দৃষ্টি-গোচর
দৃষ্টি-গোচর
শ্রীপর্ণার দেহ পোস্ট মর্টেমে নিয়ে গেল পুলিশ। এই ফ্ল্যাটের নিচে বিল্ডিংএর এই পাশটা দুই পাশ থেকে গেটে তালা লাগিয়ে দিয়ে ব্লক করে দিয়ে গেছে। বলে গেছে, আপাতত ঐদিকটায় যেন কেউ না যায়।
বেশিরভাগ বাসিন্দাদের গাড়িই এই পাশটা দিয়ে বেরোয়, কিন্তু পুলিশের নির্দেশে বেশ মুশকিলে পড়লো সবাই। রাহুলকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলো প্রায় ঘন্টা তিনেক। নেহাত দুর্ঘটনায় হাত পা ভেঙে শয্যাশায়ী সে, তাই থানায় তুলে নিয়ে যায় নি তাকে।
অবশ্য পুলিশকেও সেই খবর দিয়ে ডেকেছিলো - শ্রীপর্ণাকে ব্যালকনি টপকে নিচে পড়ে যেতে দেখে। পুলিশকে রাহুল এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে যা বয়ান দিল, তা' এইরকম -
মাস তিনেক আগে, দীঘা থেকে ওর ফিঁয়াসে এই শ্রীপর্ণার সঙ্গেই কয়েকদিন কাটিয়ে ফেরার সময় ওর গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। সে নিজে ড্রিংক করেনা, কিন্তু শ্রীপর্ণা করতো। কারণে অকারণে ইচ্ছে হলেই ড্রিংক করার একটা বদঅভ্যাস ছিল ওর। অবশ্য একবারে কন্ট্রোলের বাইরে চলে গিয়ে মাতলামি করার মত সিচ্যুয়েশন সে কখনই ক্রিয়েট করে নি।
যাই হোক, দীঘা থেকে ফেরার সময় নন্দকুমার অবধি গাড়ি চালিয়েছিল রাহুল। তারপর স্টীয়ারিংএ বসে শ্রীপর্ণা। থ্রিল তার জীবনের অঙ্গ, আর তার মতে গাড়ি নাকি হাইওয়েতে একশ'র নিচে চালানো শোভা দেয় না! অতিবেগে গাড়ি চালাতে গিয়ে সেদিন অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়েছিল সে!
প্রাণে বাঁচলেও রাহুল হাত পায়ে ভয়ঙ্কর রকম চোট পায়। সীটবেল্ট আর এয়ারব্যাগের জন্য শ্রীপর্ণা অবশ্য খুব কম চোট পেয়েই রক্ষা পায়। সেই থেকে রাহুল শয্যাশায়ী আর শ্রীপর্ণা মাঝে মাঝেই এসে দেখে যায় তাকে, গল্প করে দীর্ঘক্ষণ।
ওদের বিয়ের তারিখও পিছানো হয়েছে ওদের ঐ অ্যাক্সিডেন্টের কারণে। আজও শ্রীপর্ণা এসেছিল ওর ফ্ল্যাটে। হাতের প্ল্যাস্টার কাটার পর ডাক্তারের পরামর্শ মত, শ্রীপর্ণা এখানে এলেই তাকে একটু করে ব্যায়াম করাতো। কিন্তু হাতের কয়েক জায়গায় বেশ ইন্ফেকশান হওয়ায়, গত একমাস যাবৎ সেসব বন্ধ রেখেছিলো রাহুল।
আজ ব্যাণ্ডেজ সরিয়ে ডেসিং করার সময় দেখে - জায়গাটা একদম সেরে গেছে! হাতে আবার আগের মত নাকি জোরও অনুভব করছে সে! শুনে তো শ্রীপর্ণা আজ খুশীতে একটু ড্রিংকও করে, প্রায় তিনমাস পর। ওদের অ্যাক্সিডেন্টের পর সে ড্রিংক করা ছেড়ে দিয়েছিলো, কিন্তু আজ রাহুলের সুস্থ হয়ে ওঠার খুশীতে একটু...
