দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কুহু
দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কুহু
ছটা দশের লোকালটা স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। কুহু প্রায় দৌঁড়তে দৌঁড়তে প্রথম প্ল্যাটফর্ম থেকে সিঁড়ি বেয়ে উঠে দ্বিতীয় প্ল্যাটফর্মে নামতে নামতেই ট্রেনটা স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। “যাহ্!” স্বগোতক্তি করলো ও। আজও প্রথম ক্লাসটা মিস হবে। পরের ট্রেন আসতে এখনো আধ ঘণ্টা। আজ আবার প্রথমেই বি কে স্যারের ক্লাস। বিরক্ত মুখে ও একটা বেঞ্চে বসতে যাচ্ছিলো এমন সময় শুনতে পেলো “তুমি কি পরের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছো?”
ও ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেলো সুশান্ত দাঁড়িয়ে। ও উত্তর দিলো “হ্যাঁ”
“কিন্তু পরের ট্রেন আসতে বোধহয় বেশ দেরী হবে”
“না না আধঘণ্টা পরেই আসার কথা, প্রতিদিনই আমার কিছু বান্ধবী ওই ট্রেনে যাতায়াত করে”
“সে তো আমিও করি, তবে আজ দুটো স্টেশন আগে কোথাও ওভারহেডের তার ছিঁড়েছে তাই ওটা মেরামত না হওয়া পর্যন্ত ট্রেন আর আসবে না। ওই তো মাইকে বলছে”
কুহু বেশ অসুবিধায় পড়লো। ক্লাস একটা দুটো বাদ গেলেও পরে এর তার থেকে খাতা নিয়ে ঠিক মেকআপ করে নেবে কিন্তু আজ ক্লাসের শেষে ওর প্রিয়াংশুর সাথে দেখা করার কথা। সেখানে তো যেতেই হবে, না গেলে ব্যাপারটা বিগড়াবে। প্রিয়াংশু সম্প্রতি চাকরি পেয়েছে অন্য শহরে। আজ সন্ধ্যায় সেই শহরের উদ্দেশ্যে ও রওনা দেবে তার আগে দেখা করতে বলেছে। দেখা করার সময় ঠিক করা আছে সকাল সাড়ে এগারোটা। এখন ট্রেনের অপেক্ষায় থাকলে তো আর দেখা করা হবে না। সুশান্ত ওর মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিল বলল “যদি কোন অসুবিধে না থাকলে চলো না বাসে চলে যাই”
বাস রুটে ও খুব একটা কোনদিন যায়নি। কিন্তু প্রিয়াংশুর সাথে দেখা করতে ওটাই একমাত্র রাস্তা বাকি। বলল “ঠিক আছে চলো”
স্টেশন থেকে বেরিয়ে দুজনে বাস ধরলো। পাশাপাশি সীট না পাওয়াতে কুহু বেশ স্বস্তি পেলো। সুশান্ত ওর ক্লাসমেট নয়, ও বানিজ্য বিভাগে আর কুহু বিজ্ঞান। ওর সম্পর্কে যেটুকু জানে তাতে শুনেছে সুশান্ত পড়াশোনায় খুবই ভালো। কোন উল্টোপাল্টা ব্যাপারে থাকে না। বাস চলতে শুরু করতে কুহু পাশের লোকটিকে টপকে জানলার বাইরে তাকালো। বরাবরই ওর জানলার পাশে বসে জানলার বাইরে দেখতে ভালো লাগে কিন্তু আজ তা অন্য যাত্রীর