দূরদর্শী শিক্ষা
দূরদর্শী শিক্ষা
তোর বিয়েটা হয়ে গেলেই আমার মুক্তি। - মা! মেয়েদের বিয়েটা কি খুব জরুরি? বিয়ের পর যে জীবনটা তুমি বয়ে নিয়ে চলেছো....! - চুপ কর। তোর জীবনে এমন ঘটনা ঘটবে না। তোরা আজকালকার মেয়ে। তোরা কেন চুপ করে থাকবি! - মা! মনিমাসির মুখে শুনেছি ..... তুমি নাকি এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিবেটে যুক্তির শানিত ছুরিতে প্রতিপক্ষকের বক্তব্যকে চুরমার করে দিতে। রাধা চায় না মেয়ে রিনিকের মন পুরুষ জাতির প্রতি বিষিয়ে যাক। সব পুরুষ তো আর রুদ্রদীপ নয়। রিনিকের বয়স কুড়ি। পাঠক পাঠিকারা নিশ্চয়ই বুঝবেন..... এই বয়সের মেয়েদের চিন্তার জগতটা থাকে ভীষণ রোমান্টিক। সে ট্যাডিশন বলুন বা হরমোনের প্রভাব। কামনায় থাকে এক স্বপ্নের রাজপুত্রের সান্নিধ্য। আর থাকে কিছু লুকানো বোকামি। রিনিকের স্বভাব এর বাইরে নয়। কিন্তু রিনিক বিয়ে করতে চায় না..... মা'কে দেখে। ..... আচ্ছা রোজ মা অত রাত পর্যন্ত জেগে কি করে? তার কি মা'য়ের প্রতি কোনো কর্তব্য নেই! তবে সেও কি ভীষণ আত্মকেন্দ্রিক। সে কি শুধু নিজের কথাই ভাবে.... তুহিনের সাথে দুদিন দেখা না হলে, তিনদিনের দিন ওদের বাড়ি চলে যায়। তবে মা বাবার সম্পর্কের মধ্যে এত শিথিলতা কেন, তা নিয়ে তো কখনো ভেবে দেখেনি! তবে কি সে ভীষণ স্বার্থপর! না কি বাবা তার কোনো অভাব রাখেনি বলে? ..... সারারাত চিন্তা করতে করতে ঘুম এলো না রিনিকের। মা তো বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকস ছাত্রী ছিল। মনিমাসি বলেছিল, সেই সময়ই নাকি বাবার সাথে মা'য়ের পরিচয় হয়। তবে আজ কেন মা নিজেকে চারদেয়ালের মধ্যে নিজেকে বন্দী করে রেখেছে! হঠাৎ একদিন আচমকাই মা'য়ের ঘরে ঢুকে পড়ে রিনিক.... জানলার দিকে মুখ করে মা দাঁড়িয়ে। বাঃ, জানলা থেকে বাইরে দৃশ্যটা তো খুব সুন্দর লাগছে.....! নীল আকাশ, অলস চিলের ওড়াউড়ি।..... আরো দূরে সবুজ গাছের সারি। হঠাৎ রিনিকের মনে হলো সে যেন চারদেয়ালে ঘেরা কারাগারে বন্দী। বন্দী ঘরের চাবিটা তুহিন নিয়ে চলে যাচ্ছে.......। - তুহিন! হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো রিনিক। আচমকা রিনিকের চিৎকার শুনে ভয় পেয়ে গেলো রাধা। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। - কি হয়েছে রিনি! তুই কলেজ জাস নি! কিছু হয়েছে কলেজে! রিনিক বুঝতে পারে, মা তুহিনের নামটা শুনতে পায় নি।.... ' না, মানে তোমার ঘরে ঢুকতে গিয়ে দরজার লাগানো তালাতে খুব জোর ব্যাথা পেলাম। তুমি কি দেখছিলে মা জানলা দিয়ে! - কিছু না। কি বলবি বল? মা'য়ের দু চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করলো...... ' তুমি কাঁদছিলে কেন মা!' রাধা বুঝতে পারলো.. ভুল তারই। মেয়ে মা'য়ের পিছনে দাঁড়িয়ে! এটা তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানতে পারে নি! বুঝতে পারে রাধা সে এক ভয়ংকর পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মেয়ে রিনিক কোনো ডিবেটে যায় না। চুপচাপ পড়াশোনা আর মা। তুহিন বিয়ে করবে আরো একবছর পর। এই প্রেম নিয়েও সে কারো সাথে আলোচনা করে না। বাবাকেও কোনো দিন প্রশ্ন করে নি..... মা'কে নিয়ে কেন বিজনেস টুরে যায় না! রাধা একটা খাম নিয়ে রিনিকের হাতে দেয়। খামটা খুলতে সাহস পায়নি। যদি মেয়ে রাগ করে! - মা! খামটা তুমি খুলে দেখলে না....! মেয়ের নামে খাম আর তোমার একটুও কৌতুহল হলো না! মেয়ে যদি তোমার খারাপ পথে চলে যায়...! তখনো কি তুমি নির্লিপ্ত থাকবে! - আমি জানি, আমার মেয়ে কোনো খারাপ ডিসিশন নিতে পারে না। - মা! তোমার কটা কাপড় দাও তো, - আমার কাপড় দিয়ে কি করবি! - পালিয়ে বিয়ে করবো। - কি যা তা বলছিস রিনি! সত্যি, তুই পালিয়ে বিয়ে করবি! তোর বাবাকে কেন বলছিস না...! তোর বাবা অমত করবে না। সোনা মেয়ে আমার! এ সব করিস না! - তুমি তোমার কাপড় দেবে কিনা বলো! না দিলেও আমি পালিয়ে যাবো। - তোর বাবাকে আমি কি বলবো! আমার যে আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। - তুমি এমনিতেও মোরেই আছো। আবার নতুন করে মরার তো কোনো কারণ দেখি না! এই মেয়েটা রাধার! যাকে বুকে আগলে কুড়িটা বছর মুখ চুপ করে বেঁচে রইলো.... তবে কি রিনিক ওর
বাবা রুদ্রদীপের মতই হলো....! রাতে একা বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাধা কেঁদে বুক ভাসালো। ঘুম ভাঙলো গাড়ির আওয়াজে..... রিনিক রিনিক বলে চিৎকার করে উঠলো। - মা! আমার সঙ্গে যাবে! কালিঘাট.... বিয়েটা ওখানেই হবে। তারপর তোমাকে গাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেবে। রাধা ভাবলো.... যাক, এই সুযোগে সে চিরতরে বাড়ি ছাড়বে, না জানতে পারবে মেয়ে না জানতে পারবে রুদ্রদীপ। ঘরে গিয়ে আলমারি থেকে তার প্রিয় জিনিসটা আনতে গিয়ে খুঁজেই পেলো না। ওদিকে রিনিক গাড়িতে হর্ণ দিচ্ছে। গাড়িতে বসে রাধা মেয়ের সাথে একটা কথাও বললো না। গাড়ি ছুটে চলেছে। অনেকক্ষণ বাদে জিজ্ঞাসা করলো.... ' তুই যাকে বিয়ে করবি সে কোথায়? আর কে কে আছে ছেলেটার...! কি রে কালিঘাট তো বেশি দূর না! অনেক দিন আগে এসেছিলাম! এ কোন রাস্তা!.... অবশেষে গাড়ি থামলো। সামনে সুন্দর একটা বাংলো। - মা! নেমে আসো। রাধা আস্তে আস্তে মেয়ের পিছন পিছন চললো.... - দিদিমণি! এই আপনার ঘর, আর ঐ হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রম। রাধা অবাক.... তবে কি রিনিক আমায় বৃদ্ধাশ্রমে রাখতে এসেছে!!!!! - মা! এই নাও কাপড় স্নান করে তাড়াতাড়ি চলে এসো। আমিও স্নান করবো। পরদিন সকালে রিনিক মা'কে সুন্দর সাজিয়ে