ডাকিনীর মায়াজালে - ৪র্থ পর্ব
ডাকিনীর মায়াজালে - ৪র্থ পর্ব
যে কয়দিন, সরমা মেয়ের বাড়িতে সেবার ছিলেন, মেয়েকে তন্ত্র সাধনার হাতেখড়িটা - ভালোমতই করিয়ে দিয়ে, রোজ অনুশীলন করতে বলে গেলেন।
মায়ের বশে এসে, তন্দ্রাও তখন মায়ের আদেশ শিরোধার্য্য করে, তাঁর আজ্ঞা পালনে বাধ্য হয়ে উঠেছিলো। রোজ রাতে জয় ঘুমালে, ঘরে সে তন্ত্র মন্ত্র নিয়ে চর্চায় বসতো।
কিন্তু একদিন, কোন কারণে ঘুম ভেঙে যায় জয়ের। পাশে তন্দ্রা ছিলো না। সে পাশ ফিরে খাটের নিচে মেঝেয় - কুপি জ্বেলে ধ্যানমগ্ন তন্দ্রাকে দেখতে পেলো!
কারেন্ট থাকা সত্ত্বেও, কুপি জ্বলছে দেখে বেশ অবাক হয় সে। তারপর, তন্দ্রার মুখের দিকে চাইতেই, সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো!
এ কি সাজ তন্দ্রার? চোখের পাতায় মোটা করে পড়া কাজল। কপালে এত্তবড় সিঁদুরের একটা ফোঁটা কাটা - নাক থেকে সিঁথি হয়ে মাথার মাঝ অবধি টানা!
মাথার কোঁকরানো এলোচুল থেকে টপ টপ করে ঝরছে জলের ফোঁটা। তার জলে ভেজা খালি গায়ে, শুধু একটা গেরুয়া কৌপিন জড়ানো! কুপিটা যেন তার সাধনার হোমকুণ্ড!
গলায় একটা ফুলের মালা, হাতেও। সামনের মেঝেয় কিসব হাবিজাবি আঁকা! তার ওপর নানা রকমের নুড়ি, কাপড়ের টুকরোয় বাঁধা শেকড় বাকর, আরো কত কি!
তন্দ্রার চোখ বন্ধ থাকায় সে দেখতে পেলো না, জয়ের জেগে ওঠা এবং তার কাজকর্ম দেখার বিষয়টা। জয় চুপচাপ শুয়ে শুয়ে, দেখতে লাগলো - তন্দ্রার কার্যকলাপ।
অনেক ক্ষণ পর চোখ খুললো তন্দ্রা। নিজের সাধনার জিনিসপত্র সব গুছিয়ে, একটা ছোট্ট কাঠের বাক্সে রেখে, তার আলমারীর লকারে ঢুকিয়ে রাখলো!
তারপর, উঠে বাথরুমে গেলো। বাথরুম থেকে ফিরলো আবার স্নান করে। পড়নের কৌপিনটা ত্যাগ করে, আবার রাতে ঘুমানোর পোশাক পড়লো।
কৌপিনটাও ভাঁজ করে ঢুকিয়ে দিলো - তার সেই আলমারীর লকারে! সঙ্গে কুপিটাও নিভিয়ে দিয়ে লুকিয়ে রাখলো আলমারীর পিছনে - এমনভাবে, যাতে কারোর নজর না পরে।
কৌপিন ত্যাগের সময়, জয় সেই কুপির আলোতেই দেখতে পেলো - তার গ্রীবাদেশে, দুই স্তনবৃন্তে, নাভিদেশে, বাহুমূলে ও পদমূলে রক্তিম চন্দনের প্রলেপ! দুইহাতের তালুতেও ছিল লাল ফোঁটা।
জয় বুঝতে পারে, কেন মিলনের ইচ্ছায় - কোনো রকম উৎসাহ দেখানোর পরিবর্তে, তন্দ্রা ইদানীং কেবল বাধাই দেয়, শরীর ভালো না লাগার অজুহাত দেয়! কাছে আসতে চায় না তার!
