এক সান্টা আর ধর্মেরা
এক সান্টা আর ধর্মেরা
[
এলগিন মোড়ে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। হাঁটার পথটা পেরিয়ে এসে আমার প্রিয় বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। এদিক ওদিক দিয়ে নানারকম যানবাহনের আপন গতিতে ছুটে চলা দেখতে বেশ ভালোই লাগে এই সময়টা। পাশে নানা লোকজনের নানা রকম মুখের ভাজ দেখতে আরও ভালো লাগে। মুখের ভাঁজ গুলো অনেক রকমের হয়। যেমন বাস দেরি করে আসার একরকম ভাঁজ আবার বাস মিস হয়ে যাবার আর এক রকম ভাঁজ। নানা-রকম ভাঁজের মাঝে নিজেকেও গুলিয়ে ফেলি মাঝে মাঝেই। কারণ আমারও বিরক্ত লাগে বাসের জন্য দশ মিনিটের বেশি দাঁড়াতে।
আজ সেই বিরক্তিই হচ্ছিল। প্রায় পনের মিনিট দাড়িয়েও বাসের দেখা পাচ্ছি না। মনে মনে রাগও ধরছে। পাশে একজন আমার মতই ছেলে দাঁড়াল এসে। দেখে বেশ ভালো পরিবারেরই মনে হল। পুরো ফরম্যাল ড্রেস পড়ে, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে। মনে হল ছেলেটা কারোর অপেক্ষা করছে। এদিক ওদিক বারবার দেখছিল।
কিছুক্ষন পর আর একটা ছেলে এল ওপার থেকে। তাকে দেখেই ছেলেটার মুখে একটা অজানা হাসি ফুটে উঠল। চোখ দুটো যেন আশায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ওপার থেকে আসা ছেলেটি বলল “ কি রাহুল কেমন আছিস?” বুঝলাম ছেলেটার নাম রাহুল।
রাহুল বলল “ভালো আছি দাদা। তুমি কেমন?”
ছেলেটি বলল “ভালোই আছি। যা পরিস্থিতি। বল কেন ডেকেছিস? সব ঠিক আছে তো?”
রাহুলের মুখের হাসিটা যেন মূহুর্তে উধাও হয়ে গেল। মুখটা নীচের দিকে করে বলল “ দাদা একটা হেল্প করতে পারবে?”
ছেলেটি বলল “ বল, চেষ্টা করব।“
রাহুল বলল “ এবারের ক্রিসমাসে মেয়েটা বিশ্বাস করে আছে ওর সান্টাক্লস ওকে একটা বড় ডল গিফট করবে। ওই সেদিন বাইরে বেড়িয়ে বড় একটা টেডি দেখেছিল। কেনার বায়না ধরেছিল আর আমি বলেছিলাম ক্রিসমাসে সান্টাক্লস এই টেডিটা ওঁকে গিফট দেবে। আর কাল টিভিতে দেখেছে যে পরশু ক্রিসমাস। আশা নিয়ে বসে আছে মেয়েটা। কিছু টাকা ধার দিতে পারবে দাদা?“
ছেলেটি সব শুনে বেশ অবাক হল। আমার অন্তত ওঁর মুখটা দেখে তাই মনে হল । এদিকে আমার বাসও আসছে না। কুড়ি মিনিট হয়ে গেছে দাঁড়িয়ে আছি। তবে মনে মনে ভাবছি বাসটা যেন আর একটু দেরি করেই আসে। কেন জানিনা একটা অজানা কৌতুহল কাজ করছিল জানার জন্য। রাহুল কি পারবে তার মেয়ের সান্টাক্লস হতে !
ছেলেটি রাহুলের পিঠে হাত্ দিয়ে বলল “ কত টাকা?”
রাহুল বলল “ ১৭০০ টাকা।“
ছেলেটি পকেট থেকে সঙ্গে সঙ্গে একটা দু-হাজার টাকার নোট বের করে রাহুলের হাতে দিয়ে বলল “ এবার আসল কথাটা বল। তোর থেকে আমি টাকা ধার নিতাম আজ তুই আমার থেকে টাকা চাইছিস! কি ব্যাপার?”
রাহুলের চোখদুটো ছলছল করে উঠল। ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল “ চাকরিটা আর নেই দাদা। লকডাউনের একমাস পর থেকেই বসে আছি। প্রিয়াকে নিয়ে মেয়েকে নিয়ে যাই হোক করে চলছিল এই কয়েকমাস। এখন তো আর একদম চলছে না। তাই একজনের হাতে-পায়ে ধরে একটা সিকিউরিটি গার্ড এর জব নিয়েছি এই এক সপ্তাহ হল। “
ছেলেটি রাহুলের মুখের দিকে এত স্নেহ ভরে তাকাল। কোন নিজের লোকও বোধহয় ওইভাবে তাকায় না। মিনিট দুই চুপ থেকে ছেলেটি বলল “ শোন ভাই, যখন যা দরকার হবে আমাকে ফোন করবি। আমি দেখি মালিককে বলে কোন ব্যাবস্থা করতে পারি কিনা। কোন চিন্তা করবি না। একদিন আমাকে দেখেছিস তুই। কত করেছিস আমার জন্য। আজ তোর জন্য কিছু করতে পারলে আমার ভালোই লাগবে। একদম চিন্তা করিস না। তোর আনোয়ার দা এখন বেঁচে আছে। আমি থাকতে ভাবী আর মুন্নির কোন জিনিসে কমতি হতে দিবিনা।“
রাহুল আর নিজেকে রুখতে পারেনি। আনোয়ারের হাত দুটো ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠেছিল। আর আমি দেখলাম এক হিন্দু সান্টা নিজের মেয়েকে গিফট দিতে এক মুসলিম মশীহার কাছ থেকে খ্রিস্টান ধর্মের উৎসব পালনের জন্য উপহার নিল। একসাথে তিনটে ধর্ম মিলে মিশে একাকার হতে দেখলাম আজ আমার এলগিন রোডে।
আমার বাস এসে গেল। মুখে একরাশ হাসি নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে বাসে উঠলাম। বাস এগিয়ে চলল সামনের দিকে। মনে মনে ভাবলাম এইভাবেই রাহুল আর আনোয়াররা মিলেমিশে খুশীতে ভরিয়ে দিক পৃথিবী। ভালো থাকুক বন্ধুত্ব।