STORYMIRROR

Sanghamitra Roychowdhury

Romance Tragedy

3  

Sanghamitra Roychowdhury

Romance Tragedy

এক করুণ প্রেম কাহিনী

এক করুণ প্রেম কাহিনী

6 mins
2.5K


দিল্লী নিজামুদ্দিন রেলওয়ে স্টেশনে অধৈর্য্য হয়ে পায়চারী করছে মধুজা, আজই কিনা আগ্রাগামী শতাব্দী এক্সপ্রেস একঘন্টা লেট হতে হোলো! ঋতুজা আগ্রা স্টেশনে অপেক্ষা করছে ওর জন্য, ছটফট করছে মধুজা, অনেক চেষ্টা করেও ঋতুজাকে মোবাইলে ধরতে পারছে না। দুটো টেক্সট মেসেজ করেছে, কিন্তু এখনো দেখে নি ঋতুজা। ট্রেন ছাড়ার অ্যানাউন্সমেন্ট এর সাথে সাথেই মন্থর গতিতে ট্রেন ঢুকছে দেখতে পেল মধুজা আর তার সাথেই গোটা প্ল্যাটফর্মে একটা চাঞ্চল্য পড়ে গেল। যে যার লাগেজপত্র নিয়ে নিজের নিজের কম্পার্টমেন্টের খোঁজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মধুজা মোবাইলে টিকিটের ডিটেইলস দেখে নিজের সিটটা খুঁজে নিয়ে বাঙ্কে ব্যাকপ্যাকটা তুলে দিয়ে আরাম করে গুছিয়ে বসল। এইসময়ই ঋতুজার মেসেজটা ঢুকল, ও আগ্রা স্টেশনে পৌঁছে শুনেছে শতাব্দী এক্সপ্রেস দিল্লী থেকে লেটে ছাড়ছে, তাই ঋতুজা ওর যে কলিগের বিয়ের রিসেপশন অ্যাটেন্ড করতে দুদিন আগে আগ্রা এসেছিল তাকে বলে একটা গাড়ি বুক করে নিচ্ছে, কফির সাথে হালকা ব্রেকফাস্টও করে নিচ্ছে। মধুজা যেন কোন টেনশন না করে, কোনো অসুবিধা হবে না।


মধুজা এবার নিশ্চিন্ত হয়ে চারপাশে চোখ বুলিয়ে সহযাত্রীদের দেখে নিল। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বিদেশি পর্যটক, কিছু বিভিন্ন প্রদেশের অবাঙালী এবং অবশ্যই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালী ভ্রমণ পিপাসু পরিবার ও দল।


মধুজা ট্রেনে দেওয়া কফি ও স্ন্যাকস দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শোনায় মন দিল। এই পথে বহুবার যাওয়া আসা করেছে মধুজা, কাজেই জানালার বাইরের দৃশ্য অতি পরিচিত, কোনো বৈচিত্র্য নেই এই ঘন্টা দুয়েকের যাত্রায়।


এবার মধুজা আর ঋতুজার পরিচয়টা জেনে নেওয়া যাক। এরা দুজন মাসতুতো বোন কম, বন্ধু বেশী। মধু আর ঋতুর একই দিনে জন্ম, এবেলা ওবেলা, তারপর এক ক্লাস, এক স্কুল, এক কলেজ, শুধু একজন মাসকম-জার্ণালিজম আর অন্যজন ইকোনোমিক্স। এরপর কাজের জগতে আবার দুজনে একসাথে দিল্লী প্রবাসী। মধুজা সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট এমপ্লয়ি ইউপিএসসি ক্র্যাক করে আর ঋতুজা একটি নামজাদা বাংলা দৈনিকের দিল্লী করেসপন্ডেন্ট। মধুজা সরকারি ফ্ল্যাটে থাকে, আর ঋতুজাও মাঝেমধ্যে ওর কাছে এসে থাকে কাজের চাপ কম থাকলে, আর কাজের চাপ যখন খুব বেশি থাকে তখন নিজের অফিসের শেয়ারিং ডেরায়। খুব মজা করে আছে দুজনে নিজের নিজের কাজের জগতে ব্যস্ততায়। সময় সুযোগ হলেই কোলকাতা থেকে দুজনের পরিবারেরই কেউ না কেউ ওদের কাছে দিল্লীতে এসে থাকে, কাজেই ওরা অনেক সময় বুঝতেই পারে না ওরা বাড়ি থেকে প্রায় পনেরোশো কিলোমিটার দূরে আছে।


