SAYANTANI DHAR CHAKRAVARTI

Classics Inspirational

3  

SAYANTANI DHAR CHAKRAVARTI

Classics Inspirational

দত্তক

দত্তক

6 mins
292


।। দত্তক।। 

।।১।।

এতদিনের প্রচেষ্টায় আজ ফাইনালি C.F.O. হতে পারলো সুদিপ্ত, এই পোস্টটা পাওয়ার জন্য প্রচুর খেটেছিল ও। খবরটা পেয়েই অফিস থেকে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ল দীপ। প্রথমে রুমিকে সায়েন্স সিটি থেকে তুলে ‘homecare’, ওখানে কাজ সেরে বাড়ি। কিন্তু আকাশের যা অবস্থা টাইম মত সব কাজ হলেই হয়, দেরি হলেই আবার ‘homecare’ এর ভিজিটিং আওয়ার শেষ। 

।।২।। 

মহিমবাবুর সাথে দীপের সম্পর্কটা আজকের নয়, তা প্রায় নয় নয় করে ২৪-২৫ বছর হয়েই গেল, তখন আজকের সুদীপ্ত চ্যাটারজী ছিল না, তখন সে ছিল “ছোটু”-হ্যা এই নামের সবাই ডাকত ওকে। “রামপুরহাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের” পাশের করিমকাকুর চা এর দোকানে কাজ করত ৪-৫ বছরের ছোট ছেলেটা। দুপুর ১২ টা বাজলেই ইস্কুলের মাস্টারমশাই দের চা দিয়ে আসা অর প্রতিদিনের কাজ, আর এক্ একটা ও করত সে, লুকিয়ে লুকিয়ে ক্লাসের পড়া শোনা। ব্যাপারটা সকলের চোখে ফাঁকি দিলেও হেড স্যারের নজর এড়ায় নি।

।।৩।।

পুরনো দিনের কথা ভাবতে ভাবতেই, আচমকা ফোনটা বেজে উঠল , রুমির ফোন-

-“তুমি কোথায়, আমি সায়েন্স সিটির সামনে এসে গেছি”

-“ একটু দাঁড়াও আসছি” বলে ফোন কেটে আবার স্মৃতির সাগরে ডুবল দীপ।

সেদিন ছিল অর মাধ্যমিকের রেজাল্ট, সকাল থেকে কিছু না হলেও ১০-১২ বার খবর নিয়েছেন একে ওকে দিয়ে।তখন ত এত ফোন বা নেট ছিল না, অতএব সকাল সকাল জানার কোন উপায় ও নেই।বিকেল এ রেজান্ট জেনেই আগে ছুটে গিয়েছিল স্যারের বাড়ি। সেখানে সেদিন রীতিমত উৎসবের মেজাজ, স্যারের ছেলে সুবুদাদার বউভাত। গ্রামের ই কোন এক অল্পশিক্ষিত মেয়ের সাথে পালিয়ে বিয়ে করেছিল বি.এ. পাশ করে বইএর ব্যাবসাদার সুবীর, মহিমবাবুর একমাত্র ছেলে। মনে মনে অপমান, রাগ এবং গভীর দুঃখ সহ্য করেও মুখ থেকে একটি শব্দ বের করেন নি মহিমবাবু।মনের এই মেঘ সেদিন একঝটকায় গলে গিয়েছিল সুদীপ্তর রেজাল্টে।

।।৪।।

আবার ও ক্রশিং-এ আটকাল গাড়িটা, তার মধ্যেই রুমির বারংবার ফোন আর মেসেজ।আজ দিনটা অনেক স্পেশাল ছিল ওদের দুজনের কাছেই তাই বোধহয়, আর ধৈর্য ধরতে পাচ্ছিল না রুমি।একবার ফোনটা রিসিভ করে – ’১০ মিনিটে পৌঁছাচ্ছি” বলে আবার ও ডুবে গেল অতিতে। “ছোটু” থেকে সুদীপ্ত চ্যাটারজী অনেকটা রাস্তা। বাবা-মা কেমন ছিল মনে নেই , কিন্তু তার জন্য কোন আফসোস ও নেই দীপের, সে পর্ব সেদিন ই মিটে গেছিল যেদিন মহিমবাবু নিজের স্কুলেই ভর্তি করে দিয়েছিলেন আর নিজের বাড়ীর বাগানের ছোট ঘরটায় ওর থাকার ব্যাবস্থা হয়েছিল, সেদিন থেকে আজ অবধি স্যার ই ওর ভগবান। ও বাড়ীর অন্যসকলে দীপের আসাতে খুশি হলেও, কাকিমা আর সুবুদাদা মোটেই খুশি ছিলেন না। তার ৭-৮ ক্লাসেই থাকাকালীনই ছাত্র পড়িয়ে গ্রামেই অন্য এক জায়গায় ঘর ভাড়া করে থাকতে শুরু করেছিল ও। কিন্তু এতে ওর স্যারের প্রতি বা স্যারের ওর প্রতি ভালবাসা মোটেই কমেনি বরং দিন প্রতিদিন বেড়েই গেছে। 