সেদিন, তাকে কিছু না বললেও, পরদিন ঘুমের ভান করে, দীর্ঘক্ষণ শুয়ে থাকে জয়। তারপর, যেই তন্দ্রা উঠে বসে, অমনি যেন তারও ঘুম ভেঙে গেছে - এমন ভাব করে উঠে পড়ে।
তন্দ্রার আর সে রাতে, সাধনায় বসা হয় না। জয় এরপর রোজ শুতে দেরী করা, আর তন্দ্রা নিজে না ঘুমানো অবধি, জেগে থাকতে শুরু করে দেয়।
ফলস্বরূপ, তন্দ্রার তন্ত্র সাধনা বন্ধ হয়ে পড়ে। তার মনও ধীরে ধীরে, মিলনেচ্ছায় সাড়া দিতে থাকে এরপর। এবং তারপর, কয়েক মাসের মধ্যেই সে - সত্যিই সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে।
স্বাভাবিকভাবেই, তার তন্ত্রসাধনায় তখন থেকেি, স্থায়ী ছেদ পড়ে যায়। এরপর যথাসময়ে, একটি কন্যাশিশুর জন্ম দিলো সে। শিশুটিও অসম্ভব আদুরে ছিলো।
তার কলকল্লোলে, বাড়ি ভরে থাকতো সারাক্ষণ। সবাই, তাকে নিয়ে মেতে থাকতো। এরপর, কোনো একদিন, ঘর সাফ করতে গিয়ে, কাজের বৌ খুঁজে পায় সেই কুপিটা।
মাধবীর কাছে তখনও, তন্দ্রার তন্ত্র সাধনার কথা খুলে বলেনি জয়। তাই, ঐ বিষয়ে মাধবীর জিজ্ঞাসা গুলো, সরল মনে করা হলেও, তন্দ্রা তাতে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে।
সে খবর যায় সরমার কাছেও। তিনি, এই সুযোগ হাতছাড়া করতে, রাজী হলেন না কিছুতেই। তন্দ্রাকে আবার তন্ত্রসাধনায় ফিরিয়ে আনার - এটাই ছিলো তাঁর উৎকৃষ্ট সুযোগ।
তিনি মেয়েকে বোঝালেন, তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ভুল করতে চলেছে। পাশের বাড়ির সেই দুই প্রেতাত্মাকে, তিনি মুক্ত করে দিয়েছেন - ঐ বাড়ির বাঁধন থেকে।
অবশ্য এর ফলে, ভালো হবে বলেই তিনি ঐকাজ করেছেন - তারা এখন নিজের দাদার কাছে গিয়ে, তাদের মুক্তির জন্য, আবার দরবার করতে পারবে।
কিন্তু তারা, এ বাড়িতে ঢুকতে না পারুক, রাস্তা ঘাটে বা অন্যত্র, চাইলেই এসে হাজির হতেও পারবে - জয়দের সামনে। তাতে, তাঁদেরও বিপদ হতে পারে, যদি না তন্দ্রা - তন্ত্রবলে তাদের রক্ষা করে।
আসলে এসবের পিছনে, সরমার উদ্দেশ্য ছিলো - মেয়েকে ভয় দেখিয়ে, আবার বশে আনা। আর তার শ্বশুরবাড়ির লোকেদেরও। শিশু নাতনিটার জন্য, তন্দ্রাকে জলপড়া খাওয়াতে, ঠিক সাহস পাচ্ছিলেন না তিনি।
যথারীতি, তন্দ্রা তাঁর কথায় আবার তন্ত্র সাধনা শুরু করে। সরমা, কয়দিনের জন্য মেয়েকে বাড়ি নিয়ে আসেন। দিনরাত বাড়িতে তন্ত্র মন্ত্র নিয়ে ডুবে থাকলেন - মা মেয়ে দুজনে।
তাঁর শ্বাশুরিই সামলালেন, তখন তন্দ্রার মেয়েকে। সরমা কয়দিনেই, বেশ কিছু তুক তাক, মোহিনী বিদ্যা, বশীকরণের টোটকা, জলপড়া - এসবে সিদ্ধহস্ত করে তুললেন মেয়েকে।
তন্দ্রাও, যতই হোক - ঐ মায়েরই মেয়ে তো! ঐসব বিদ্যার্জনে, সেও পারদর্শীতা দেখালো খুব। সেবার, বাপের বাড়ি থেকে ফেরার আগে, সেও রীতিমত তন্ত্র মন্ত্রে এক্সপার্ট হয়ে উঠলো।
সরমা, নিজের অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়ে, মেয়েকে শেখালেন - কিভাবে তাকে, এবার শ্বশুরবাড়িতে ফিরে, প্রথমে নিজের স্বামী, তারপর শ্বশুর-শ্বাশুরিকে বশ করতে হবে!

