গ্রামটির নাম পৃথিবী
গ্রামটির নাম পৃথিবী


মকবুল বসে বসে ভাবছে কত কথা...। কিছুদিন আগেও তো এমনটি ছিল না। পৃথিবীর গায় এ কার অভিশাপ লাগলো! রক্তাক্ত কালো হাত যেন ক্রমশঃ গ্রাস করছে পৃথিবী নামক গ্রামটিকে। মকবুল নদী থেকে মাটি নিয়ে পাহাড়ে কোলে বসে কত রকমের মূর্তি বানাত। যিশু, রাধাকৃষ্ণ, গনেশ, ছোট ছোট বরবউ আরো কত না পুতুল....! যেখানেই মেলা হত সেখানেই সাজিয়ে বসত। চোখের জলে নাকের জলে একশা ছেলেটি মা'য়ের আচল টানতে টানতে এসে মা'কে দেখিয়ে দিল যিশু-পুতুলটির দিকে। মা আচলের খুট খুলতে খুলতে বলে..... কত দাম গো ভাই... ভাই ডাক শুনে মকবুলের বুকের ভিতর কেঁদে ওঠে। সেই দেশ ভাগের পর থাকে আর কেউ কিছু বলে ডাকে না। অনেকে তাকে পাগল ভাবে। কারণ তার হাতের তৈরি পুতুল একটাও নিখুঁত নয়, কোনোটার নাক বোঁচা তো কোনোটার হাত মোটা...না তো মুখ ব্যাকা, এসবের খেয়াল নেই মকবুলের। অনেক মেলায় তার একটা পুতুলও বিক্রি হয় না। তা হোক তাতে তার কিছু যায়আসে না। কিন্তু এখন মকবুল অজানা আশংকায় ভীত। পৃথিবী গ্রামে এখন যে ব্যাটারি দেওয়া কলের পুতুলে ভরে গেছে। চাবি দিয়ে ছেড়ে দিলেই সেই সব পুতুলের গা থেকে নানান শব্দ! বোমা বারুদের মত আগুন ছিটকে আসছে...! তা দেখতে গিয়ে সবাই তার মাটির পুতুলের ঝুরি পা দি মাড়িয়ে গেলো..... সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল এই নতুন পৃথিবীর দিকে। একটি ছোট্ট মেয়ে পথ হারালো। মকবুল ভাঙা পুতুলগুলি সব ঝুরিতে তুলে মেয়েটির কাছে এলো... - তুমি কি একা এসেছিলে মেলায়! - না। অনেক মানুষের সাথে এসেছিলাম..... ওদের হুস নেই..... যে আমিও সঙ্গে ছিলাম। - তোমার নাম কি? - মানবী.... বাবা! তোমার সব পুতুল তো ওরা ভেঙে দিল! বাবা ডাক শুনে মকবুলের দুচোখে জলের ধারা বইতে লাগলো। -সে দিক ভেঙে। এই তো আমার পুতুল...! বলে জড়িয়ে ধরলো মানবীকে। সে কি পারবে আর কলের পুতুলের সঙ্গে পাল্লা দিতে। তাই মানবীর হাত ধরে হাঁটতে লাগলো। হঠাৎ মনে হলো তার সে আবার মাটি দিয়ে নতুন মূর্তি বানাবে.... কিন্তু কতবছর ধরে সে এভাবেই হেঁটেচলেছে... সে নিজেই জানে না। হাঁটতে হাঁটতে দেখা হয়েছিল খ্রিষ্টান বাচ্চা ছেলেটি সঙ্গে জাত না জানা কত ছোট্টছোট্ট মানবীদের সাথে। ক্লান্ত মকবুল আর পাল্লা দিতে পারলো না কলের পুতুলদের সাথে। পাহাড়ের কোলে এক বটগাছের ছায়ায় ক্লান্ত দেহকে শুইয়ে দিলো। কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়ে ছিল...... জানে না। শুধু মনে হলো..... সেই ছোট্ট মেয়েটি, ছোট্ট ছেলেটি ফুল আর প্রদীপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার মাথার কাছে। একসময় মনে হলো পৃথিবী-গ্রামের জাতিধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষ তার সারা গা ফুলে ফুলে ঢেকে দিয়ে শ্রদ্ধা জানালো। কারা যেন চিৎকার করে বলছে... "মকবুল! আমরা যন্ত্রমানব নই.... আমাদের ধর্ম মানবধর্মই"।