ধোকার ডালনা
ধোকার ডালনা


শ্রাবন মাসের শেষ বিকেল। গোমড়ামুখো আকাশের গাল ছুঁয়ে আদুরে রবি পা বাড়িয়েছে সীমান্তের পথে। পশ্চিমের আকাশ যেন ঠিক আগের রাতে ভিজিয়ে রাখা ছোলার ডাল বাঁটা। বারান্দার রেলিং ঘেঁষে পড়ন্ত রোদের ছোয়াঁ লেগেছে শঙ্করদের পুরোনো বাড়ির কার্ণিশেও।সেদিকে চোখ রেখে চায়ের কাপ হাতে হিয়া প্রহর গুনছে শঙ্করের।অনেকদিন হলো বাড়ি ফাঁকা করে শঙ্কররা চলে গেছে দক্ষিণ শহরতলির এক অভিজাত আবাসনে।এখন সেখানে বাস করে একঘর অবাঙালি ভাড়াটে।
শংকর চাকরি পেয়ে বাইরে যাবার ছয় মাস পর আজ আবার দেখা হবে তাদের।অনেকদিন পর মনটা তাই আজ একটু বেশিই খুশিখুশি।একরাশ রঙিন প্রজাপতি যেন ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে শরীর জুড়ে।
খানিক বাদে সামনে দিগন্ত প্রসারিত স্কাই লাইন এর আড়ালে হঠাৎই টুপ্ করে ডুব দিলেন দিননাথ। ঠিক যেন কড়াইয়ের গরম সর্ষের তেলে আলতো করে ছেড়ে দেওয়া ছোলার ডালের মণ্ড।
একে একে গলির মুখে আর বড় রাস্তার ত্রিফলা বাতিগুলো জ্বলে উঠতে লাগলো।বেশ কিছুক্ষন হলো শঙ্করের ফোন সুইচইড অফ।এক ফাঁকে টুক করে সামনের মুদিখানার দোকান থেকে জিনিস কেনার নাম করে হিয়া ঘুরে এলো বড় রাস্তার মোড়টা।কিন্তু অফিস ফেরত চেনা-অচেনা মানুষের ভিড়ে কোথাও খুঁজে পেলোনা শঙ্করকে।বাড়ি ফিরে আবার এসে দাঁড়ালো বারান্দায়।
সময় ক্রমশ প্রতিশ্রুতির সীমা লঙ্ঘন করে বেয়াদবের মতো ছুটে চলেছে। কড়াতে নরম আঁচে ডাল বাঁটা ক্রমাগত নাড়াচাড়া করার মতো তখন বারান্দা জুড়ে হিয়ার অস্থির পায়চারি। অন্যদিনের মতোই পাড়ার কালীমন্দির থেকে ভেসে এলো সন্ধ্যারতির কাঁসর ঘন্টার শব্দ। সেই সাথে ভেসে এলো মুখার্জীদের বাড়ির টিভিতে চলা সিরিয়ালের কথোপকথন। কড়াইয়ে দেওয়া ডাল বাঁটায় পরিমান মতো নুন, হলুদ, জিরেগুঁড়ো ,লঙ্কাগুঁড়ো আর স্বাদমতো সামান্য চিনি দিয়ে নাড়াচাড়া করার মতোই অম্লমধুর হরকিসিমের বোলচাল।
ড্রয়িং রুমে রাখা দেওয়ালজোড়া বাহারি ঘড়িতে চোখ পরে গেলো হিয়ার। "নাহ্....আজ বোধ হয় শংকর আর আসবে না।" কড়াইয়ে বেশ কিছুক্ষন মসলাসহযোগে ওই ডাল বাঁটা নাড়াচাড়া করার মতোই হিয়ার মনেও চলছিল শঙ্করকে নিয়ে নানা ভাবনা আর আশঙ্কার দোলাচল।তবে কি তার দিদি কেয়া ঠিকই বলেছিলো যে শংকর তাকে নিয়ে শুধু খেলা করেছে! শঙ্করকে ভালো লাগার কথা আর তাকে নিয়ে সব সিক্রেট যে একমাত্র সে তার দিদি কেয়ার সাথেই শেয়ার করেছিল।
কড়াই থেকে তুলে নেওয়া ডালের মন্ডের মতোই শরীর ক্রমে জড়োসড়ো আর অবশ হয়ে আসছিলো হিয়ার।
সন্ধ্যে পেরিয়ে এখন রাত । পড়তে বসতে হবে এরপর। কাল আবার কলেজে ক্লাস টেস্ট আছে। আর দাঁড়ানো ঠিক হবে না। মা দেখে ফেললে ঠিক সন্দেহ করবে। হিয়া নিশ্চিত হলো যে কড়াই থেকে তুলে নেওয়া ডালের মণ্ড থালায় রেখে ঠান্ডা হলে বরফির আকারে আকারে কেটে কেটে যেমন তেলে ভেজে ধোকা বানানো হয় ঠিক তেমনি শংকর তিলে তিলে ধোকা দিয়েছে তাকে। ঘরের দিকে পা বাড়ালো হিয়া। আর ঠিক তখনই ড্রয়িং রুমে রাখা ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠলো তারস্বরে। ছুটে গিয়ে হিয়া ফোনটা কানে চেপে ধরতেই ওপার থেকে ভেসে এলো সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর, যার জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল হিয়া।
-"তোমাকে মোবাইলে অনেক্ষন ধরে ট্রাই করছি। কিছুতেই লাইন পাচ্ছি না। তাই ল্যান্ডফোনে ফোন করলাম।"
-" আজ আসবে না , সেটাই বলবে তো?"