মধুজা ও ঋতুজা বেশ কয়েকবার আগ্রা গেছে বন্ধু বান্ধবেরা মিলে। তাজমহল, আগ্রা ফোর্ট, আর অন্যান্য সব দ্রষ্টব্য দেখা হলেও প্রত্যেকবারই ফতেপুর সিক্রি বাদ পড়ে গেছে সবাই ফতেপুর সিক্রি যেতে রাজী না হওয়ায়। তাই এবারে পরপর তিনদিন ছুটি পেয়ে আর ঋতুজার আগ্রায় নিমন্ত্রণ এই দুই মিলিয়ে ওরা দুজনে ফতেপুর সিক্রি ঘুরে নেবার প্ল্যান বানিয়ে ফেলল। মধুজা ঘড়ি দেখল, ট্রেন লেটটা আরও খানিকটা বেড়েছে, আর ভেবে লাভ নেই, নির্ধারিত সময়ের থেকে সাকুল্যে প্রায় একঘন্টা পঞ্চাশ মিনিট দেরিতে ট্রেনটা অবশেষে হেলতে দুলতে আগ্রা ফোর্ট স্টেশনে ঢুকছে। মধুজা দরজা থেকে ঝুঁকে ঋতুজাকে দেখতে পেয়ে হাত নাড়ল।


মধু আর ঋতু দুজনে এককাপ করে কফি খেয়ে টুকিটাকি স্ন্যাকস কিনে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল।ওদের ব্যাগগুলো গাড়িতেই রয়েছে, ওরা ঠিক করেছে সারাদিন ঘুরে বেড়িয়ে একেবারে রাতেই হোটেলে চেক ইন করবে। গাড়ি ছুটছে ফতেপুর সিক্রির পথে, রুক্ষ পারিপার্শ্বিক, শুষ্ক আবহাওয়া, পরপর গাড়ি লাইন দিয়ে ছুটছে পর্যটক বোঝাই করে নিয়ে। ভীষন ধুলো, গাড়ির হর্ণ, এতো ভিড়.....এসবকে পাশ কাটিয়ে ওরা দুজন কল্পনায় ষোড়শ শতকে যোধাবাঈ আর সম্রাট আকবরের গেরস্থালির অন্তরঙ্গ কোণটিতে কিছুতেই যেন হারিয়ে যেতে পারছেনা।


স্থাপত্যে নির্মাণে ব্যাপ্তিতে অসাধারন, অতুলনীয়.... কোনো বিশেষণই যেন ঠিক যুৎসই নয়! মধু ঋতু দুচোখ ভরে দেখছে সব বাতায়ন-অলিন্দ-ঝরোখা-চবুতরা-লালচে পাথরে গড়া প্রাসাদ-মহল কত না সুখ দুঃখের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নির্বাক নিস্তব্ধ নিরিবিলি...... রাতে যখন একটি পর্যটকও থাকে না, যোধা-আকবরের স্মৃতি বুকে নিয়ে এই ফতেপুর সিক্রি প্রাসাদ একাকী জনশূন্য কখনো মায়াবী চাঁদের আলোয়, আবার কখনো বা চাপ চাপ জমাট অন্ধকারের নীরব সঙ্গী হয়ে।


প্রাসাদের কাহিনীর পরতে পরতে লুকিয়ে আছে প্রেম-বিশ্বাসঘাতকতা-রক্তক্ষয়-রহস্য-সঙ্গীত-প্রার্থণা- আজানের সুর-ঘুঙুরের ঠুমকা- পাখোয়াজের বোল-বাঁশীর সুর ধুন-সুরবাহারের মীর তান গমক-ললনার কলরোল-কঙ্কণ কিঙ্কিণী-নূপুর নিক্কণ-মুদ্রার খনখন-ঢাল তলোয়ারের ঝনঝন- পাকশালের সুঘ্রাণ-ধূপের ধোঁয়া-দীপের আলো- সৈনিকের ত্রস্ত ব্যস্ত পদচারণা-দস্তাবেজের খসখসানি-গোপন ষড়যন্ত্রের ফিসফিসানি ........ ঘুরপাক

