ডাকিনীর মায়াজালে
ডাকিনীর মায়াজালে
অন্তিম পরিণতিটাই আগে বলে দিই - তন্দ্রার শিশুকন্যা এবং সংসার, দুটোই চলে গেলো! শুধুই ডাকিনি বিদ্যার অপপ্রয়োগের কারণে।
শক্তি বা অস্ত্র, সে যত অব্যর্থই হোক না কেন, তাকে সংবরণ করতে জানা ভীষণ জরুরী। মহাভারতেও আছে - অর্জুন এবং অশ্বত্থামা, দুজনেই ব্রহ্মাস্ত্রের প্রয়োগ জানতেন। কিন্তু অর্জুন জানলেও, অশ্বত্থামা জানতেন না - তার নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি।
ফলে কি হলো - বিশ্ব ধ্বংস হবার উপক্রম হলো, দুই সর্বোচ্চ বিধ্বংসী মারণাস্ত্রের প্রয়োগে। শ্রীকৃষ্ণের হস্তক্ষেপে অর্জুন নিরস্ত হলেন, কিন্তু অশ্বত্থামা নিরুপায়। অস্ত্রসংযোগ করে ফেলায়, তিনি বাধ্য হলেন তাঁর অস্ত্রকে, ঐ একবারের জন্যই প্রয়োগ করতে।
গুরু দ্রোণাচার্য, তাঁর পুত্রের চরিত্র সম্পর্কে, এতটাই স্থির ও নিশ্চিত ধারণা পোষন করতেন, যে - পুত্রবাৎসল্যের কারণে বাধ্য হয়ে, তাকে ঐ মারণাস্ত্র প্রয়োগ শেখালেও, কেবল একবারই প্রয়োগ করার মত, অস্ত্রশিক্ষাটুকুই দিয়েছিলেন।
শিক্ষাদানের সময়, শিক্ষকের দূরদর্শিতা - কেন এত জরুরী, এর থেকেই বোঝা যায়। অশ্বত্থামা সেদিন, অস্ত্র সংবরণ করতে না পেরে, তখনও ভূমিষ্ট না হওয়া, পিতৃহীন পরীক্ষিতকে নিধন করেছিলেন - উত্তরার গর্ভে।
তন্দ্রাও সেই একই ভুল করে বসলো - অাধ-শেখা ডাকিনীবিদ্যা প্রয়োগ করতে বসে, নিজেরই শিশু কন্যাকে, তার বলি করে ফেলে! পরীক্ষিতকে বাঁচানোর জন্য তো স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ হাজির ছিলেন, কিন্তু তন্দ্রার?
তার গুরুমাতা পারেন নি তাকে তখনও সেই শিক্ষা দিতে, যার দ্বারা সে শিশুটির প্রাণরক্ষা করতে পারতো। অগত্যা, মা হয়েও নিজের সন্তানকেই মেরে ফেলার গ্লানি, গ্রাস করে ফেললো তন্দ্রাকে। সংসারধর্ম ত্যাগ করলো সে।
মূল কাহিনীর সূত্রপাত ঘটে, এই ঘটনার বহু আগে। তন্দ্রা নিজেই তখনও জন্মায় নি। ওর শাশুড়ি মা, মাধবী দেবীই তখন সবে তাঁর পুত্র জয়কে জন্ম দিয়েছেন।
সেইসময়, জয়দের প্রতিবেশী, রুনু ও তার ভাই বিশু - আত্মহত্যা করে তাদের বাড়িতে। বিশু, গলায় ফাঁস আটকে মারা যায়, আর রুনু মারা যায় - অগ্নিদগ্ধা হয়ে।
গায়ে জ্বলন্ত অগ্নিশিখা নিয়ে, বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে, সে ঝাঁপ দিয়েছিলো পুকুরঘাটে। কিন্তু পুকুরেই জল কম থাকায়, সে নিজের গায়ের আগুন নেভানোর আর সুযোগ পায়নি।
এই দুই আত্মহত্যারই, কোনো অফিসিয়াল রেকর্ড নেই। বিশু ও রুনুর একমাত্র দাদা, কিনু তখন অন্যত্র বাস করতো। বাড়িতে ছিলো শুধু তাদের বৃদ্ধা মা। তাঁর অনুরোধেই গ্রামের লোকেরা, শ্মশানে ঐ দুজনের শবদাহ করে দেয়। তাদের মৃত্যুনিবন্ধন করায় নি কেউ। এমনকি পিণ্ডদানও হয়নি।
মাধবী দেবী, তুলা রাশির জাতক হওয়ায়, তাঁর মাঝে সাঝেই সাক্ষাত হয়ে যেত - অতিপ্রাকৃত বস্তু বা বিষয়ের সঙ্গে। দু একটা উদহরণ দিলেই বিষয়টা স্পষ্ট হবে -
রাতের খাওয়া দাওয়ার পর, এঁটো বাসনগুলো ধোয়ার জন্য ঐ পুকুরঘাটে এসেছেন মাধবী। ধোয়ার কাজও প্রায় সমাপ্ত হয়ে এসেছে, এমন সময় পিছন থেকে কেউ বললো - খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলো?
রুনুর গলা না! মাধবী পিছন ফিরে দেখেন কেউ নেই। তাঁর স্বামী, গরুগুলোকে গোয়ালবাড়ির চালায় বেঁধে, তখন ঐ দিকেই ফিরছিলেন। তিনি তাঁর সাথেই দ্রুত বাড়ি ফিরে আসেন।
একদিন মধ্যরাতে, আকাশ জ্যোৎস্নায় ভরা সেদিন - জয়কে বাথরুম করাতে উঠেছেন। শুনতে পেলেন - পাশের রান্নাঘরে, তাঁর স্বর্গীয়া খুড়শাশুড়ি, সুর করে করে মুড়ি ভাজছেন।
গ্রামের দিকে, আগে, বাড়ির গিন্নিরা নিজের নিজের বাড়িতেই ধানসিদ্ধ করতেন, ঢেঁকিতে সেই ধান ভানতেন, আর সেই চালের মুড়িও ভাজতেন। ভোরবেলা উনুন জ্বেলে চাল নাড়তে বসতেন।
দীর্ঘক্ষণ ধরে, কাঠের হাতায় গরম চাল নাড়ার ব্যথা ভুলে থাকতে, তাঁদের বেশিরভাগ জনই, সুর করে গান ধরতেন - কেউ পাঁচালী, কেউ আত্মীয় বিয়োগের কাহিনী, এইসব নিয়ে।
কতবার তো, রাতে বাসন ধুয়ে মাধবী ফিরছেন বাড়ি; দেখতেন - তাঁর সামনে দিয়েই, হন হন করে হেঁটে, ধূতি পড়া, খালি গায়ে, স্বর্গীয় চাটুজ্জ্যে মশাই, দূর্গাবাড়িতে গিয়ে ঢুকলেন!
এঁরা কেউই তাঁর কোনো ক্ষতি করেন নি, শুধু দর্শন দিতেন। কেন দিতেন, তাও তখন জানতেন না মাধবী দেবী। তাঁদের বক্তব্য, তখন না তিনি বুঝতে পেরেছেন, না বুঝতে চেয়েছেন।
কিন্তু, এখন বুঝতে পেরেছেন - কেন তাঁরা বারবার দর্শন দিতেন। কি কথা, তাঁরা বোঝাতে চাইতেন তাঁকে দর্শন দেবার, বা আওয়াজ দেবার মধ্যে দিয়ে।

