Saswati Choudhury

Children Stories Horror Classics

5.0  

Saswati Choudhury

Children Stories Horror Classics

প্রিয়

প্রিয়

6 mins
592



সকালটা শুরু হয় লেখা দিয়েই। ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ে চুমুক দিলেই মাথা সাফ হয়ে যায় ধৃতিমানের। নিয়ম করে সকালে ঘন্টা তিনেক লেখার টেবিলে না বসলে সমস্ত দিন বিফলে যায়। অন্তত ধৃতিমানের তাই মনে হয়। ব্যাস্ত লেখক সে। বাংলা সাহিত্যে আজ সর্বাধিক জনপ্রিয় লেখক ধৃতিমান রক্ষিত। রহস্য এবং ভৌতিক কাহিনী রচনায় বর্তমানে শ্রেষ্ঠ তকমা যদি কারুর থাকে, সে তাহলে অবশ্যই ধৃতিমান রক্ষিতের। 


সারাদিন অসম্ভব ব্যাস্ততায় কাটে। বিভিন্ন জমায়েতে, অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে হয়। জনপ্রিয়তা তুঙ্গে থাকার সুবিধা অসুবিধা সবই থাকে। সময়ের হিসাব থাকে না। গুণমুগ্ধ ভক্তদের ভিড় আবদার সামলাতেও হয়। মোটের উপর ধৃতিমান নিজের জীবনকে ভীষণ ভাবে উপভোগ করেন। 


আজ একটি অনুষ্ঠানে এসেছেন ধৃতিমান। উদ্যোক্তাদের যত্নের অভাব নেই। অনুষ্ঠান শুরু হতে এখনো কিছুটা সময় হাতে আছে। ধৃতিমান ফেসবুক মেসেঞ্জার খুললেন। সকাল থেকেই প্রচুর প্রাতঃকালীন শুভেচ্ছা জমা হয় মেসেঞ্জারে। এতো কিছু দেখার অবকাশ হয় না। এখন কিছুটা অবসর। কি মনে হতে মেসেঞ্জারের আদার মেসেজ বক্স খুললেন ধৃতিমান। কত শত মেসেজ যে জমে আছে! বেশিরভাগই হাই হ্যালো টাইপ। নজর কাড়লো একটি মেয়ের পাঠানো মেসেজ। মেয়েটির নামটিও ভারী সুন্দর। বন্হী। মেয়েটি লিখেছে, সে ধৃতিমানের গুণমুগ্ধ ভক্ত। প্রিয় লেখকের এমন কোনো বই বাকি নেই, যা সে পড়েনি। প্রিয় লেখক মহাশয়কে সেই কবেই সে বন্ধুত্বের আহবান জানিয়েছে। ব্যাস্ততার কারণে তিনি মনে হয় খেয়ালই করেননি। কিংবা ভিড়ের মাঝেই হারিয়ে গেছে বন্হীর অনুরোধ। 

মেয়েটির সরল অকপট কথাগুলো হঠাৎ ধৃতিমানের বেশ ভালো লেগে গেলো। কি উত্তর দেওয়া যায় ভাবতে ভাবতেই উদ্যোক্তাদের ডাক এসে যেতেই তাড়াহুড়োতে লিখে দিলেন ধৃতিমান। 

- কথা হবে। 


অনুষ্ঠানে ব্যাস্ততায় সময় কেটে গেছে অনেক। ধৃতিমানের মনেও নেই, কাকে কখন কি বার্তা পাঠিয়েছেন। পথশ্রমে ক্লান্ত লেখক তাড়াতাড়ি খাওয়ার পর্ব সেরে শুয়ে পরলেন আজ। ঠিক মতো ঘুম না হলে সকালে উঠতে কষ্ট হয়। আর সকালে সঠিক সময়ে উঠতে না পারলে লেখা নষ্ট হবে, পুরো দিনটা খারাপ যাবে। 

বালিশে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে সবে একটা ঘোরের মধ্যে গেছেন ধৃতিমান, টুং একটা শব্দে তার ইন্দ্রিয় সচেতন হয়ে উঠলো। রাতে শোবার সময়ে মোবাইল তো সাইলেন্ট মোডে থাকে। তাহলে এই শব্দ এলো কি করে? তাহলে কি আজ ভুলে গেছেন মোড চেঞ্জ করতে? ঘোর অনিচ্ছায় হাতে তুলে নিলেন ফোন। 


বন্হি পাঠিয়েছে বার্তা। 

- আমার অপেক্ষা সার্থক প্রিয় লেখক। আপনার উত্তর আমাকে নব জীবনীশক্তি দিলো। 


কৌতুহল হলো ধৃতিমানের। মেয়েটি বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারে তো! ঘড়িতে রাত বারোটা। এই সময়ে একজন অচেনা মহিলার সাথে কথা বলা কতটা সমীচীন হবে, সেই নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পরলেন ধৃতিমান। তৎক্ষণাৎ নতুন এক বার্তা এলো। 