খাচ্ছে ইতিহাসের পাতা ফতেপুর সিক্রির লাল পাথরের দেয়ালে দেয়ালে সোপানে সোপানে মহলের কোণে কোণে কুলুঙ্গিতে কুলুঙ্গিতে জমে থাকা প্রদীপশিখার কালিতে ........ঝাঁকঝাঁক পায়রার বকবকম আর ডানা ঝাপটানি, গা শিরশিরানি ঠান্ডা বাতাসের ঝলক, ঢলে যাওয়া সূর্যের মরা আলো জানান দিচ্ছে ইতিহাস থমকে আছে সম্রাট আকবরের ফতেপুর সিক্রি মুঘল প্রাসাদে।


মধু ঋতু ঘুরে ঘুরে ছবি তুলতে তুলতে সুফি মইনুদ্দিন চিস্তির দরগাহের পাশে চোখ আটকে গেল, গাইড ছোকরা তাড়া দিল, কিন্তু ঋতু ততক্ষণে বসে পড়েছে দরগাহের চাতালে। একটি অল্পবয়সী ছেলে ওখানে বসে একটা হলদেটে কাগজে একটা পায়রার পালকের সাদা কাঠিমতো অংশ একটা ছোট্ট দোয়াতে ডুবিয়ে ডুবিয়ে লালরঙে আঁকিবুঁকি কেটে চলেছে। ঋতু পটাপট ছবি তুলছে, তবে ছেলেটির সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, আপনমনে দূর আকাশে তাকিয়ে মাঝেমধ্যে বিড়বিড় করছে।

ঋতু হাত আর চোখের ইশারায় মধুকে বোঝালো সানডে স্পেশাল পেজের স্টোরি লাইন পেয়ে গেছে। ঋতু ছেলেটির সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করছে, মধু কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে, আর গাইড ছোকরা হাতের ইশারায় দেখালো ছেলেটি পাগল। ঋতু অসীম ধৈর্য্য নিয়ে ছেলেটির সাথে আলাপচারিতা চালিয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে ওর কথা ঋতু রেকর্ড করছে। এবার ছেলেটি ওর ওই হলদেটে কাগজের গোছা পাকিয়ে রোল করে পালক আর দোয়াতটা শতচ্ছিন্ন ময়লা আলখাল্লার কোনো পকেটে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত মার্জিত ভঙ্গিতে অভিবাদন জানিয়ে বিদায় সম্ভাষণ জানালো, মধুকেও আদাব জানিয়ে বিদায় নিলো। সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে ঈষৎ খুঁড়িয়ে ওর চলে যাওয়াটা মধু ঋতু দেখলো, অস্তগামী সূর্যের আলোয় বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে প্রাসাদের আরও কিছু ছবি তুলে গাইডের পারিশ্রমিক মিটিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি ছাড়ার ঠিক সময় গাইড ছেলেটি বললো, ওর দিমাগ খারাপ হলেও কাউকে কোনো পড়েশানী করে না।


গাড়িতে বসে টুকটাক কিছু স্ন্যাকস আর কোল্ডড্রিংকস খেয়ে, আরাম করে ‌বসে ঋতু রেকর্ডার অন করল। বিশুদ্ধ হিন্দি আর দুর্বোধ্য উর্দুতে যা বলেছে তার মর্মার্থ.....ও আমীর খসরু, ও কবিতা লেখে, তাতে সুর দেয়। এই পর্যন্ত যাহোক একরকম, এরপর থেকে শুরু হোলো শায়েরী উর্দুতে, এবং ২০১৮তে বসে আমীর খসরু নাকি আকবরের সভায় গান গেয়েছে, ঋতু মধু মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। মিলছে মিলছে না, টাইমলাইন একেবারে মিলছে না। ত্রয়োদশ শতকের শেষ থেকে চতুর্দশ শতকের প্রথম ভাগের আমীর খসরু, ষোড়শ শতকের আকবর আর একবিংশ শতকের বছর পঁচিশেকের আমীর খসরু সব মিলে মিশে একাকার হয়ে ইতিহাস একদম ঘেঁটে ঘ হয়ে গেছে। যাই হোক ঋতুর স্টোরিটা দাঁড়ালেই হোলো।