।।৫।।

সেদিন ই প্রথম স্যারের চোখে জল দেখেছিল দীপ, উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট নিয়ে গিয়ে, ও বাড়ীতে তখন শোকের ছায়া, ওই দিনই চলে গেছিলেন কাকিমা স্যারকে ছেড়ে, অন্যজগতে।কিন্তু তা সত্বেও দীপের সেবছর কলকাতায় এসে বি.কম. এর ফিনান্স (honors)নিয়ে গোয়েঙ্কা কলেজে এডমিশন স্যারই করিয়েছিলেন, শুধু তাই নয় এমনকি স্যারের সাহায্যে আর নিজের অক্লান্ত পরিশ্রমে এম.কম. টাও করেছিল দীপ। তাই প্রথম চাকরী পাওয়ার খুশিটা ভাগ করে নিতে সেদিন রাতের ট্রেনেই দীপ ছুটে গেছিল গ্রামে। বাইরের ঘরে বসেই ভিরের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল দীপ, সুবুদার সাথে কলকাতায় যাওয়া নিয়ে বেশ জোর গলাতেই কথা বলছিলেন স্যার, যতদূর মনে হছহিল স্যার এই বয়সে অথাও জাওয়ার জন্য রাজী নয়। প্রায় মিনিট ১৫ বাদের স্যার ঘরে ঢুকতেই মিস্টি দিয়ে সুসংবাদটা দিল দীপ, একগাল হেসে স্যার অনেক আশীর্বাদ করলেন, আর বললেন আসছি দীপ তোমার শহরে তোমার সুবুদাদা বোধহয় এবার নিয়ে যাবেই।

।।৬।।

এতক্ষনে ফাইনালি, সায়েন্স সিটি পৌছাল গাড়ীটা , এক মুখ রাগ নিয়ে গাড়ীতে উঠল রুমি।

-“ এতক্ষন সময় লাগে, এই টুকু রাস্তা আস্তে?”রুমির কথা শেষ হতে না হতেই পাল্টা প্রশ্ন করল দীপ

-“সব ঠিক ঠাক পেপার নিয়ে নিয়েছ তো?”

-“হ্যাঁ, সব নিয়েছি আর উকিল বাবু ও এসে যাবেন সময় মত” বলল রুমি

-“আচ্ছা রুমি তোমার মনে আছে, প্রথম দিনের কথা” বাইরের বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল দীপ।

সুদীপ্ত আর রুমির বিয়েটা দিয়েছিলেন মহিমবাবু নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আর দিয়েছিলেন বুক ভরা আশীর্বাদ ওই বাপ-মা মড়া ছেলে মেয়ে দুটিকে, এর পর থেকে ওদের সংসার গোছানো, রিকের জন্ম , প্রতি সপ্তাহে বা মাসে ২-৩ বার কলকাতার বাড়ীতে গিয়ে স্যারের সাথে দেখা করা এসবই চলছিল নিজের মত। 

।।৭।।

দিনটা ছিল ৮ই মে বাংলার ২৪ শে বৈশাখ ২০১৪ সাল, জীবনে ওই প্রথম আর একটিবার ফোন করেছিলেন মহিমবাবু দীপকে-

“হ্যালো, মিঃ সুদীপ্ত চ্যাটারজীর সাথে কথা বলতে পারি, আমি অনার স্যার বলচগি” অত্যন্ত শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করলেন মহিমবাবু 

-“হ্যাঁ, স্যার আমিই বলছি, কি হয়েছে স্যার, আমি আসব ওখানে” একসাথে এতগুল কথা বলে গেল দীপ

-“না না, আমি একটা কথা জানাতে ফোন করলাম , এত ব্যাস্ত হোয় না, আমার ঠিকানা একটু চেঞ্জ হয়েছে, ও বাড়ীতে আর যেও না, আমার নতুন ঠিকানা- ৫৬, পি. এস. মিত্র রোড, কলকাতা-৭০০০১১, এর পর থেকে ওরা ওই ঠিকানাতেই যেত।

এই সব ভাবতে ভাবতে আজও ওই ঠিকানায় এসে পড়ল ওরা, সাথে মিঃ অমিত রায়, দীপের পারিবারিক উকিল। রেজিস্টারে সই করে ঘরে ঢুকল ওরা, ঘরে ঢুকেই স্যারের অমলিন হাসিটাই যেন সব দুঃখ শেষ করে দেয় ওদের, প্রনাম করার পর,ওদের দেখে খুশি হলেও অমিত বাবুকে দেখে অবাকই হলেন মহিমবাবু।