গুছিয়ে নিলো, নিজেও পরলো নীলপাড় সাদা শাড়ি। সুধাময়ী শান্তিনিকেতনে সেবিকার কাজ নিয়ে রিনিক জয়েন করেছে। ফর্মে লেখা ছিলো.... অবিবাহিত নির্ঝঞ্ঝাট সেবিকার প্রয়োজন। রাধা অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবে.... সে কি পারতো এত বড় স্বার্থত্যাগ করতে! মেয়েকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলো রাধা। - মা! আমি তোমার ডায়েরি টা বাবাকে গিফট করেছি। বলেছি.... 'আমি ভালো চাকরি পেয়েছি, তাই তোমায় একটা সুন্দর ডায়েরি দিতে চাই।' বাবা তো খুব খুশি। আমাকে অনেক আদর করলো। বললো আমায় একটা গাড়ি কিনে দেবে, সেটা করে আমি রোজ অফিস যাবো। রুদ্রদীপ বাড়িতে ঢুকেই রাধা রাধা করে ডাকলো। একি বাড়িটা অন্ধকার কেন? রিনিক কলেজ থেকে ফেরেনি! না, কেউ কোথাও নেই। নিশ্চয়ই মা মেয়ে দুজনেই বেড়িয়েছে! নিজের ঘরে গিয়ে আগে এক পেগ খেয়ে নিয়ে জামাপ্যান্ট ছাড়তে যাবে.... মেয়ের দেওয়া ডায়েরিটা চোখে পড়লো। একটু রিলাক্স হয়ে বসে ডায়েরির ভাঁজ খুললো.... একি......! এ তো দেখছি পুরনো ডায়েরি! কুড়ি বছর আগের....! প্রথম পাতা খুলেই.......! 'রিনিক! মা আমার তুই পেটে এলি বলে এ জীবন শেষ করলাম না। যদি ছেলে হতো..... তবে এ ডায়েরি লিখতে বসতাম না! ....... আর আমি চাই না তোর বাবার প্রতি তোর অশ্রদ্ধা থাকুক। এ কষ্ট আমি একাই টেনে বেড়াতে চাই। তাই ডায়েরি লুকিয়ে লিখি। একজন বিজনেস পার্টার, যাকে তুই ছোট বেলায় খুব ভালো বাসতিস। সেই ঠাকুরপোকে ঠকালো এমন ভাবে! সে সুইসাইড করতে বাধ্য হলো। পারলাম তোর বাবাকে ধরিয়ে দিতে.... শুধু তোর জন্য রিনিক! কন্ট্রাক্ট হাসিল করতে গিয়ে.... মদ থেকে মেয়ে সাপ্লাই..... কি না করেছে.... শুধু তোকে নিজের পা'য়ে দাঁড় করাতে চাই। আমার মতো লেখাপড়া শিখে ঘরে বসিয়ে রাখবো না! তুই চাকরি করবি! তারপর বিয়ের কথা ভাববি রিনিক...! আমি সব জানিয়ে দিলে তোর বাবা অন্য ফ্লাটে চলে যাবে। তাই তোকে সব সব আড়াল করলাম। তীব্র জ্বালা নিয়ে আমি মারাত্মক বিষ সংগ্রহ করে রেখেছি। শুধু তোর চাকরি পাওয়ার অপেক্ষায়। আর সেই মারাত্মক বিষ এই ডায়েরির মধ্যেই আছে.... তাই তো আলমারির চাবিটা সব সব সময় লুকিয়ে রাখি। তুই কিন্তু আমার মৃত্যুর পর বাবাকে ধরিয়ে দিস না। আমি যে তোর বাবাকে ভালবেসে বিয়ে করেছি৷ একদিন তো তোর বাবার জন্য সব ছেড়ে এসেছি! সে তো ভালবেসেই..... রুদ্রদীপ আতিপাতি করে খুজলো সেই মারাত্মক বিষ পটাশিয়াম সায়ানাইড। এদিকে রাধা তার পঁচিশ বছরের বিবাহিত জীবনে যে শিক্ষা অর্জন করতে পারেনি! কুড়ি বছরের মেয়ে, মা বাবার জীবন থেকে নেওয়া অভিজ্ঞতার শিক্ষায় নিজেকে এমন শিক্ষায় সমর্পণ করলো! ....... একদিন সে 'সুধাময়ী শান্তিনিকেতন' বৃদ্ধাশ্রমের সবার 'মাদার রিনিক ' হয়ে উঠলো।