-" না না। আসবো বলেই তো বেড়িয়েছিলাম। কিন্তু.."
-"কিন্তু কি শংকর?"
-" একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়ে গেলো ।"
-" মানে? কি হয়েছে তোমার? খুলে বলো প্লিজ"
- " উফ্, উতলা হয়ো না অত। তেমন কিছু হয়নি। বাইক নিয়ে পড়ে গেছিলাম রাস্তায়। চাকাটা স্কিড করে গেছিল। মোবাইলটাও পড়ে গিয়ে খারাপ হয়ে গেলো। আমাদের পাড়া থেকে বেরোনোর মুখে নতুন গর্তটা ঠিক ঠাহর করতে পারিনি আসলে। কপাল ভালো, উল্টো দিক থেকে কোনো বড় গাড়ি আসছিল না। না হলে..."
-" ইশ, বালাই ষাট।"
-" যাই হোক ভেবো না তুমি। ফাঁড়াটা অল্পের ওপর দিয়েই গেছে। তেমন লাগেনি। পাড়ার ছেলেরাই ধরে নিয়ে গেল ক্লিনিকে। ডাক্তার সেনকে দেখালাম। একটা এক্সরে করতে দিলেন। আর কিছু ওষুধ দিয়ে বললেন কমে যাবে। চিন্তার কিছু নেই। এই সব ঝামেলা সেরে আজ আর যাওয়া হলো না। ভেরি সরি। কাল বিকেলে যাবো তোমাদের বাড়ি । "
" আচ্ছা তবে বাইক নিয়ে এসো না। "
" না। মেট্রো ধরে পৌঁছে যাবো। ভাবছি এবার মাসিমার সাথে কথা বলতে হবে। তুমি থেকো কিন্তু।. "
-"আচ্ছা,"
আর কথা না বাড়িয়ে রিসিভারটা আস্তে করে নামিয়ে রাখল হিয়া।ততক্ষনে সরে গেছে আশংকার কালো মেঘ। মন জুড়ে তখন শুধুই ফুটফুটে জ্যোৎস্না। শংকর ধোকা দেয়নি।মানুষ চিনতে ভুল হয়নি হিয়ারও। কড়াইয়ে তেলে তেজপাতা ফোড়ন দিয়ে টুকরো করে কাটা আলু ভেজে তাতে পরিমানমতো নুন, মিষ্টি, লঙ্কাগুঁড়ো ও জল দিয়ে ফোটানো ঝোলে ধোকাগুলো ছেড়ে নরম আঁচে রান্না সম্পূর্ণ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করার মতোই হিয়ার অপেক্ষা আগামীকাল একটা সুন্দর দিনের। সুস্বাদু ধোকার ডালনার মতই তাদের ভালোবাসার স্বাদও যে স্বর্গীয়। হিয়া ঠিক করলো শঙ্করের জন্য কাল নিজের হাতে রান্না করবে শঙ্করের প্রিয় ধোকার ডালনা।তাতে ছড়িয়ে দেবে পরিমাণমতো দেশি গাওয়া ঘি আর সামান্য গরম মসলা।সঙ্গে থাকবে মায়ের হাতে ভাজা গরম গরম ফুলকো লুচি। ব্যাস আর কি চাই।
আপাতত শুধু অপেক্ষা আর একটা দিনের ।