মন
মন
আমি কৃষ্ণকলি দে সুদূর বীরভূম থেকে এই পরাভূম আটলান্টায় এসেছি পাক্কা দু'বছর হল। স্যাম পেস্কেট আমার কলেজতুতো কলিগ এবং আমার অনেকগুলো ভালোলাগার মধ্যে একটি।
আমার মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলার একমাত্র সঙ্গী সে।
বাংলা সাহিত্য পড়ানোর সুবাদে একদিন শান্তিনিকেতনে পড়ানোর ইচ্ছা প্রকাশ করল স্যাম। জানলাম ওর বাবা বাঙ্গালী ছিলেন, বিশ্বভারতীতে পড়াশুনা। ও গল্প শুনেছে। তাই স্বচক্ষে দেখার ইচ্ছা আছে। তাই যেতে চায়। একদম মনের কথা - যেমন বলা তেমন কাজ! দু'জনেই অ্যাপ্লাই করে দিলাম।
এদিকে জর্জ ফ্লয়েড, ডেরিক স্কট প্রমুখ কৃষ্ণাঙ্গদের ধারাবাহিক হত্যার প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্র উত্তাল! এমতাবস্থায় কলেজে স্যামকেও এড়িয়ে গেছি সন্তর্পনে।
শেতাঙ্গদের এই কৃষ্ণাঙ্গ বিদ্বেষী মনোভাবই আমায় সচেতনভাবে বিরত রেখেছে - ভালোলাগা থেকে ভালোবাসায় পৌঁছতে ! অবশ্য এখানকার সাধারন মানুষ সেরকম নন, মানে পৃথিবীর কোন দেশের জনগণই হত্যাপরায়ণ নন! আমি তাই বিশ্বাস করি। তবু…
যাইহোক আমি স্যামকে কখনও সাহিত্যের বাইরে বেড়িয়ে ধরাও দিইনি। ওর কাছ থেকেও কোন সাড়া পাইনি।
একদিন সকালে কলেজে যাওয়ার পথে একটা পার্কে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, বিক্ষোভ চলছে আর মাইকে স্পষ্ট বাংলায় কেউ কবিতা পাঠ করছেন শুনে কৌতুহলবশত এগিয়ে গেলাম। কে আবার এই বিদেশ ব
িভুইতে সাত সকালে নবারুন আওড়াচ্ছেন !
'যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবি কবি ও কেরানি / প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না/ আমি তাকে ঘৃণা করি।'
তারপর গিটার হাতে গাইলেন - 'How many roads must a man walk down/ Before you can call him a man? . . .'
তারপর আশ্চর্য ভাবে বাংলায় তর্যমাটি গাইলেন - কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়...
আমিও আর থাকতে না পেরে গানের সাথে গলা মিলিয়ে এগিয়ে গেলাম স্টেজের পাদদেশে। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে স্থানুবত দাঁড়িয়ে রইলাম।
কানের কাছে কনগ্রাচুলেশন শুনে চটকাটা ভাঙল। স্যাম রোদ ঝলমলে হাসিমুখ নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। আমিও ওকে কনগ্র্যাচুলেট করলাম। তবে বিশ্বভারতীতে পড়ানোর জন্য নয়, ওর এই পারফরমেন্সের জন্য ! আরও চমক বাকি ছিল।
এরপর একটা অমায়িক হাসি উপহার দিয়ে বলেছিল - ওর এই মুহূর্তে এই মুভমেন্টটা ছেড়ে ইন্ডিয়ায় আসা সম্ভব নয়। তবে আমায় আটকায়নি!
আমি দেশে ফিরেছি। শান্তিনিকেতনে থাকি। এখানে পড়াই। যোগাযোগ আছে। কথা হয়। এই তো সেদিন আমার প্রিয় গানটা গেয়ে রেকর্ড করে পাঠিয়েছে - "মন, হাওয়ায় পেয়েছি তোর নাম/ মন, হাওয়ায় হারিয়ে ফেললাম"।
আমিও গলা মেলাই – 'ঘুমের গোপনে তোমাকে আবার ডাকলাম/ হে হে হে...'
হয়তো মনের ডাকে সাড়া দেবে কোনদিন...