-“কি ব্যাপার দীপ, উকিলবাবু এখানে?”-জিজ্ঞেস করলেন মহিমবাবু

-“স্যার একটা কথা আপনাকে বলার ছিল” সভয়ে নতমস্তকে বলল দীপ

-“কি হল কোন সমস্যা”-জিজ্ঞেস করলেন মহিমবাবু

নিস্তব্ধ সবাই, কেউ কিছু বলছে না, আর সুদীপ্তর মুখ থেকে কোন আওয়াজ বেরচ্ছে না।

-“কি হল বল” আবার জিজ্ঞেস করলেন স্যার।

-“আমি কি তোমাকে মানে আপনাকে বাবা বলে ডাকতে পারি?” বলেই হাউ হাউ করে কেঁদে মহিমবাবুর পা ধরে বসে গেল দীপ।

দীপের কান্না দেখে স্যার কিছু বলতে জাচ্ছিলেন তখনি রুমিও কেঁদে উঠল

-“প্লিজ স্যার না বলবেন না, আপনি ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই”

নিজের ছেলের বিশ্বাসঘাতকতা, বাড়ী থেকে বেরিয়ে আসা, বৃদ্ধাশ্রম এ বাকি জীবন কাটানর সিদ্ধান্ত সবই চোখের সামনে ভাসছিল মহিমবাবুর, তাই নিজের চোখের জলকে সামলে, আর দুজন পূর্ণ বয়স্ক ছেলে মেয়ের এভাবে কান্না দেখে, চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন মহিমবাবু।

কিছুক্ষন পর। পরেশ বাবুকে সাথে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন মহিমবাবু, পরেশবাবু কে দীপ আগে থেকেই চিনত, উনিই চালান এই বৃদ্ধাশ্রমটা।তখন ও কান্না কাটি চলছে, নিস্তব্দতা ভেঙ্গে মহিমবাবু একটু হেসে বললেন

-“ বুঝলে পরেশ, আজ আমাকে এরা দত্তক নিতে এসে, কি করা যায় বলত?” 

-“ সে তো ভাল কথা, কি জানেন দাদা এখানে লোকে এসে নিজের বাবা মা কে রেখে যায়, আর নিয়ে যায় না, কেউ কেউ ভদ্রতা দেখাতে মাঝে মাঝে দেখতে আসে, ভাবে বুঝি টাকা দিলেই সব দায়িত্ব শেষ, আর এরা বসে থাকে কবে আসবে ছেলে মেয়ে এই আশায়, আপনি ই এসেছিলেন নিজের ইচ্ছে, আর এখানেই শেষ জীবন কাটানোর উদ্দেশ্যে, আপনি সত্যি ভাগ্যবান দাদা, ফিরে জান ছেলে বউমা ন্নাতি নাত্নির সাথে সুখে খেলুন সেকেন্ড ইনিংস” বলে হাসলেন পরেশবাবু

-“ আপনি যাবেন স্যার আমাদের সাথে, নতুন বাড়িতে আমরা আপনার থাকার অব ব্যাবস্থা করেছি, আপনার শক্ত গদি দেওয়া খাট, ওই ঘরের ব্যাল্কনি তে ইজি চেয়ার পাতা আছে আপনি ওখানে খবরের কাগজ পরবেন, পুরো গ্রামের বাড়ির মত সাজিয়েছি..”বল্ল দীপ

-“কি করে আর যাব বল, তুই তো এখনও স্যার আর আপনি বলেই কথা বলছিস, বাবা কে তো কেউ স্যার বলে না আর আপনিও বলে না” মুচকি হেসে বললেন মহিমবাবু

-“না মানে, বাবা উকিলবাবু সব লিগাল ফরম্যালিটি করে দেবেন, তুমি প্লিজ চল”বলেই ওরা দুজনে প্রনাম করল মহিমবাবুকে

-“হ্যাঁ, হ্যাঁ দাদা আপনি আজ ই জান, আমরা সব ফরম্যালিটিস কাল করে নেব” পরেশবাবু হাসি মুখে বললেন

-“বাবা তোমার জিনিস গুল থাক, কাল আমরা এসে গুছিয়ে নিয়ে যাব, আজ চল ফিরি, আজ ডেটটা মনে আছে বাবা”-বল্ল দীপ

-“১৬ই ডিসেম্বর, জন্মদিন, আমার জন্মদিন আর সুদীপ্ত চ্যাটারজীর বাবা মহিম চ্যাটারজীর জন্মদিন”

বাবাকে বুকে জরিয়ে বেরিয়ে পড়ল ওরা, ওদের বাবার সাথে।

আমরা কেউই কোনদিন এত বড় হই না কি বাবা মা কে নিজের কাছে রাখতে পারি, জীবনে যত বড় হয়ে যাই না কেন আমরাই বাবা মার কাছে থাকি।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics