কই শরীর জাগে না তার ! দীপ্য চেষ্টা করেছে, সাড়া দিতে পারেনি কুহেলী | একি তার অপারগতা নয়? সেকি অন্যায় করছে না দীপ্যর সাথে? উল্টে সে আকৃষ্ট হয়ে পরছে মারিয়ার প্রতি | মারিয়া ভারী মিষ্টি একটি ইউরোপিয়ান মেয়ে | অসম্ভব ভালো বন্ধু তাদের দুজনের| ভীষণ স্বচ্ছ এবং স্পষ্টবাদী | গল্পে কথায় সে নিজের পছন্দের কথা স্পষ্ট জানিয়েছিলো এক শুক্রবারের সান্ধ্য আড্ডায় | মারিয়ার পছন্দ নারী, পুরুষ নয় | শুধু তাই নয়, মারিয়া এও জানিয়েছে কুহেলীকে তার ভারী পছন্দ হয়| এই ইশারার অর্থ কুহেলী বোঝে ভালো করেই | সে নিজেও ভীষণ রকম আকর্ষণ বোধ করে মারিয়ার প্রতি| কিন্তু সেই যে এক অদৃশ্য পাঁচিল খাড়া হয়ে আছে| দীপ্য-মারিয়া-কুহেলী এক অদ্ভুত ত্রিকোণ, যাতে লাভের খাতায় কুহেলী থাকলেও দীপ্যর ভাঁড়ার শুধুই শূন্য | দীপ্যকে সে সব খুলে বলেছে | বাধা নেই কোথাও, তবুও বিশাল এক অদেখা দেওয়াল মাথা উঁচু করে চলেছে সমানে কুহেলীর মনের মধ্যে| সে লড়তে থাকে নিজের সাথে| প্রতিদিন প্রতিনিয়ত | আত্মগ্লানি কুড়ে কুড়ে খায় বারবার | দীপ্যকে বিয়ে করে সে কি অন্যায় করলো দীপ্যর সাথে?


নাহ, হাল ছাড়বে না কুহেলী | লড়ে কাটাতে হয়েছে জীবনের অধিকাংশ দিন | হেরেছে, মিশেছে মাটির সাথে; কিন্তু উঠে দাঁড়িয়েছে বারবার| আজকের ভালবাসার খেলায় সে কিছুতেই হারতে রাজি নয় | প্রস্তুত হতে থাকে মনে মনে কুহেলী | মনটাই আসল | মন চাইলে অসম্ভব বলে কিছু হয় না| ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কফির কাপটা দুহাতে আঁকড়ে ধরে মনে মনে ভালবাসার সমুদ্রে ডুব দেবার প্রস্তুতি নিতে থাকে কুহেলী | পারতে যে তাকে হবেই | দীপ্যর তীব্র অথচ এই স্নিগ্ধ ভালবাসার যথাযোগ্য মর্যাদা তাকে দেওয়ার চেষ্টাটুকু অন্তত করতে হবেই| 


চোখের কোল বেয়ে গরম দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পরে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কফিতে | কুহেলী অপেক্ষা করতে থাকে তার দীপ্যমানের জন্য| 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance