ছায়াযুদ্ধ
ছায়াযুদ্ধ
দশকের পর দশক পেরিয়ে গেলেও, মনিপুরীদের উপর যৌন হেনস্থা –অত্যাচারের ঘটনা ঘটে গেলেও, রাষ্ট্র নির্বিকার । আমার এক অফিস কলিগ শিল্পা বরদৌলি এই নিয়ে অনেকবার বলেছে ।
আমি একটি বাংলা সংবাদপত্রে ট্রেনি রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছি কদিন হল।
নর্থ ইস্ট টা দেখার আমার অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল তাই একটা স্টোরি করব ভেবে সিনিয়র কে বলতে তিনি রাজী হয়ে গেলেন। স্টোরিটা পছন্দ হলেই আমার চাকরি পাকা এবং ডেড লাইন টেন্থ অগাস্ট।
বেড়িয়ে পড়লাম। তবে এভিডেন্স কিছুই নেই । সিনিয়র একজন আইনজীবীর নাম্বার দিয়েছেন।
প্রথমে আইনজীবী জিনিয়া গোমসের সাথে ইম্ফলে তার চেম্বারে মিটিং ঠিক হল। রবিবারের সকাল। বাইরে ঝির ঝির বৃষ্টি পড়ছে। আমি পৌঁছলাম। জিনিয়া কফি সহযোগে আমার সাথে বসলেন। তার বক্তব্য – প্রমিলাকে 'আসামস রাইফেলের' কয়েকজন সেনা বাড়ি থেকে রাতের বেলা তুলে নিয়ে যায়। তারপর সে বাড়ি না ফিরলে তল্লাশি চালিয়ে তার মৃতদেহ পাশের জঙ্গল থেকে পাওয়া যায় ঘটনার কিছুদিন পর। ফরেনসিক রিপোর্টে ধর্ষণ প্রমাণিত হয়। তার দেহে এমনকি গোপনাঙ্গেও মেলে অগুন্তি গুলির ক্ষত । সেনাবাহিনীর অকথ্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে কাংলা দুর্গের সামনে মহিলারা নগ্ন হয়ে মিছিল করেন। ব্যানারে লেখা ছিল - 'আমাদের ধর্ষণ কর ভারতীয় সেনা।'
তড়িঘড়ি কমিশন বসে। ন্যায় বিচারের আশ্বাস দেওয়া হয়। তদন্ত কমিশনে, সেনাবাহিনীকে দোষীসাব্যস্ত করা হলেও শেষপর্যন্ত এই পনেরো বছরেও কোন এক অজ্ঞাত কারনে এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয় নি। কিন্তু আমরা লড়ছি, লড়বও।
জিনিয়ার বক্তব্যের শেষে ওর শক্ত চোয়ালের দিকে তাকিয়ে আমার আর কিছু বলতে সাহস হচ্ছিল না।তবু প্রমিলার বাড়ির লোকেদের কথা জানতে চাইলে উনি একটা কাগজে বিনোদ বাসনেটের ঠিকানা ও নাম্বার লিখে দেন।
বিনোদ বাসনেট হল প্রমিলার বাবা এবং একজন ইতিহাসের প্রফেসর। তিনি সব কিছু ছেড়ে ইম্ফল থেকে প্রায় একশ কিমি দূরে খংটালের কাছে একটি প্রত্যন্ত গ্রামে থাকেন।
আমিও ওনার সাথে যোগাযোগ করে সেদিনই বেড়িয়ে পরলাম। প্রায় চার ঘণ্টা আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ দিয়ে সেনা ব্যারাক পেড়িয়ে পৌঁছলাম খংটালে।
বেশ নিরিবিলি গ্রাম। পাশেই জঙ্গল। তবে নাকা চেকিং চলছে। জানতে পারলাম, কাল টহলদারির সময় তিনজন জওয়ান পাশের জঙ্গল থেকে বেপাত্তা হয়ে গেছে। তল্লাশি চলছে।
গাড়ির শব্দে বিনোদ বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে এসছিল। আমায় দেখে ভেতরে নিয়ে গিয়ে আমার ঘর দেখিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে বলল।
ফ্রেশ হয়ে যখন একতলা বাড়ির বারান্দায় বসলাম, তখন দিনের আলো ছুটি নিয়েছে। চারিদিকে অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে। দূরের আলোর বিন্দু গুলোকে স্থানীয় মানুষের বাসা বলেই ঠাওর হচ্ছে। চা খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন আছেন ?
চোদ্দ পনেরো বছর কেটে গেল কোন সুরাহা হল না। কি ভাবছেন!
বলি রেখায় ক্ষত বিক্ষত মানুষটার মুখটা আমারদিকে একটা গভীর দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে অন্ধকারের দিকে চলে গেল। চোখের ভাষা আমি পড়তে পারিনি!
তারপর ঠাণ্ডা গলায় বলল চোদ্দ পনেরো বছর। আমি তো জানি স্বাধীনতার আগে থেকেই আমরা ব্রাত্য!
আমি বললাম প্রমিলার ঘটনা টা অবশ্যই দুঃখজনক। তাই বলে আপনারা নিজেদের…।
কথা থামিয়ে দিয়ে এবার বিনোদ আমার দিকে আরও নিচু গলায় বলল কনকলতা বরুয়ার নাম শুনেছ! মণিপুরের রানি গাইদিনলিউ বা ভারতরত্ন খুয়াংচেরার নাম শুনেছ। স্বাধীন ভারতের প্রথম পতাকা উড়েছিল মিরাংয়ে
জানো। ঘর থেকে একটা বই এনে পাতার পর পাতা ছবি দেখিয়েছিলেন।
আমি সেসব মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনেছিলাম। মেনে নিয়েছিলাম, না, এসব ইতিহাস আমার অজানা।
তারপর সেই অমোঘ অনিবার্য প্রশ্নটা করেছিল ভদ্রলোক – এরপরও বলবে আমরা ব্রাত্য নয়! সব ঠিক আছে।
আমি মাথা নিচু করে নি।
ভদ্রলোক বলতে থাকেন – প্রমিলা একা নয়, এই গ্রামের অনেক মেয়েই ওই জঙ্গলে হারিয়ে যায় রাতের অন্ধকারে। কাল ওদের তিনজন হারিয়ে গেছে তাই আজও চিরুনি তল্লাশির নামে কোন না কোন প্রমিলা, মনোরমা হারিয়ে যাবে রাতের অন্ধকারে। কখনও ছিন্নভিন্ন দেহ পাওয়া যায় কখনও যায়না। এ ছায়া যুদ্ধ চলতেই থাকবে নিরন্তর। সব কী খবর হয় !
আপনার ভয় লাগে না !
লাগতো। তবে আর লাগে না। অন্ধকারে থাকতে থাকতে সব সয়ে গেছে।
কথায় কথায় রাত বাড়ে। আমরা উঠে পড়ি। রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে যাবো, দরজায় টোকা পড়ে।
বিনোদ এসে বলে ওরা এসেছে – তোমার সাথে কথা বলতে চায়। আমি গিয়ে ওদের প্রেসের আই কার্ড দেখালে ওরা চলে যায় তবে কাল একবার ব্যারাকে মেজরের সাথে দেখা করতে হবে। সকালে গাড়ি আসবে নিতে।
গোল রুটির মত চাঁদ রাতের কালো আকাশে ঝলসে উঠে অমঙ্গলের আভাস দেয়।
নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যে বড় হওয়া আমি, তাকে জ্যোৎস্না ভেবে র্যোম্যান্টিসিজমের জাল বুনতে বুনতে সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ বুজি।
একজন মহিলার ডাকে ঘুম ভাঙে। চাপা স্বরে সেই ছায়ামূর্তি বলে – 'আসাম রাইফেলস' এর দুই ব্যাটেলিয়ান সেনা রাতের অন্ধকারে অতর্কিতে গভর্নরের কথায় হামলা করেছে। পালাতে হবে। আমিও কিছু না বুঝে উঠে পড়ি তারপর তাকে অনুসরণ করে দৌড়তে থাকি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। মুহুরমুহ গুলির আওয়াজ শোনা যায়। বন্দুকের নল বিক্ষিপ্তভাবে ঝলসে ওঠে। সেই ঝল্কানিতে ভেসে ওঠে অজস্র ছায়া মুখ। হত্যালীলায় মাতাল বাতাসের অস্পষ্ট ফিসফিসানিতে শোনা যায় প্রমিলা, মনোরমা, কনকলতা, মুকুন্দ কাকতি, টেঙফাগরিদের নাম। তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলে নিচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে গেরিলা কায়দায় পাল্টে যাচ্ছে রণকৌশল। নিরন্তর চলতে থাকা ছায়াযুদ্ধ প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে দু পক্ষের। তীব্র বারুদের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। আমিও নেশাগ্রস্তের মত এই মৃত্যু উপত্যকায় কার্যকারণ সূত্র খুঁজতে ব্যস্ত। চটকা ভাঙল প্রমিলার বন্দুকের গর্জনে, লুটিয়ে পড়ল সুবেদার রামলাল পাসোয়ান। নামটা খুব চেনা। কিন্তু মনে পড়ছে না, একে কোথায় দেখেছি।
ধড়মড়িয়ে উঠে পড়েছি। ঘুম ভাঙতে দেখলাম সকাল হয়ে গেছে। ঝটপট তৈরী হয়ে বিনোদ কে বিদায় জানিয়ে বেড়িয়েই দেখলাম সেনাবাহিনীর গাড়ি আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি ওদের গাড়িতেই পৌঁছলাম সেনা ব্যারাকে। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারি, তিনজন সেনার ডেডবডি জঙ্গলে পাওয়া গেছে। সেনা জওয়ান রঞ্জিত সিং, রামলাল পাসোয়ান, ইস্তিয়াক নাসের। খেয়াল পড়ল এদের একজনকেই কাল রাতে স্বপ্নে মরতে দেখেছিলাম।
মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকা নাম গুলো গুগলে সার্চ করতেই পরাধীন আর স্বাধীন ভারত গুলিয়ে যায়। কোন দিগন্ত রেখা দেখা যায় না। 'আসাম রাইফেলস'এর কার্যপদ্ধতি যেমন, সেকাল থেকে একাল সর্বত্র এক! তেমনি সাধারণ মানুষের ভাঁড়ার, সবকালেই শূন্য !
আশ্চর্যের বিষয়, এই মৃত তিন সেনাই প্রমিলা হত্যাকান্ডে মূল অভিযুক্ত ছিল। কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা এতদিনে এদের সাজা দিল!
স্বাধীনতার চুয়াত্তর বছর পরেও এই ছায়াযুদ্ধের অবসান কোথায় আমরা জানি না!