ধূসর অতীত
ধূসর অতীত
ট্রেনের হাওয়াতে এলোমেলো হয়ে আসা ঝুরো চুলগুলো সামলাতে গিয়ে তীর্থের সাথে চোখাচোখি হয়ে যায় বন্যার । অফিস ফেরত নিত্য যাত্রীদের জন্য এইসময়ের ট্রেনে এমনিই বেশ ভিড় হয় । কোনরকমে একটু বসার জায়গা পাওয়াটাই ভাগ্যের ব্যাপার । প্রথম প্রথম এই ভিড়ে যাতায়াত করতে কষ্ট হলেও এখন নিত্য যাত্রাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে । কিন্তু শৌখিন তীর্থ এই লোকাল ট্রেনে ? ভাবতে না চাইলেও ভাবনাটা মাথাতে এসেই যায় । ভিড়ের মধ্যে বসার জায়গাটাও পায়নি । সঙ্গে কোন সঙ্গী অথবা লাগেজ আছে বলেও তো মনে হচ্ছে না। আড়চোখে তীর্থকে খেয়াল করতে গিয়ে আবারও চোখাচোখি হয়ে যায়। দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে জানলার বাইরে তাকায় বন্যা।
বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই বন্যা বুঝতে পেরেছিল, তীর্থর সাথে ওর অনেক কিছুই মেলেনা। বিয়ের আগে ওরা দুতিনবার ওরা দেখা করেছিল, তখন অতটা বুঝতে পারেনি তীর্থকে। অবশ্য একটা মানুষকে বোঝার জন্য ঐটুকু সময় কিছুই নয় । ওর কাছে জীবন মানে অর্থ-যশ-প্রতিপত্তি আর বিলাসিতা, অনুভূতি সম্পূর্ণ মূল্যহীন ছিল ওর কাছে । অথচ বন্যা ছোট থেকে মানুষ হয়েছে বড্ড সাধারণ ভাবে। ওর মানসিকতাও গড়ে উঠেছিল সেইভাবেই। তীর্থ উচ্চাভিলাষ আর যান্ত্রিক জীবনে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও পারেনি বন্যা । প্রতিটা মুহুর্তে দমবন্ধ হয়ে আসতো ওর । একসময় নিজের জীবনটাকে নিজের ছন্দে কাটাবে বলে তীর্থকে ছেড়ে চলে এসেছিল । এত অদ্ভুত মানুষ একটি বারের জন্যও বন্যাকে বলেনি থেকে যাওয়ার কথা ।
তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে । বন্যার জীবনেও অনেক পরিবর্তন এসেছে । চাকরী-স্বামী-সন্তান নিয়ে সে এখন সম্পূর্ণ সংসারী। তীর্থর সাথে ছাড়াছাড়ির পর কিছুদিন ওর বোনের সাথে যোগাযোগ ছিল । তখনই শুনেছিল তীর্থ ওদের হায়দ্রাবাদের ব্রাঞ্চে ট্রান্সফার নিয়ে ওখানেই থাকে । তারপরের খবর অবশ্য জানেনা আর । নিজের সংসারে ব্যস্ত হয়ে তীর্থ কখন যে ধূসর অতীত হয়ে গিয়েছে বুঝতেও পারেনি ।
---কি ম্যাডাম একা একা কোথায় যাচ্ছেন?
তীর্থর ডাকে চমকে ওঠে বন্যা । ট্রেনের ভিড়টা কখন যে এতটা ফাঁকা হয়ে এসেছে খেয়াল করেনি । তীর্থ এসে ওর পাশে বসেছে বুঝতেই পারেনি ।
প্রায় সাতবছর পর কথা দুজনে । বন্যার চাকরী-সংসার সবকিছুর খবর নেয় তীর্থ । সাতবছরে তীর্থ যেন অনেকটা বদলে গেছে বলে মনে হয় বন্যার । এখন আবার কলকাতার অফিসে ফিরে এসেছে । কিন্তু এই লোকাল ট্রেনে কোথায় গিয়েছিল প্রশ্নটা যেন ইচ্ছা করেই এড়িয়ে যেতে চায় তীর্থ । পরে অবশ্য আলাপ করিয়ে দেয় একটু দূরের সিটে বসা ওর নতুন স্ত্রীর সাথে ।
বড় সাধারণ একটা মেয়ে। মিঃ তীর্থ সেনগুপ্তর আভিজাত্যের ছাপের বদলে যেন অকাল বার্ধক্যের মলিনতা বেশ অবাক করে বন্যাকে । তখনো আরো অবাক হওয়ার বাকি ছিল ওর । নতুন স্ত্রী প্রমিলা বিয়ের আগে একটা অনাথ আশ্রমের সাথে যুক্ত ছিল । এখনো সেই ছোটছোট বাচ্চাগুলোকে ছেড়ে থাকতে ওর নাকি কষ্ট হয় । তাই কাজের মাঝে অবসর পেলেই দুজনে চলে আসে ঐ আশ্রমে । গাড়িতে আসতে প্রমীলা সাচ্ছন্দ্য বোধ করেনা, তাই ওরা ট্রেনেই আসে ।
বন্যার চেনা তীর্থ সত্যি অনেক বদলে গেছে । ঐ রোগা কালো সাধারণ মেয়েটার কাছে নিজেকে কেমন যেন পরাজিত মনে হয় নিজেকে । ঐ মেয়েটা যে কাজটা পেরেছে , বন্যা তো সেটা পারেনি । তবে কি সম্পূর্ণটাই তার নিজের ভুল ছিল ? সেই কি কখনো বুঝতে অথবা বোঝাতে পারেনি তীর্থকে ?
ধূসর অতীতেও যে এতখানি পরাজয়ের গ্লানি লুকিয়ে আছে ভাবতেও পারেনি বন্যা ।
স্টেশন এসে গেছে , ভিতরের জ্বালাটা গোপন করে হালকা হেসে ট্রেন থেকে নেমে পড়ে বন্যা । বাড়িতে ওর মেয়ে আর বর অপেক্ষা করছে । কুণাল বলেছিল আজ সন্ধ্যেতে পুজোর কেনাকাটা করতে বেড়বে । একটু জোরে পা চালায় বন্যা । পুজো তো আর এসেই গেল.......