- আপনি আছেন আমি জানি। কিসের এতো সংশয় প্রিয় লেখক? আমি এতোটাও দূরের যাত্রী নই। 


ভারী অদ্ভুত কথা লেখে তো মেয়েটি! কৌতুহল বাড়ছিলো ধৃতিমানের। নাহ, একটু কথা বলেই দেখা যাক না হয়। মেয়েটি নিজে থেকেই যখন বাক্যালাপে উৎসাহী, তখন কিছু কথা বলতে ক্ষতি কি? সে ঘড়িতে সময় যাই হয়ে থাকুক না কেন। 


- সারাদিন ব্যাস্ত থাকি। মেসেজ দেখা হয়ে ওঠে না সব সময়ে। ভালো লাগলো জেনে যে আপনি আমার সব বই পড়েছেন। 

- আমি আপনার থেকে অনেক ছোট প্রিয় লেখক। আমাকে তুমি বললে ভালো লাগবে। 

- অবশ্যই। কি করো তুমি? 

- আমার কথা বলা শুরু করলে শেষ হবে না আর। আমি আজ আপনার কথা শুনতে চাই। আপনি জানেন কি, গত বইমেলায় আপনাকে দূর থেকে দেখতাম আমি। রোজ যেতাম, রোজ দেখতাম। শুধু দেখেই মন ভরাতাম। 

- সেকি! আলাপ করা উচিৎ ছিলো তোমার। তোমরাই তো আমার লেখার শক্তি। 

- কাছে আসতে ভয় পাই জানেন! এই যে আপনি, আপনার লেখনী, আপনার কল্পনা এসব নিয়ে আমার নিজস্ব এক জগৎ আছে। লেখক ধৃতিমানকে আমি বড় ভালোবাসি জানেন। মানুষ ধৃতিমান কেমন তা তো জানি না। যদি সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়? আমার স্বপ্ন ভঙ্গ হয় যদি? না না, সে দায় আমি নিতে পারবো না। 

- খুব সুন্দর কথা বলো তো! তুমি কি লেখো?

- আমি পাঠিকা প্রিয় লেখক। আপনার লেখনী রসে সিক্তা এক পাঠিকা মাত্র। 

- এই বছর বইমেলা তো আর বেশি দেরী নেই। অবশ্যই আসবে তুমি এবং আলাপ করবে আমার সাথে। আমি অপেক্ষায় থাকবো আমার প্রিয় পাঠিকার। 

- প্রিয় পাঠিকা? আমাকে আপনি এই সম্মান দিলেন লেখকবর? এতো বড় সম্মান আমি কোথায় রাখবো? আমি যে আপ্লুত! 


ধৃতিমান আপ্লুত হলেন। মেয়েটি কি অপূর্ব কথা বলে। কিছুটা কবিতার মতো, এক অদ্ভুত মাদকতা আছে প্রতিটি শব্দের মধ্যে। ধৃতিমান আকর্ষিত হচ্ছেন ক্রমশঃ। রাত জমাট বাঁধছে, পরস্পরের মধ্যে বার্তা বিনিময় গভীর থেকে গভীরতম হয়ে উঠছে৷ সময়ের হিসাব থাকছে না। ধৃতিমান এক অদ্ভুত ভালোলাগায় ভেসে যাচ্ছেন। 


- প্রিয় লেখক, রাত যে শেষ হয়ে ভোর হতে চললো। ঘুমাবেন না বুঝি?

- তোমার সাথে কথা বলতে বলতে যে কিছু খেয়ালই থাকছে না। 

- আমার বন্ধুত্বের আহ্বান কিন্তু এখনো গ্রহণ করেননি। আমার ভারী অভিমান হচ্ছে এবারে৷ 

- খুবই অন্যায় হয়েছে আমার। তোমার সাথে কথা বলতে বলতে হুঁশ থাকছে না। কাল সকালে সবার আগে আমি তোমার বন্ধুত্ব স্বীকার করবো। খুশী তো? 

- খুউউউব খুশি। 

- তাহলে? এবার আমাদের দেখা হবে নিশ্চয়ই। তোমাকে দেখার কৌতুহল হচ্ছে যে ভীষণ।  

- ক্ষমা প্রিয় লেখক। যদি বলি দেখাটুকু নাহয় থাক তোলা। ক্ষতি কি? 

- কিন্তু কেন? যে মেয়ে এতো সুন্দর ভাবে কথা বলতে জানে, তার মুখোমুখি হয়ে কথা বলার সুযোগ পেলে ভালোলাগা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। আমি সে সুযোগ নষ্ট করতে চাই না যে। 

- সুযোগ চাইলেই কি আর আসে? আমার স্বপ্ন ছিলো আপনার সাথে কথা বলার। দীর্ঘ প্রতীক্ষা করেছি শুধু এই মুহূর্তটুকু পাওয়ার জন্য। আমার সুদীর্ঘ অপেক্ষা সার্থক। আর কিছুই চাওয়ার নেই যে প্রিয় লেখক আমার। 


ধৃতিমান অস্থিরতা অনুভব করছেন ভিতরে ভিতরে। মেয়েটিকে এই মুহূর্তে ভীষণ ভাবে সামনে দেখতে ইচ্ছা করছে। ইচ্ছাটা ক্রমে ক্রমে এতোটাই প্রবল হয়ে উঠছে, কিছুতেই নিজেকে সংযত করতে পারছেন না। এহেন চিত্তদৌর্বল্যের কারণ নিজেও বুঝতে পারছেন না ধৃতিমান। দ্রুত গতিতে টাইপ করতে গিয়ে আচমকা সব অন্ধকার হয়ে গেলো। হাতের মুঠোয় থাকা মুঠোফোন মুহূর্তেই অচল। ব্যাটারি চার্জ শেষ হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি চার্জে বসিয়েও ফোনটা অন করতে পারলেন না ধৃতিমান। হতাশ হয়ে ফোন রেখে পাশ ফিরে শুলেন তিনি। কি জানি, মেয়েটি কি মনে করলো। সকালে উঠে আগে বন্ধুবৃত্তে মেয়েটিকে স্থান দিতে হবে এবং এভাবে অফলাইন হওয়ার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। মনে মনে স্থির করে একটু শান্ত হলেন ধৃতিমান। ঘড়ির কাঁটা ভোর চারটে ছুঁইছুঁই।  


ঘুম ভাঙতে বেশ বেলা হলো। আজকের মতো লেখা আর হলো না ধৃতিমানের। মনটা বিষন্ন হয়ে গেলো। ঠিক করলেন, আজ বাইরের সব কাজ বাতিল করবেন। আজ শুধুই লেখা আর বন্হি। ভাবনাটা মনে আসতেই প্রফুল্লচিত্তে ফোনের দিকে হাত বাড়ালেন ধৃতিমান। 

বন্হিকে একটা সরি বলা আগে দরকার৷ তারপর ওর প্রোফাইলে উঁকি দেবেন তিনি। 


মেসেঞ্জার খুলেই বিষ্ময়। অদ্ভুত কান্ড! কাল রাতভর এতো বাক্যালাপ হলো, তার কিছুই নেই এখন ইনবক্সে। শুধু ধৃতিমানের করা শেষ মেসেজটি আছে। 'কথা হবে'। 


ঝটপট বন্হির প্রোফাইলে ঢুকলেন ধৃতিমান। বিগত এক বছর কোনো আপডেট নেই বন্হির প্রোফাইলে। একটু স্ক্রল করতেই নজরে এলো, বন্হিকে ট্যাগ করে কোনো এক বান্ধবীর মেসেজ। বন্হির অকাল মৃত্যুতে সে গভীর শোক প্রকাশ করেছে। ধৃতিমান চমকে ওঠেন। সময় বলছে, প্রায় এক বছর আগে বইমেলা চলাকালীন বন্হির মৃত্যু হয়েছে। স্ট্যাটাসটি ভালো করে পড়ে আরো জানতে পারেন ধৃতিমান, নির্দিষ্ট দিনে বইমেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে রাস্তায় গেটের সামনে বন্হি তার প্রিয় লেখককে ভক্ত পরিবৃত হয়ে থাকতে দেখে দৌড়ে আসতে যায়। ব্যাস্ত রাস্তায় অমন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়ানোর ফলে অ্যাক্সিডেন্টে অকালেই প্রাণ হারায় বন্হি। 


ধৃতিমানের শরীর জুড়ে কাঁপুনি আসতে থাকে। মনে পরেছে তার। ঠিকই তো! বইমেলা ভাঙার সময়ে শেষ মুহূর্তের কিছু জরুরী আলোচনা সারছিলেন তিনি। এই সময়েই কলরব উঠেছিলো। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন তিনি৷ দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে একটি মেয়ে রাস্তা পার হয়ে গিয়ে বাসের চাকার তলায় চলে এসেছিলো সরাসরি। হ্যাঁ হ্যাঁ, স্পষ্ট মনে আছে তার। গোলমালের ভয়ে উদ্যোক্তারা চটপট লেখককে নিয়ে জায়গা ছেড়েছিলো। পথমধ্যে বহুল আলোচনা হয়েছিলো, আজকালকার ছেলেমেয়েরা কেমন কান্ডজ্ঞানহীন। 


মেয়েটির স্ট্যাটাসে উল্লেখ নেই, বন্হির প্রিয় লেখক কে। কিন্তু ধৃতিমান জানেন এখন, কে সেই প্রিয় লেখক। যার জন্য অকালে খোয়াতে হলো তরতাজা এক প্রাণ। ক্ষমা ক্ষমা। ক্ষমাই একমাত্র স্বান্তনার ভাষা হতে পারে। বিকল্প ভাষা এই মুহূর্তে জানা নেই জনপ্রিয় লেখকের৷ 


চোখের জল পরে দু চার ফোঁটা টুপটাপ। অপেক্ষা করতে থাকেন ধৃতিমান রাত হওয়ার ৷ তিনি জানেন সে আসবে। মধ্যরাতের ঘন্টাধ্বনির সাথেই আসবে সে। এই বেলা ক্ষমা না চেয়ে নিলে শান্তি পাবেন না যে ধৃতিমান। 


একাগ্র চিত্তে অপেক্ষা করতে থাকেন এক প্রিয় লেখক এক প্রিয় পাঠিকার। 


Rate this content
Log in