খুশীতে ব্যালকনিতে গিয়ে দুহাত ছড়িয়ে আনন্দে চিৎকার করে আকাশ পানে চেয়ে - থ্যাঙ্ক গড, মাই বেবী'স গেটিং কিওরড। ভগবানকে ধন্যবাদ দিয়ে ঘোরার সময় হঠাৎই বোধ হয় চক্কর খেয়ে যায় সে। টাল সামলাতে না পেরে, ব্যালকনির নিচু রেলিং টপকে ছিটকে পড়ে যায় সে বাইরে।
রাহুল কোনক্রমে হুইল চেয়ারে নিজেকে টেনে হেঁচড়ে বসিয়ে আসে ব্যালকনিতে। শ্রীপর্ণা তখন গ্রাউণ্ডফ্লোরে আছড়ে পড়েছে।
এই ফ্ল্যাটটা রাহুল কিনেছিলো তার চাকরির সুবিধার্থে। আপাতত একাই থাকে সে, বিয়ের পরেও এখানেই থাকার প্ল্যান ছিল তাদের। ওর বাবা মা ভাই সব দেশের বাড়িতেই থাকে।
একজন ঠিকে কাজের লোক এসে, রোজ রান্নাটা করে দিয়ে যায় তার। এছাড়া কাউকেই চেনেও না সে বিশেষ এখানে। শ্রীপর্ণার বাবা মাও এইমুহুর্তে দেশের বাইরে থাকায় তাঁদেরও এই ঘটনার কথা সে জানাতে পারেনি। সরাসরি পুলিশকেই ফোন করেছিল রাহুল।
রাহুলের এই বয়ানে অবশ্য মন গলেনি পুলিশের। বললো - দু'টো প্রশ্নের উত্তর সাফ সাফ বলো তো দেখি। এক, হবু বৌ সারাক্ষণ মদ খাচ্ছে, আর তুমি নিজে ড্রিংক না করলেও, তাকে সাপোর্ট করে যাচ্ছো, কেন? বিষয়টা পরিষ্কার হল না।
আর দুই, - তুমি ড্রিংক করো না, শ্রীপর্ণাও ড্রিংক করা ছেড়ে দিয়েছিলো বলছো। তাহলে, তোমার হাত ঠিক হওয়ার খুশীতে, ড্রিংক করার জন্য সে তৎক্ষণাৎ মদের বোতল পেল কোথায়? নাকি, সে জানতোই যে তোমার হাত ঠিক হয়ে গেছে, তাই বোতল নিয়েই এসেছিল আজ?
রাহুল - দেখুন, আমি মনে করি, মদ খাওয়া না খাওয়া মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। শ্রীপর্ণা ড্রিংক করলেও, কখনই মদ খেয়ে বেহেড মাতালও হয় নি, মাতলামিও করে নি। বরং ওর ক্রিয়েটিভিটি বাড়তো হালকা ড্রিংক করার পর। সেসব আমি আপনাের বোঝাতে পারবো না। মোট কথা, ওর ড্রিংক করার স্বাধীনতায় আমি হস্তক্ষেপ করি নি কখনও, করতামও না।
আর দ্বিতীয়ত, আজকের ড্রিংক করা নিয়ে যে প্রশ্নটা করলেন। আমার এই ঘরের লাগোয়া এক ফালি স্পেশ আছে দেখুন - এই ফ্ল্যাটের কমন বাথরুমের আগেই। ওখানে যান, ওটা শ্রীপর্ণার সাধের বার কাম ক্রিয়েটিভ রুম। ওর পছন্দের কয়েকটিই মাত্র ব্র্যাণ্ড আছে, যাদের প্রতিটির স্টক ওখানে পাবেন।
ওর মোবাইলটা বোধ হয় ব্যালকনিতে রয়ে গেছে। ওটা অন করলেও, সেখানে অনেক ছবি পাবেন ওর, ঐ রুমে বসা ড্রিংকস-এর গ্লাস হাতে। আশা করি আপনার উত্তর আপনি পেয়ে গেছেন, এবার আসুন।
আমি নিজে আহত হয়ে শয্যাশায়ী প্রায় মাস তিনেকেরও বেশি। ওই ছিল আমার সব - বল, ভরসা, আশ্রয়। সেও চলে গেল! এবার আমায় একটু একা থাকতে দিন। এই যন্ত্রণা আর সহ্য হচ্ছে না। ওর বাবা মায়ের নাম ঠিকানা কনট্যাক্ট নাম্বার দিয়েছি - প্লীজ, ওদের একটু জানিয়ে দেবেন, নমস্কার।
পুলিশের সেই মুহুর্তে আর কিছুই বলার বা করার ছিল না। তাছাড়া, তার শারীরিক অবস্থা দেখে, আর সেও নিজে থেকেই পুলিশকে ডেকে ঘটনাটা জানিয়ে স্বেচ্ছায় বয়ান দেওয়ায়, আপাতত তাকে ওখানেই ছেড়ে যেতে বাধ্য হ'ল তারা।
পুলিশ চলে গেল। ফ্ল্যাটেও কেউ নেই। রাহুলের ভীষণ একঘেয়ে, বড্ড অসহনীয় লাগছিলো আজকের নিঃসঙ্গতাটা। বাথরুম থেকে বের হয়ে হুইল চেয়ারটায় বসে, আবার ব্যালকনিতে আসে সে। রেলিংটা ধরে সামনে ঝুঁকে এসে নিচের দিকে তাকায়।
পুলিশ বডি নিয়ে গেছে কিন্তু সেখানে পাওয়া শ্রীপর্ণার বডিটার স্কেচ করে রেখে গেছে তারা চক দিয়ে। তিনতলার বারান্দা থেকে পড়ে, শ্রীপর্ণা আহত হলেও হয়তো প্রাণ হারাতো না - যদি না তার মাথার পিছনটায় সারা শরীরের ভারটা দিয়ে কংক্রীটের ওপর আছড়ে পড়তো সে!
অন্তত, তাকে ধাক্কা দেবার সময়েও রাহুলের তাই মনে হয়েছিলো। প্রচণ্ড ক্রোধ পুষে রেখেছিলো সে তাদের অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকেই। নিজে ওস্তাদী করে জোরে চালাতে গিয়ে গাড়ি ওল্টালো, নিজে বেঁচেও গেল। আর বিনা দোষে, হাত পা ভেঙে বিছানায় পড়ে কষ্ট পাচ্ছিলো কিনা সে!
হাতে জোর সে অনেক দিন আগে থেকেই ফিরে পাচ্ছিলো - ডাক্তারের দেখানো ব্যায়ামগুলো রোজ ঠিকঠাক করে করার ফলে। কিন্তু তাকে সে ইচ্ছা করেই বলেনি এতদিন। আজ বললেও খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি শ্রীপর্ণা কথাটাকে, নইলে তো সে আগেভাগে সাবধান হতেই পারতো!
এমনকি পুলিশকেও সেই কথাটা আজ বললো, তারাও সেটাকে আমল দিল না বিশেষ! না হলে, সে নিজেই নিজেকে হুইলচেয়ারে বসাচ্ছে, তারপর ব্যালকনিতেও যাচ্ছে - এসব শুনে তাদের তো বুঝে যাবার কথা, ঘটনার মধ্যে কোথাও কিছু একটা গোলমাল আছে!
যাই হোক, নিচে শ্রীপর্ণার বডির স্কেচটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ রাহুলের মনে হ'ল - শ্রীপর্ণার বডিটা ওখানে শোয়ানো! মাথার পিছন দিয়ে গড়িয়ে আসছে রক্তের স্রোত! চোখদুটো, ওর চোখদুটো খোলা! ওপর দিকে করুণ দৃষ্টিতে যেন চেয়ে আছে সে!
রাহুলের মনে হল - শ্রীপর্ণা যেন ওখানে শুয়ে শুয়ে তার পানে চেয়ে কিছু বলতে চাইছে, অব্যক্ত চোখের ভাষায়! হয়তো জানতে চাইছে, কেন তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে সে? রাহুল বেশ আগ্রহ ভ'রে তার চোখের দিকে তাকায় - শ্রীপর্ণার চোখের দৃষ্টি আস্তে আস্তে বদলাতে থাকে!
সেই নজরে আর কোন করুণ অনুভূতির লেশমাত্র নেই। বিস্ফারিত নেত্রে যেন ক্রোধের ভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্রমশঃ! যেন পুড়িয়ে দিতে চাইছে সে রাহুলকে তার দৃষ্টির আগুন দিয়ে! রাহুল চোখ সরিয়ে নিতে যায়, পারে না!
এক অমোঘ আকর্ষণ ভেদ করছে তার চেতনা। সেই দুটো চোখের নজর যেন তার চোখের মধ্যে দিয়ে বিদ্ধ করে ফেলেছে তার শরীর। ব্যালকনির গ্রীল ধরে ঝুঁকে থাকা রাহুল নিজের ভারসাম্য হারায়! হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে নিচে পড়তে থাকে সে!
শ্রীপর্ণার চোখের দৃষ্টিতে এখন আর সেই ক্রোধ নেই, নেই জ্বালামুখী ভাবও। খুশীতে পুলকিত হয়ে উঠেছে তার চোখ আবার আজ সকালের মতই! রাহুলের শরীরটা এসে আছড়ে পড়ে শ্রীপর্ণার বডির সেই স্কেচটার ঠিক পাশেই!