দখলে তবে পাশ থেকে দেখা যাচ্ছে তাই ওর ভালো লাগছিলো। কিন্তু এই স্বস্তি বেশীক্ষণ সইলো না কপালে, ভদ্রলোক সিগারেট ধরিয়ে বসলো। কুহুর সিগারেটের গন্ধে বিরক্ত লাগে। ও নিজের অস্বস্তি বোঝানোর জন্য হাত নাড়লো নাকের সামনে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলো কিন্তু সিগারেটের গন্ধ নাকে ঢুকে যেতে থাকলো। একবার বললো “সিগারেটটা ফেলে দিন আমার অসুবিধে হচ্ছে” লোকটি অভদ্রের মতো বলে দিলো “অসুবিধে হচ্ছে অন্য সীটে যান” কি করবে সীট ছেড়ে উঠে যাবে? কিন্তু কলেজ এখনো বেশ অনেকটা পথ। এসব ভাবতে ভাবতেই কাঁধে কেউ টোকা দিলো। ও ঘুরে তাকাতে দেখলো সুশান্ত। ওকে বলল “তুমি আমার সীটে গিয়ে বসো আমি এখানে বসছি” কুহু বিনা বাক্য ব্যয়ে সুশান্তর সীটে গিয়ে বসলো। ওখানে বসার পর সুশান্ত পাশের ভদ্রলোককে কি বলল কে জানে সে প্রায় সাথেসাথেই সিগারেট জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলো।
কলেজ স্টপ যখন এলো তখন ওরা দুজনেই নেমে পড়লো। কলেজের দিকে হাঁটতে হাঁটেতে কুহু বলল “ধন্যবাদ সীটটা পাল্টানোর জন্য। খুব অসুবিধে হচ্ছিলো সিগারেটের গন্ধে”
“প্রতিবাদ করতে হতো”
“বলেছিলাম কিন্তু লোকটা পাত্তাই দিলো না”
“পৃথিবীর মানুষ এরকমই সহজে কেউ কাউকে পাত্তা দিতে চায় না কিন্তু সেটা আদায় করে নিতে হয়”
কথা বলতে বলতে কলেজ চলে এলো। কলেজে ঢোকার পর ওরা যে যার ক্লাসে চলে গেলো।
সময়মত ক্লাস শেষ করে কুহু কলেজ থেকে বেরোল প্রিয়াংশুর সাথে দেখা করতে। রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়ে পৌঁছাতেই খেয়াল করলো ও ওর অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে হেসে বলল “কি ব্যাপার আজ এত দেরী?”
কুহু বলল “ক্লাস শেষ হতেই দৌড়েদৌড়ে আসছি”
“চলো অনেক কথা আছে তোমার সাথে” দুজনে রেস্টুরেন্টে ঢুকে একেবারে কোণার টেবিলে বসলো। প্রিয়াংশু বলল “কি খাবে চায়ের সাথে টায়ের ব্যবস্থা করবো নাকি?”
“করও ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে”
চিকেন স্যান্ড্উইচ অর্ডার দিয়ে ও বলল “কুহু বাবা মায়ের সাথে প্রাথমিকভাবে কথাবার্তা হয়ে গেছে। ওরা তোমাকে দেখতে চান……”
“এখন……”
“আরে না আমি ছ মাস পরে যখন ফিরবো তখন ওরা তোমার বাড়ি যাবে তোমার বাবামায়ের সাথে কথা বলতে। তারপর আমারা এক হবো চিরদিনের জন্য”
“কিন্তু তখন তো আমার গ্রাজুয়েশনও কমপ্লিট হবে না যে”
“বিয়ের পর পড়বে তোমার যা যা পড়ার শখ”
“তোমার বাবা মা রাজি হবেন তো?”
“হ্যাঁ কেন হবে না। এখন ওসব নিয়ে চিন্তা করা বন্ধ করো আর সত্যি করে বলতো আমি কাছে না থাকলে তোমার কেমন মনে হয়”
“তোমার কি মনে হয়…”
“ঠিক বুঝতে পারছিনা যে”
“তবে রে…”
“আহাহা চটো কেন? ঠিক আছে সরি”
প্রিয়াংশু চলে গেলো। ওর সাথে কাটানো সময় মনে করে আর পড়াশোনার মাঝে কুহুর সময় কেটে যেতে থাকলো। সুশান্তর সাথে দেখা হয় প্রায়ই কথাও কিন্তু তবে কুহুর মন প্রিয়াংশুর কাছে না থাকার দুঃখ ভারি করে রাখে।
যেমন বলেছিল প্রিয়াংশু মাস ছয় পরে আসবে, এলো। তারপর ওর বাবা মা কুহুকে দেখতে এলেন। তারপর পাকা কথা থেকে বিয়ে খুব তাড়াতাড়িই হয়ে গেলো। কুহুর মন তখন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। যাকে ভালবেসেছিল সেই ওর জীবন সঙ্গী হয়েছে। প্রথম কয়েক মাস বেশ কাটল যুগলে। মধুচন্দ্রিমায় ওরা গেলো সিকিম। ওখান থেকে ঘুরে আসার পর কুহু অনুভব করলো ওর শরীরে এক নতুন প্রাণের যেন সঞ্চার হয়েছে। খবরটা ঠিক কিনা জানতে ও ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করলো আর তারপর জানলো খবরটা ঠিক। প্রিয়াংশুকে খবর দিতে ও আহ্লাদে ফেটে পড়লো “সত্যি সোনা আমাদের সোনামণি আসছে?!? এতো দারুন ব্যাপার”
কিছুদিন থেকে কুহুর মনে হচ্ছিলো আবার কবে থেকে কলেজ যেতে পারবে। মাঝখান থেকে ক্যেক মাস ক্লাস কামাই গেছে। ওদিকে পরীক্ষা এগিয়ে আসছে যে। স্বামীকে খুশি দেখে বলল “একটা খুশির খবর শোনালাম আমার উপহার চাই”
“যা চাইবে তাই দেবো”
“ঠিক তো? তাহলে আমি আবার পড়াশোনা শুরু করতে চাই”
“সেটা কিভাবে সম্ভব?”
“কেন নয়?”
“তুমি এখন আমাদের সোনামণির মা হতে যাচ্ছ। তোমার তো বিশ্রামের প্রয়োজন। এখন গাড়ি করে কলেজ যাওয়া আসা পড়াশোনার জন্য টিউশন এতো ধকল সহ্য হবে না। বাচ্চা হয়ে যাক তারপর ওসব নিয়ে ভাববে” বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পর তার যাবতীয় কাজ করতে গিয়ে পড়ার কথা আর তোলাই হল না ওর। প্রথমটার বয়েস এক বছরের হতে হতেই দু নম্বর বাচ্চাও ভূমিষ্ঠ হয়।
এরপর থেকে কুহুর সব শখ আহ্লাদ সংসারের চাপে ভেতরে চাপা পড়ে যেতে থাকলো। সারাদিনে নিজের সম্পর্কে কিছু ভাবার সময় না পেলেও রাতে শোয়ার পর মাঝেমাঝেই অতীতের টুকরো ছবিগুলো চোখের সামনে কখনো কখনো ভেসে ওঠে। মনে পড়ে যায় ওর সেই কলেজমেট সুশান্তর কথা পৃথিবীতে কেউ কাউকে সহজে সম্মান বা প্রাপ্য অধিকার দিতে চায় না। তা নিজেকেই নিয়ে নিতে হয়।
দেখতে দেখতে বছর আর বয়েস বেড়ে চলল। ছেলে সুপ্রিয় আর মেয়ে প্রিয়া দুজনেই কলেজে গিয়ে পৌঁছেছে। এমন সময় একদিন কুহু বাড়িতে ঘোষণা করলো “আমি প্রাইভেটে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করতে চাই”
শুনে প্রিয়াংশুর সে কি হাসি “তুমি এই বয়েসে ছেলে মেয়ের সাথে পরীক্ষা দেবে? লোকে বলবে কি?”
কুহু হাসলো “লোকে কি ভাবলো সেটা নিয়ে এই বয়েসে এসে আর ভাবি না। ভালোবেসে সংসারে পা দিয়েছিলাম তাই এতদিন মুখ বুজেই সংসারের সব চাহিদা পালন করে গিয়েছি। ছেলে মেয়ে এখন বড় হয়ে গেছে। ওদের সম্পর্কে আমার ভাবার দিন ফুরিয়েছে। এখন আমি নিজের সম্পর্কে ভাবতেই পারি। আর তাই আজ আমি ঠিক করেছি আমার পড়াশোনা যা মাঝ পথে ঝুলে গিয়েছিল তা শেষ করবো”
প্রিয়াংশু হাঁ করে কুহুর দিকে তাকিয়ে থাকে। কুহুর দৃঢ়প্রতিজ্ঞতা দেখে ওর মুখ দিয়ে আর কথা বেরোল না।