আগ্রা শহরে ঢোকার মুখে ঋতুর কলিগের ফোন। কলিগের মায়ের অনুরোধ হোটেলে ওঠা যাবে না, কষ্টসৃষ্ট করে তাদের বাড়িতেই থাকতে হবে। ঋতুর কলিগ ফোনেই ড্রাইভারকে পথনির্দেশ দিয়ে দিলো।

অগত্যা হোটেল বুকিং ক্যান্সেল করলো ঋতু এবং কলিগের বাড়িতেই উষ্ণ আতিথেয়তা গ্রহণ করলো।


রাতের খাওয়া দাওয়ার পরে মধু ঋতু আর ওর কলিগের পরিবারের সকলে মিলে ছাদে বসে জমিয়ে আড্ডা চলছে, একফাঁকে উঠে এলো ফতেপুর সিক্রির আমীর খসরুর কথা। শোনা গেল আমীর খসরুর জীবনের করুণ নেপথ্য কাহিনী।


বছর সাত-আট আগে উচ্চশিক্ষিত সম্পন্ন মুসলমান পরিবারের সুঠাম উজ্জ্বল মেধাবী ছেলে আমন আলমগীর আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিভাগের ছাত্র, আমীর খসরু আর ওমর খৈয়ামের অন্ধ ভক্ত। আরবি ফারসি ভাষায় সমান পারদর্শী, অদ্ভুত সুন্দর কবিতা.....শায়েরী লেখে খসরু ছদ্মনামের আড়ালে। বহু প্রশংসিত সে কবিতা, সহপাঠী সমবয়সী মেয়েরা সবাই ছেলেটির বিশেষ বন্ধু হতে চায়। ঠিক এরকম সময়ে ছেলেটি একটি বয়সোচিত ভুল করে বসলো। সমাজের চোখে পরিবারের চোখে সেই বয়সের ধর্মের ভুল হয়ে দাঁড়ালো অমার্জনীয় অপরাধ। অনেক বড় মাশুল দিতে হোলো ছেলেটিকে এক সহপাঠী হিন্দু মেয়ের গাঢ় নীল চোখের তারায়, ঘন কালো চুলে, ঝর্ণার মতো গলার স্বরে, ভালোবাসার প্রতিদানে ভালোবাসতে পারার ক্ষমতায় একেবারে হাবুডুবু হতে গিয়ে।


দুই পরিবারের কেউ মানলো না,মানতে পারলো না এই সম্পর্ক। শুরু হোলো কঠোর শাসন.....নির্মম অত্যাচার। একদিন ওরা পালিয়েছিল ফতেপুর সিক্রির দিকে। মাঝপথে ধরা পড়ে যায়....তারপর..... তারপর অনার কিলিং.....ওই মার মেয়েটি সহ্য করতে পারে নি.......মারা যায়। ছেলেটির প্রাণটা কোনোমতে বেঁচে যায় তবে মনটা বাঁচে নি। সেই থেকেই ফতেপুর সিক্রিতেই পড়ে থাকে, বাড়িতে আর ফেরানো যায় নি। মনটা তার ওলটপালট হলে কি হবে আজও সে ফতেপুর সিক্রির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায় আর প্রতিদিন..... হ্যাঁ প্রতিদিন নিজের শরীর কেটে টকটকে লাল রক্তরঙে তার নীলমের জন্য নতুন নতুন কবিতা লিখে যায়.......!


দিল্লী ফিরে ঋতু রবিবাসরীয় পাতায় এই কাহিনী লিখবে...... লিখবেই, জনচেতনা জাগরূক হবে কোনো দিন এই আশায়। ঋতুর হাত চেপে ভরসা জোগায় মধু।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance