Saswati Roy

Inspirational

2  

Saswati Roy

Inspirational

গরদের পাঞ্জাবী ( নারী শক্তি)

গরদের পাঞ্জাবী ( নারী শক্তি)

10 mins
871


#এক


টিয়ার হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা এই সপ্তাহেই শেষ হবে। তারপরেই পুজোর বাজারটা করবে বলে ঠিক করে রেখেছিল সৌমী। সুমন্ত অনেক দিন ধরেই তাগাদা দিচ্ছে যদিও, কিন্তু সৌমীর কাছে মেয়ের পরীক্ষার থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ অন্য কিছু হতেই পারে না। আর পুজোর কেনাকাটায় সামান্য দেরী হলেও তেমন অসুবিধা হবার কথা নয়। কারণ তারা তিনজনেই রেডিমেড জামা কাপড় পরে। সামনের সপ্তাহে যে কোনো একদিন বেরিয়ে কিনে আনলেই হলো।


মেয়েকে স্কুল বাসে তুলে দিয়ে এসে, মোটামুটি একটা লিস্ট বানিয়ে নিচ্ছিলো সৌমী। শুধু তো নিজেদের জন্য কিনলে হবে না। দাদা বৌদি গত সপ্তাহে এসে পুজোর জামা কাপড় দিয়ে গেছে। তাদের জন্যও কিনতে হবে। মাঝে মাঝে সৌমীর মনে হয় পুজোয় এই দেওয়া থোয়া এবার বন্ধ করে দিলেই হয়। কিন্তু প্রাণে ধরে কিছুতেই এমন কঠিন সিদ্ধান্তটা নিতে পারে না সে। যতদিন বাবা আছে ততদিন নাহয় চলুক এই রীতি। তারপর যা হয় দেখা যাবে। বাবার কথা মনে আসতেই ছোট্ট একটা শ্বাস পড়লো সৌমীর। প্রতিবার পুজোর সময় ভাবে বাবাকে একটা গরদের পাঞ্জাবী কিনে দেবে। কিন্তু দোকানে গিয়ে সুমন্তর চোখ মুখের কাঠিন্য দেখে কিছুতেই সাহস করে বলে উঠতে পারে না। সুমন্তর হাতে ধরা সুতির পাঞ্জাবী দেখেই ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। বছর কয়েক আগে ভাইফোঁটার সময় দাদার প্যাণ্টের কাপড় দেখে সৌমীর পছন্দ হয়নি। সেটা বলতেই সুমন্ত যা বাক্যবাণ নিক্ষেপ করেছিল

- "তোমার দাদার আর কি, এখানে তো মাত্র তিনজনকে দিতে হয়। আমার বাবা,মা তো মরে গিয়ে ওদের বাঁচিয়ে দিয়ে গেছেন। তোমার দাদা সস্তায় সারছে আর আমাকে তোমার বাড়ির ছ'জনের জন্য কিনতে হচ্ছে"।

-"ছ জন কোথায়? দাদা,বৌদি,রনি,বনি আর বাবা"।

- "কেন তুমি? তুমিও তো ওদেরই লোক"।

- "আমি? আমাকে কেন ওদের মধ্যে ধরছো"?

- "মন তো তোমার ও বাড়িতেই পড়ে থাকে তাই বাধ্য হয়েই তোমাকেও ওই বাড়ীর লোক হিসাবে ধরতে হচ্ছে"।

আর কিছু বলতে পারেনি সৌমী। কোন বাড়িটা যে তার নিজের সেই ভাবনাটা এসে গলা টিপে ধরেছিল। তবে সুমন্ত থামেনি।

অনর্গল বিষ উগরে যাচ্ছিলো

- "তোমার বাবা তো চেয়ার গড়িয়ে চলে, তাকে আবার অত দাম দিয়ে দেওয়া কিসের। যা হোক কিছু দিলেই তো চলে। এরপর আবার আসবে ভাইফোঁটার উৎসব। এই রাবণের গুষ্টিকে দিতে দিতেই আমি ফতুর"।

সুমন্তর এই দুর্ব্যবহারের কারণেই হোক বা নিজের অপারগতার কথা ভেবেই হোক, সেদিনের পর থেকে আর কোনোদিনই কেনাকাটির সময় সৌমী কোনো মতামত দেয় না। 

সে তো আর বিল মেটাতে পারবে না তাই দোকানের এক কোণে দাঁড়িয়ে বরের হম্বিতম্বি দেখাই তার ভবিতব্য। 

এখন অবশ্য মেনে নিয়েছে সৌমী। তবুও যে কেন পুজো আসলেই বুকের মধ্যে একটা পিঁপড়ে অনবরত কামড়ে চলে.... মাঝে মাঝে সৌমীর মনে হয়, বিয়ের পর সংসারের জন্য নিজের সবটুকু না দিয়ে যদি একটা জানালা অন্তত নিজের জন্য রাখত তাহলে হয়তো এভাবে পরের হাত তোলা হয়ে থাকতে হতো না।


ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে সাড়ে দশটা বাজে। ইশ, রান্নায় অনেকটা দেরী হয়ে গেল। সুমন্ত আজ ছোট ছোট ট্যাংরা আর মৌরলা এনেছে। ট্যাংরাটা পেয়াজ,আলু দিয়ে চচ্চড়ি বসিয়ে, মৌরলা পরিস্কারে মন দিলো সৌমী। সুমন্ত মৌরলার টক বানাতে বলে গেছে। টিয়ার জন্য কিছুটা ভাজা মাছ আলাদা করে রেখে বাকি কটা দিয়ে তেঁতুলের টক বানিয়ে ফেললো। টিয়া হবার আগে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই মৌরলার এই পদটা সৌমীর পাতে পড়তই। চামচে করে সামান্য তুলে, চেখে দেখলো সৌমী। আহা, বেশ টক মিষ্টি স্বাদ এসেছে। মাছটা একদম ফ্রেশ ছিলো আজ। রান্নাগুলো টেবিলে সাজিয়ে স্নানে গেলো সৌমী। গতকাল সবে শরীরটা সেরেছে। ভেবেছিল আজ একটু মাথা ঘসবে, মনে হয় না আজ আর স্নানে অত সময় দিতে পারবে। থাক গে, কালই না হয়....


স্নান সেরে বেরিয়ে ভিজা চুল মুছতে মুছতে ঘড়ির দিকে দেখলো। টিয়ার বাস আসতে এখনও আধ ঘন্টা মত সময় আছে। চট করে বাবাকে ফোন লাগাল সৌমী।

- "বল খুকু। দিদিভাই ফিরেছে ইস্কুল থেকে"?

- "এই তো যাবো আনতে। ভাবলাম তোমার একটু খবর নিই। আজ কেমন আছ"?

- "আমার আর খবর। এখন তো শুধু চেয়ারে বসে দিন গোনা"।

মনটা ভার হয়ে গেল সৌমীর। দ্বিতীয়বার স্ট্রোকের পর থেকে বাবার নিত্য সঙ্গী ওই হুইল চেয়ার। প্রথম প্রথম রাগ করলেও পরে মেনে নিয়েছে বাবা। দিনের বেলা একজন আয়া আছে বাবার জন্য। রাতটাই যা সমস্যা। তবে দাদা মোটামুটি সামলে দেয়, এটুকুই যা রক্ষে। মন খারাপটা বাবাকে টের পেতে দিলো না সৌমী। জোর করে হাসি ফোটাল গলায়

- "হুম, বুঝেছি মায়ের কথা মনে পড়ছে। টিভিতে আজ ভালো ছবি আছে। মনে করে বিকালে টিভি খুলো"। 

- "কি ছবি"? একটু যেন উচ্ছল হয়েছে সোমেনের গলা।

- "হারানো সুর। তোমার আর মায়ের ফেভারিট"।

-"দেখব খন। তুই কবে আসবি? এবার পুজোর মধ্যে দুটো দিন কাটিয়ে যাস না। তোরা এলে তাও বাড়িটা প্রাণ পায়।

নাহলে তো..." দীর্ঘশ্বাস চাপল সোমেন।

মুহুর্তের জন্য বাবার রুগ্ন মুখখানা মনে পড়লো সৌমীর। বুকটা মুচড়ে উঠলো তার। সত্যি তো পুজোর কটা দিন তারা যে যার মতো প্যাণ্ডেলে প্যাণ্ডেলে চরকির মতো ঘোরে। কিন্তু বাবা তো সেই হুইল চেয়ারেই। 

- "থাকবো বাবা। এবার ঠিক থাকবো"।

- "থাকবি? ঠিক"?

- "ঠিক। এবার একটু ঘুমিয়ে নাও। আমি তোমার দিদিভাইকে নিয়ে আসি"।

সৌমী যেন মনশ্চোক্ষে দেখতে পাচ্ছিল বাবার খুশি খুশি মুখটা। বাবাকে খুশি করতে পেরে তার নিজের মনটাও ভালো হয়ে গেলো। সত্যি কতো অল্পতেই খুশি মানুষটা। আর সুমন্ত একটা দেড়শো টাকার পাঞ্জাবি কেনার সময় কি না বলে।


আজ টিয়া বাস থেকে নামতেই সৌমী বুঝে গেল মেয়ের পরীক্ষা বেশ ভালো হয়েছে। 

ছুট্টে এসে মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরেছে টিয়া।

- "কিরে ভালো হয়েছে পরীক্ষা"? মুখে ঝলমলে হাসি নিয়ে দু আঙ্গুলে মুদ্রা ফোটাল টিয়া অর্থাৎ কিনা সৌমীর পরিশ্রম সার্থক। 

যাক বাবা, এবার অঙ্কটা ভালোয় ভালোয় উতরোলে সৌমী যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। এতদিন সুমন্তই টিয়াকে অঙ্ক দেখাত। এই বছর টিয়া ক্লাস এইটে ওঠার পর অঙ্কের জন্য একজন দিদিমণির কাছে যায়। আর তিনিও বেশ যত্ন নিয়েই পড়ান। তবু সৌমীর চিন্তাটা যায় না। সে বরাবরই অঙ্ককে যমের মতো ভয় পেত, মেয়ের মধ্যেও যেন সে ভীতি না চলে আসে।

ভাবনার মাঝেই টিয়া হাত ধরে টানল

- "মা, আজ একটা আইসক্রিম দেবে? প্লিজ মা"।

- "তুই না পরশু রাতে কাশছিলি"?

- "ও তো একটুখানি কাশি। দাও না মা একটা আইসক্রিম"।

- "আজ না বাবু, আর তো মাত্র দুটো পরীক্ষা। তারপর যা খুশি করিস"।

টিয়া বুঝদার মেয়ে। আর জেদ করলো না। বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে বকবক করছে মায়ের সাথে।

- "মা আজ কিন্তু একবার রমনা ম্যামের বাড়িতে যেতে হবে"।

- "কেন রে? কাল পরীক্ষা আজ আবার ম্যামের কাছে কেন"?

- "অ্যালজেব্রার দুটো প্রবলেম আটকে আছে। বাবাকে দেখিয়েছিলাম। বাবাও পারলো না"।

- "আচ্ছা নিয়ে যাবোখন। তুই একবার ফোন করে নিস ওনাকে। থাকেন কি থাকেন না, গিয়ে হয়তো ফিরে আসতে হবে"।


আজ রমনা ম্যামের বাড়িতে ছাত্র-ছাত্রীদের ভীড় নেই। পরীক্ষার জন্য যে যার বাড়িতে বসেই প্রিপারেশন নিচ্ছে। সৌমী ওনার লিভিংরুমে বসেছিলো। ভিতরের ঘরে টিয়াকে ম্যাম অঙ্ক দেখাচ্ছেন। সৌমী চোখ ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে ঘরখানা দেখছিল। কি সুন্দর ছিমছাম সাজানো। দেওয়ালের একদিকে অয়েল পেন্টিং শোভা পাচ্ছে। আর এক দিকের দেওয়ালে ম্যামের ছাত্রজীবনের ছবি। রাজ্যপালের হাত থেকে সার্টিফিকেট নিচ্ছেন ম্যাম। সৌমী সোফা থেকে উঠে কাছ থেকে ছবিটা দেখছিল। উজ্জ্বল গেরুয়া রঙের পোশাকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে ম্যামকে।

পোশাকের রঙের দীপ্তি যেন চোখে মুখেও ফুটে উঠেছে। ম্যামের জায়গায় টিয়াকে কল্পনা করছিলো সৌমী। টিয়াও হয়তো কোনোদিন এভাবেই মঞ্চে উঠে পুরস্কার নেবে। একটা মৃদু গলা ঝাড়ার শব্দে সম্বিত ফিরলো তার । টিয়ার সাথে ম্যামও বেরিয়ে এসেছেন স্টাডিরুম থেকে।

টিয়া লম্বা লম্বা পায়ে মায়ের কাছে

- "মা জানো, ম্যামের আমার এই স্কার্টটা খুব ভালো লেগেছে। আমি ম্যামকে বলেছি এটা তুমি স্টিচ করেছো"।

একটু অপ্রস্তুত বোধ করছিল সৌমী। টিয়ার এখনও জ্ঞান হলো না কোথায় কি বলতে হয়। মেয়েকে মৃদু ধমক দিলো সৌমী।

- "আহ, টিয়া। পড়ার বাইরে কথা বলতে ম্যাম বারণ করেছেন না"?

- "আমি নিজে থেকে কোথায় বললাম। ম্যাম তো আমায় জিজ্ঞাসা করলেন। তাই না ম্যাম"?

টিয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ম্যামের মুখের দিকে।

- "হ্যাঁ, আমিই ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম"। একটু হেসে রমনা ম্যাম বললেন।

"টিয়া তুমি স্টাডিতে গিয়ে একটু ফর্মুলাগুলো রিভাইস করো। আমি ততক্ষণ তোমার মায়ের সাথে একটু কথা বলেনি"।

টিয়া চলে যেতে, সৌমীর দিকে ফিরলো রমনা। 

- "আপনি দাঁড়িয়ে কেন? প্লিজ বসুন"।

সৌমী বসলে কাজের মেয়েটিকে ডেকে দু কাপ কফি দিতে বললো রমনা।

সৌমী দেখছিল রমনাকে। নীল রঙের একটা লং ফ্রক পরে আছে রমনা। ওনার ফর্সা রঙে নীল রঙটা যেন আরও খুলেছে। ম্যানিকিওর করা হাতে হালকা গোলাপী নেলপেন্ট লাগানো। নিখুত সুন্দরী যাকে বলে। নিজের ক্ষয়ে যাওয়া নেলপালিশওয়ালা আঙ্গুলগুলো ওড়না দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করলো সৌমী। মোবাইলটা নিয়ে একটু খুটখাট করে সেন্টার টেবিলে রেখে দিলো রমনা। সৌমীর দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়েছে।

- "টিয়ার স্কার্টের এমব্রয়ডারিটা আপনার করা, টিয়া বলছিল"।

- "হ্যাঁ, ওই একটু অবসর পেলে একটু আধটু সেলাই নিয়ে বসি"। 

- "আপনি এটাকে একটু আধটু বলছেন! এত সুন্দর হাত আপনার। আপনি ছবি আঁকেন"?

- "ছোটবেলায় সবাই যেমন শেখে তেমনই শিখেছিলাম। তারপর আর...."

- "তারপর বিয়ে হতেই সব অভ্যাসে জং ধরে গেলো তো? এই হলো আপনাদের সমস্যা। সংসার সংসার করে নিজেদের প্রতিভাগুলোকে আর ঘষা মাজাই করেন না"।

রমনার স্বচ্ছন্দ ব্যবহারে ধীরে ধীরে আড়ষ্টতা কাটছিলো সৌমীর। বললো 

- "মায়ের কাছে শিখেছিলাম এমব্রয়ডারি। এক সময় লতা,পাতা,ফুল দিয়ে রুমাল, টেবিল ক্লথ ভরিয়েছি। বিয়ের পরও কিছু কিছু করেছিলাম। তারপর টিয়া হলো আর এ বাড়িতে কেউ তেমন উৎসাহও দিলো না। সময়ের সাথে সাথে কখন যে সব চাপা পরে গেলো নিজেও জানি না। টিয়ার এই স্কার্টটা স্কুলে আর লাগছিল না। ভাবলাম এত সুন্দর স্কার্টটা পড়ে থেকে থেকে ছোট হয়ে যাবে। তাই একটু এমব্রয়ডারি করে দিলাম"।

- "দেখেছেন তো প্রতিভা কখনো চাপা থাকে না। আজ আমি জেনে গেলাম। এরপর হয়তো আরও অনেকে জানবে"।

লজ্জা লজ্জা মুখে হাসল সৌমী।

- "উহু, শুধু হেসে এড়িয়ে গেলে চলবে না। আমাকেও ওরকমই এমব্রয়ডারি করে দিতে হবে। তবে সেটা স্কার্টে নয়, আমার একটা সিল্কের শাড়িতে"।

- "আমি তেমন ভালো পারি না। দামী শাড়ি, হয়তো নষ্ট করে ফেলবো"। সৌমী আমতা আমতা করে।

- "নষ্ট হবে কিনা সেটা আমি বুঝব। এখন আপনি রাজি কিনা বলুন"।


#দুই


মহালয়ার সকালে এক বাক্স মিষ্টি আর এমব্রয়ডারি করা শাড়িখানা নিয়ে সৌমী রমনা ম্যামের বাড়ির ডোরবেলে হাত রাখলো।


শাড়িটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো রমনা। মাথার মধ্যে কেউ যেন হাতুড়ি মারছে। এই রকম একটা প্রতিভা নিয়ে একজন মানুষ দিনের পর দিন রান্নাঘর আর শোবারঘরের মধ্যেই জীবন অতিবাহিত করছে! গত একমাসে বেশ কয়েকবার সৌমীর সাথে তার দেখা হয়েছে। সৌমী সরাসরি না বললেও রমনার বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে সৌমী একরকম জোর করেই নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছে বোধগুলোকে মনের গভীরে বন্ধ করে রেখে দিয়েছে। তার চোখে মুখে বেদনার ছাপ স্পষ্ট। 

সৌমী জড়সড় হয়ে সোফার এক কোণে বসে। শাড়িটা হাতে করে সৌমীর পাশে এসে বসলো রমনা। মুগ্ধ চোখে দেখছে সৌমীকে।

- "তুমি নিজেও বোধ হয় জানো না তুমি কি সৃষ্টি করেছো। অপূর্ব"। স্তব্ধতা ভেঙে বলে উঠলো রমনা।

এক নিমেষে সৌমীর মুখে যেন হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে উঠেছে।

- "সত্যি ভালো লেগেছে তোমার"?

- "অপূর্ব হয়েছে। তুমি নিজে বোঝোনি"?

- "আমি ভেবেছিলাম তোমার হয়তো পছন্দ হবে না"। সৌমী হাত চেপে ধরলো রমনার।

- "এটা যার পছন্দ হবে না, সে অন্ধ"।

ব্যাগ থেকে মিষ্টির বাক্সটা বের করে সৌমী

- "এটা তোমাদের জন্য। আমি এবার যাই গো। ওর তর্পণ করে ফেরার সময় হয়ে গেছে। ফিরে এসে আমায় বাড়িতে না দেখলে...."

রমনার হাতে মিষ্টির বাক্সটা ধরিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালো সৌমী।

- "একটু দাঁড়াও সৌমীদি"। সৌমী ঘুরে দাঁড়াতেই রমনা একটা সাদা খাম এগিয়ে দিয়েছে সৌমীর দিকে। "এটা রাখো"।

- "কি এটা?" সৌমী অবাক চোখে তাকায়।

- "খুলে দ্যাখো"।

সৌমী খাম খুলতেই বেশ কটা পাঁচশো টাকার নোট বেরিয়ে আসে। 

- "একি, না না। আমি টাকা নিতে পারবো না তোমার থেকে"।

- "কেন নিতে পারবে না? এই শাড়িটার জন্য তোমার যে কতটা পরিশ্রম হয়েছে আমি নিজের চোখে তা দেখেছি সৌমীদি। আমি যখন তোমাদের ছেলেমেয়েদের পড়াই আমি পারিশ্রমিক নেই না? তাহলে তুমি নিলে অসুবিধা কোথায়? এই রঙিন কাগজগুলোই তোমায় এগিয়ে চলার প্রেরণা দেবে। তোমায় প্রতিষ্ঠা দেবে। তখন না হয় তুমি আমায় একটা শাড়ি গিফ্ট কোরো কিন্তু আজ তোমায় তোমার পরিশ্রমের মূল্য নিতেই হবে"।


হাতের মুঠোয় খামটা চেপে বাড়ি ফিরছিল সৌমী। এতক্ষণ ভারী লজ্জা করছিল তার। এবার অদ্ভুত একটা মনের জোর পাচ্ছে। কেউ যেন বুকের ভিতর থেকে বলে চলেছে "তোর প্রথম রোজগার সৌমী, দ্যাখ ইচ্ছা করলে তুইও পারিস। ছোট ছোট খুশির জন্য আর তোকে কারুর কাছে হাত পাততে হবে না"। 


আজ সপ্তমী। টিয়াকে নিয়ে সৌমী বাবার কাছে এসেছে। দুদিন থাকবে এখানে।

এতক্ষণ বাবার ঘরে সবাই মিলে হইচই করছিলো। পাড়ার প্যাণ্ডেলে ঢাকের শব্দ পেতেই রনি, বনি আর টিয়া সেখানেই ছুটেছে। বৌদিও পুজো দিতে বেরোল। সৌমীকে বাবার দায়িত্ব দিয়ে দাদাও বেড়িয়ে গেল বন্ধুদের আড্ডায়। বাড়িটা খালি হতে বাবার পায়ের কাছে এসে বসলো সৌমী। শীর্ণকায় পায়ে হাত বোলাচ্ছে পরম মমতায়। সোমেন অবাক হলো সামান্য

- "কি হয়েছে রে খুকু ? বলবি কিছু"?

-"তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি বাবা।

বলো দেখে রাগ করবে না"?

হেসে ফেলে সোমেন

- "বেশ। করবো না রাগ। এখন বল দেখি কি এমন জিনিস"।

- "খুলে দ্যাখো তবে"।

খাদি ভাণ্ডারের প্যাকেটটা বাবার কোলের ওপর রাখে সৌমী। প্যাকেট খুলতেই চমকে ওঠে সোমেন

- "এটা তো একদম আমার সেই..."

- "তোমার সেই পাঞ্জাবীটার মতো না বাবা? যেটা পোকায় কেটে দিয়েছিল"।

- "হ্যাঁ এক্কেবারে সেটাই তো। কিন্তু এত দামি পাঞ্জাবী তুই আনলি কেন খুকু? সুমন্ত কি ভাবলো বলতো। আমি মানুষটা চলতে অবধি পারি না। তার জন্য...."

বাবাকে থামিয়ে দেয় সৌমী।

- "এটা সুমন্ত আনেনি বাবা। আমি এনেছি। আমার নিজের টাকা দিয়ে"। 

- "তোর টাকা"?

- "হ্যাঁ বাবা"। থেমে থেমে পুরো ঘটনাটা বাবাকে বললো সৌমী। 

- "এবার বলো কাল পাঞ্জাবীটা পরবে"। 

- "আমার মেয়ে এনেছে আর আমি পরব না, তাও কি হয়"? চোখের কোণটা চিকচিক করছে সোমেনের। 

- "কাল তোমায় পাড়ার প্যন্ডেলে নিয়ে যাবো বাবা। দু বছর হয়ে গেলো পুজোয় মায়ের মুখ দেখোনি"। 

- "দেখছি তো"। 

- কোথায়?

- "এই যে আমার সামনে বসে আছে। এই তো আমার আসল মা"।

বাবার কোলে মুখ গুঁজে দিলো সৌমী। 

পুঞ্জিভূত যন্ত্রনা গলগল করে বেড়িয়ে আসছে অশ্রু হয়ে। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো সোমেন। বাবার স্পর্শটা চারিয়ে যাচ্ছিলো হৃদয়ের গভীরে। ধীরে ধীরে জুড়িয়ে আসছে সব জ্বালা। আজ সব কিছু বড্ড সুন্দর লাগছে সৌমীর। তাদের বাবা মেয়ের ভালোবাসায় পলেস্তরা খসা ঘরখানাও যেন বড় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে আজ। 

দূর থেকে ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসছিল।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational