দীপাবলি
দীপাবলি


দীপায়ন,বড়লোক বাপের বিগড়ে যাওয়া একমাত্র সন্তান।মাতৃহারা এই ছেলেকে দীপক বাবুও কোনদিন বিন্দুমাত্র শাসন করেননি। পাড়া প্রতিবেশী দের দীপায়ন কে নিয়ে কোন অভিযোগ যে আসেনি তা নয় প্রতিদিনই কিছু না কিছু শুনতেই হয় কিন্তু কখনোই তিনি তার ছেলেকে কিছু বলেননি ব্যবসার অছিলায় সব অভিযোগ এড়িয়ে যেতেন।
কিন্তু মনে মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করতেন,
-ঠাকুর ওর সুমতি দাও,ও যেন নিজের ভুল নিজেই বুঝতে পারে আর নিজেকে যেন সমাজে আদর্শ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। আর সেই দিন টা দেখার জন্য আমাকে বাঁচিয়ে রেখো।
নেশা করা, গুন্ডামি করা, মাতলামি করা সবেতেই একনম্বরে ছিলো দীপায়ন।পাড়ার কেউই খুব একটা পছন্দ করতো না তাকে আর যারা পছন্দ করতো তারা দীপের বাবার অর্থ প্রতিপত্তি দেখেই করতো।প্রতিবেশীদের ছোট্ট থেকে পছন্দের এই ছেলেটা দীপ বড় হতে হতেই হঠাৎ করেই কেনো যেন একটা খারাপ ছেলে তে পরিণত হয়ে গেছিলো।কিন্তু দীপক বাবু এর কারণ খুজে পাচ্ছিলেন না,কেউ কে কিছু জিজ্ঞেস করলেও কোন সদুত্তর মিলছিলোনা ব্যবসার চাপে পড়ে দীপক বাবুরও খুব একটা সময় হচ্ছিলো না দীপের সাথে কথা বলার।
সেদিন সন্ধ্যায় দীপক বাবু বৈঠক খানায় বসে খবরের কাগজ পড়ছেন তখনই দীপের আগমন।
-ড্যাড, আমার এখনি ৫০/- হাজার টাকা লাগবে। দাওতো।
খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে দীপক বাবু বললেন
-কিন্তু দীপ তোমাকে এইতো কদিন আগে ব্যাঙ্কে ৩০/- হাজার টাকা ট্রান্সফার করলাম। আজ আবার চাইছো যে।
-সো হোয়াট ড্যাড। আমার লাগবে তাই চাইলাম। দাও
-কিন্তু দীপ গত ছয়মাসে তুমি আমার থেকে মোট সাড়ে ৫ লক্ষ টাকা নিয়েছো। এতো টাকা এতো তাড়াতাড়ি খরচ করে ফেললে?
-হোয়াট হ্যাপেন্ড ড্যাড। এতো প্রশ্ন কিসের? ওহ প্লিজ
কথা না বাড়িয়ে দাওতো। টাকা তো খরচের জন্যই, সো প্লিজ।
দীপক বাবু কোন কথা না বাড়িয়ে চেক লিখে দিলেন যেমন টা তিনি সব সময় করে থাকেন।
কয়েকদিন পর দীপাবলি।
সেদিন বিকেলে পাড়ার সব ছেলেরা এসে দীপক বাবুকে বাড়িতে এসে চেপে ধরলো।
-প্লিজ আঙ্কেল আমাদের এই রিকোয়েস্ট আপনাকে রাখতেই হবে।
-আরে কি মুশকিল। আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
তাছাড়া আমি দীপাবলির দিন কোথাও যাই না।
-তা বললে চলবে না আঙ্কেল। আমাদের পাড়ার পূজো টার উদবোধন আপনাকেই করতে হবে আর তাই এখনই তৈরী হয়ে চলুন।
-আরে না না। অসম্ভব।
সব ছেলেরা জোড়া জোড়ি করে দীপক বাবু কে পাজামা পাঞ্জাবী পড়িয়ে গাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুললো।
কিছুক্ষণ পর গাড়ি থামতেই দীপক বাবু বলে উঠলেন আরে আমাকে কোথায় নিয়ে এলি কোথায় পূজো হচ্ছে এখানে চারিদিক তো অন্ধকার।
গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির চারপাশে তাকিয়ে দেখে গাড়িতে কেউ নেই।
আরে তোরা সব গেলি কোথায়?
কিছুক্ষণ পর চারিদিক আলো জ্বলে উঠলো।
আলো জ্বলতেই দীপকবাবু দেখলেন তিনি এক বড় জায়গা জুড়ে তৈরী তিনতলা বিল্ডিঙের সামনে দাঁড়িয়ে। সারা জায়গা জুড়ে আলোদিয়ে সাজানো হয়েছে আর দেওয়াল জুড়ে "দীপাবলি অনাথ আশ্রম" লেখাটা জ্বল জ্বল করছে। দীপক বাবু নিষ্পলক দৃ ষ্টি তে চেয়ে রইলেন সেদিকে।
-বাবা
-দীপকবাবু চমকে উঠলেন কতদিন যেন এই ডাক শোনেননি। কে?
-বাবা শুভ জন্মদিন।
-দীপ তুই আমায় বাবা বললি? আর একবার বলনা।
-বাবা
-আহ প্রাণ জুড়িয়ে যায় রে। দীপ এসব কি।এত্ত আয়োজন কিসের।
-আমি জানি বাবা আমি তোমার এক কুলাঙ্গার ছেলে। তোমার ছেলে হবার যোগ্যতা আমার নেই।
কিন্তু তবুও তুমি আমাকে এতো ভালোবাসো। এটাতো আমার ভাগ্য কতজনের এমন ভাগ্য হয় বলোতো।
-ধুর পাগল!কিসব বলছিস এসব
কুলাঙ্গার হবি কেনো পাগল। তুই যেমনি হোস না কেন তুই আমার সেরা ছেলে।
আগে বল এসব কি করেছিস আমি তো তাজ্জব বনে যাচ্ছি।
-হুম বলছি
ছ-মাস আগে আমি তোমার ঘরে ঢুকেছিলাম কোন কারণে,তখন আমি তোমার ঘরে তোমার একটা ডাইরি পাই,সেখানে লেখা ছিলো তোমার একটা বড় স্বপ্ন তুমি
একটি অনাথ আশ্রম করতে চাও।কারণ তুমি অনাথ ছিলে কোনরকমে তুমি নিজের দিনগুজরান করতে সেই সময়ই তোমার সাথে মায়ের দেখা হয়। আর মা তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করে,নিজের পরিবার ছেড়ে চলে আসে তোমার কাছে। মায়ের দীপাবলির দিন জন্ম হয়েছিলো বলে মায়ের নাম দাদু রেখেছিলো দীপাবলি। আর দীপাবলির দিনই তোমাদের বিয়ে হয়।
তুমি সেদিন এক নতুন জীবন পেয়েছিলে বলে মা তোমার নাম রাখে দীপক।
তারপর তোমাদের দুজনের প্রচেষ্টায় আজ এই বড় নামকরা 3D industries. দুর্ভাগ্য এই যে আমি মায়ের ভালোবাসা টা পাওয়ার আগেই সে চলে গেলো।
আমি তো এত্তসব কথা জানতামই না।
আর তুমি ঠিক এই জমিতেই অনাথ আশ্রম করতে চাইছিলে কিন্তু পারছিলে না কারণ এখানে বেআইনি ভাবে জমি দখল করে চলছিলো মদের ব্যবসা আর তোমার মতো ভালো মানুষের পক্ষে তাদের উৎখাত সম্ভব হচ্ছিলো না। তাই..
এতক্ষণ দীপক বাবু সব মনদিয়ে শুনছিলেন এবার তিনি বাধা দিয়ে বললেন তার মানে ছ-মাস ধরে যেই টাকা গুলো দিয়েছিলাম সব এখানে খরচ করেছিস?
-হ্যাঁ বাবা তুমি আমাকে বিশ্বাস করেছিলে আর তাই আমি সেই বিশ্বাসের অবমাননা করতে পারিনি।
-কিন্তু তুই এই অসাধ্যসাধন করলি কি করে, জমিটা যে জবরদখল করেছিলো সেই মুস্তাফা তো এক মস্ত গুন্ডা একশোর ওপরে ক্রিমিনাল কেস রয়েছে ওর।
তুই ওকে কিভাবে...
-বাবা কথায় বলেনা রতনে রতন চেনে, তাই একজন মস্তান তো মস্তানকেই চিনবে।
-তুই অনেক বড় কাজ করেছিস দীপ আমি যে কি আনন্দ পাচ্ছি বলেই দীপক বাবুর চোখ ছলছল করে উঠলো।
আমি কিছুই করিনি বাবা সবই তো তোমার টাকায় করা, জীবনে আর কিছু না করি অন্তত এই কুলাঙ্গার ছেলে তোমার জন্য এইটুকু তো করতেই পারে।
-আরে কি বলছিস আমার সম্পত্তি অর্থ সবই তো তোর সব তোর।
-বাবা
-হ্যাঁ বল না
-তোমার জন্য এই শুভদিনে আমার থেকে একটা উপহার তোমার জন্য।
দীপক বাবুর হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে দীপ বাবাকে একটা প্রণাম করলো
বাবা এটা আমার সম্পূর্ণ নিজের রোজগারে কেনা শুধু তোমার জন্য।
নিজের রোজগাড় মানে? কি করেছিস তুই,অবাক হলেন দীপক বাবু।
-ও আমার বন্ধুর বাবার ট্যাক্সি টা একদিন চালিয়েছি সেটার থেকেই....
কি বলছিস দীপ তুই..
-হ্যাঁ এবার কথা বাড়িও না প্যাকেট টা খোলো তো
দীপক বাবু প্যাকেট টা খুলেই দেখতে পেলো তার স্ত্রী দীপাবলির আর তার একসাথে তোলা বহু পুরানো দিনের ছবি যেটা সুন্দর সোনালী মোড়কে বাধানো, ছবিটা দেখেই দীপক বাবু চোখের জল আর ধরে রাখতে পারলেন না।
-এই ছবিটা কোথায় পেলি,দীপা একরকম জোড় করে তুলিয়েছিলো ছবিটা।
রামু কাকা স্টোর রুম পরিষ্কার করতে গিয়ে পেয়েছে একটু নষ্ট হয়ে গেছিলো আমি সেটাকে ঠিক করিয়েছি।
দীপক বাবু দীপকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললো।
তুই আর তোর আজকের দেওয়া উপহার আমার জীবনের সেরা প্রাপ্তি দীপ।
কান্না জড়ানো গলায় বলে ওঠেন দীপক বাবু।
তখনই হুড়মুড় করে সব ক্লাবের ছেলেরা আরো আশে পাশের পাড়ার লোকজনদের নিয়ে সেই আশ্রমের মেইন গেটের সামনে হাজির হয়ে দীপক বাবু কে সকলে নিয়ে গেলেন। কাঁচি দিয়ে রিবন কাটা হোলো সবাই হাততালি দিয়ে আশ্রমে প্রবেশ করলো।
দীপায়ন ভীড়ের বাইরে এসে দূর থেকে দেখতে লাগলো সেই জ্বল জ্বল করতে থাকা দেওয়াল লিখন "দীপাবলি অনাথ আশ্রম" যেখানে আছে মায়ের স্মৃতি বাবার স্বপ্ন হাজার মানুষের পরিশ্রম শতাধিক শিশুর আশ্রয় সুখ দুঃখ আর আছে দীপের ভালোবাসা শতকোটি প্রণাম আর শ্রদ্ধা।