ডাকিনীর মায়াজালে - ২য় পর্ব
ডাকিনীর মায়াজালে - ২য় পর্ব
এর কয়েক বছর পর, গঙ্গা পার্শ্ববর্তী কোন এক গ্রামে, বিয়ে হয়ে আসেন সরমা। তন্দ্রাকে তিনি জন্ম দেবার আগে, নিয়মিত তন্ত্র মন্ত্র, কালাজাদু, বশীকরণ এইসব নিয়ে চর্চা করতেন।
আসপাশের এমন কোন তান্ত্রিক, কাপালিক, ওঝা বৈদ্য ছিলো না, যার কাছে তিনি যাননি। অনেক ঠাকুরবাড়ি, যেখানে এইসব ঝাড়ফুঁক করানো বা শেখানো হয় - তিনি সেখানে নিত্য যাতায়াত করতেন।
তাঁর বহুদিনের, সুপ্ত ইচ্ছে ছিলো - তিনি তন্ত্রসাধনা করে মহা তান্ত্রিক ও 'খনা' মার মত ভবিষ্যত দ্রষ্টা হবেন। নিজের পারিপার্শ্বিক সবকিছু থাকবে তাঁর নিয়ন্ত্রণে।
এর জন্য, দায়ী অবশ্য তার বাপের বাড়ির লোকজনই ছিলো। একদিকে তারা দেবদ্বিজে ভক্তিশীল ছিলো আর অন্যদিকে, তাদের কেউই - ঐ বিষয়ে অত্যুৎসাহী সরমাকে, বিশেষ গুরুত্বই দিতেন না কখনও।
এই দ্বিচারিতা, বাধ্য করে সরমাকে - এমন কিছু করতে, যাতে বাড়ির লোকজন তাকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হয়। তিনি তখন থেকেই, গোপনে তন্ত্র সাধনা করতে ও কালাজাদু শিখতে শুরু করে দেন।
তাঁর বাড়ির লোকজন, তখন কিছুই জানতো না। নিজে বিশেষ পড়াশুনা না জানলেও, এই সমস্ত অপশিক্ষায় তাঁর প্রত্যুৎপন্নমতি ও প্রতিভা, দেখতে পেয়েছিলেন তাঁর তন্ত্রগুরুরা। খুব দ্রুত, তিনি তাঁর সেই শিক্ষায় অগ্রগতিও করেন।
আর তাঁর সেই শিক্ষার দৌড়, প্রথম দেখে তাঁর বাড়ির লোকেরাই। নিজের শিক্ষার হাত - কতটা পেকেছে, তা দেখাতে প্রথমবার, তিনি তাঁর শিশু খুড়তুতো বোনের ওপর, প্রয়োগ করেন নিজের বিদ্যা।
শিশুটি চনমনে, ক্রিয়ারত অবস্থায় থাকাকালীনই, আচমকা নেতিয়ে পড়ে। বাড়ির লোকজন ডাক্তার বদ্যি, ওঝার কাছে দৌড়াদৌড়ি করেও, কোনো ওষুধ পথ্যেই তাকে, সুস্থ করে তুলতে পারে না।
আটচল্লিশ ঘন্টা মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে থাকার পর, বাচ্চাটাকে বোধ হয় আর বাঁচানো যাবে না - এই ভেবে যখন, সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছিলো, তখনই সরমা নিজের হাতযশ দেখালেন, এগিয়ে এসে।
নিজেরই মন্ত্রে বাঁধা শিশুটির, বাঁধন আলগা করে দিয়ে, তাকে নিজের তন্ত্র বিদ্যার সাহায্যে, মন্ত্রপূতঃ জল ছিটিয়ে, পুনর্জীবিত করে তুললেন। সবাই খুব খুশী হলো, তার তন্ত্রসাধনার জোড় দেখে। সঙ্গে তাকে সমীহ করতেও শুরু করলো।
সরমা তখন থেকেই, তন্ত্রবিদ্যায় তাঁর সমস্ত জ্ঞান, উত্তরোত্তর আরো বৃদ্ধি করে যেতে থাকেন। তিনি গৃহবধূ হয়ে এসে, প্রথম রাতেই স্বামীকে জলপড়া সেবন করিয়ে, নিজের এমন বাধ্য করে নিয়েছিলেন যে, সে আজও তার কথায় ওঠবস করে।
তাঁর শ্বাশুরি ছিলেন এমনিতেই সরল সাধাসিধে, তার ওপর ছেলেও বৌমার বশ হয়েছে দেখে, তিনিও ম্রিয়মানই থেকে যান। তিনি কোনোদিনই তাঁকে, জোর গলায় কথা পর্যন্ত বলেন নি।
সরমার একচ্ছত্র রাজত্ব চলে তাঁর শ্বশুর বাড়িতে। কিন্তু তাঁর মনে দুঃখ ছিল একটাই - তাঁর মেয়ে হয়েও, তন্দ্রা মায়ের এত গুণ, এত তন্ত্র মন্ত্র শিক্ষার প্রতি, কোন আগ্রহই দেখায় নি কখনও!
সরমা বারবার চেষ্টা করেছেন - তাঁর মেয়েকে নিজের মত তান্ত্রিক বা সাধিকা না হোক, অন্তত তন্ত্রমন্ত্রে যথেষ্ট জ্ঞানার্জন করে, শক্তিশালীনি করে তুলতে। শ্বশুর বাড়ি গিয়ে, সেও তাহলে তাঁর মতই, রাজ করতে পারবে।
তন্দ্রা, নিজের মাকেই সবথেকে বেশি ভয় করে পৃথিবীতে। তাঁর তন্ত্রসাধনা ও তার ক্ষমতা সম্পর্কে - তার ভালোমত জ্ঞান ছিলো। তাই, ঐ বিষয়টা থেকেই ভয়ে, সে দূরে দূরে থাকতো।
তন্দ্রার মনে, বরাবর ভয় ছিলো - ঐ সব তন্ত্রসাধনা টাধনা, তার দ্বারা হবার মত কর্ম নয়। জোর করে সে যদি, তন্ত্র মন্ত্র নিয়ে জোরজার খাটাতে যায়, তো নিজেরই না সর্বনাশ করে বসে।
সেই ভয়েই, তার মা যখনই - তাকে ঐসব শেখানোর কথা বলতো, সে কোনো না কোনো অজুহাতে, সেটা ঠিক এড়িয়ে যেতো। কখনই তন্ত্র মন্ত্র নিয়ে মায়ের সাথে আলোচনায় বসেনি।
কুমারী অবস্থায়, সে বরাবর মাকে এড়িয়ে গেছে। কিন্তু বিয়ের পর যখন জয়দের বাড়িতে আসলো, তখন তার মায়ের অদ্ভূত ঔৎফুল্ল দেখে, সে একটু আগ্রহী হয়ে উঠলো বিষয়টা জানতে।
সরমা তাকে জানালেন - তার শ্বশুরবাড়ির আসে পাশে, একাধিক অতৃপ্ত, আত্মার ছড়াছড়ি। চারি দিকে ছড়ানো, তাঁর মত তন্ত্রসাধিকার জন্য - এক অতি সাধের পরিবেশ।
এখানে তিনি থাকার সুযোগ পেলে, সেও নিজে চাইলে, কয়েক দিনের মধ্যেই, মায়ের মতই অমন ক্ষমতাশালী হতে পারবে। সেও ঐরকম তন্ত্র বল লাভ করতে পারবে, আর সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
এতদিন ধরে নিজেকে সামলে রেখেছিলো তন্দ্রা। তবুও শেষ পর্যন্ত, মায়ের সাথে হাত মেলাতেই হলো, তাকে। আর নিজের সর্বনাশটাও - সে নিজেই তখন করে বসলো।

