চাইলেই ফিরে আসা যায়
চাইলেই ফিরে আসা যায়
সন্ধ্যে নামার মুখে আবছা অন্ধকারে শহর যখন ঢাকা পরছে । বাস স্ট্যান্ডে ক্লান্ত মুখে ব্যস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষা করছে অফিস ফেরৎ রিমি । রাস্তার আলো জ্বলে উঠছে একে একে। প্রতিদিনের লোকজনের কোলাহল গাড়ির শব্দ সব কিছু একঘেয়ে হয়ে গেছে ওর কাছে।
এর মধ্যেই হঠাৎ করেই যেনো ওর সব সমস্ত সময় থমকে গেলো ।
সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ট্যাক্সির মধ্যে পেছনের সিটে একটা চেনা মুখ দেখে । প্রবীর !! ফুট পাথ থেকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ওই ট্যাক্সির দূরত্ব হাত তিনেক । কিন্তু ওদের মাঝে আজ প্রায় কয়েক শতাব্দীর দূরত্ব । আর কিছু সেকেন্ড পর সিগন্যাল গ্রীন হবে, রিমির বুকের ধুক পুকানি বেড়ে যেতে থাকলো । না প্রবীর এখনও ওকে দেখেনি । রিমি মনে মনে কি চাইছিলো সে নিজেও জানে না । কিন্তু এতো টুকু দূরত্ব পেরিয়ে একবার চেনা নামে ডাকার সাহস বা অধিকার বোধ কোনো টাই ওর ছিলো না । শুধু এক দৃষ্টে তাঁকিয়ে আছে প্রবীরের দিকে । সমস্ত চিন্তা ভাবনা যেনো থমকে গেছে ।
সিগন্যাল ছেরে দিয়েছে , ট্যাক্সিটা নড়েচড়ে উঠলো । মুহূর্তের মধ্যে প্রবীরও একবার বাঁ দিকে চাইলো।
না খেয়াল করে নি ।
একটা তাচ্ছিল্য বেদনার হাসি খেলে গেলো রিমির ঠোঁটের কোণে । মাথা নীচু করে ভাবলো ।
দেখলেই বা কি হতো ।
আনমনেই একবার প্রবীরের চলে যাওয়া পথের দিকে তাঁকালো সে । বুকের ভেতর টা ছ্যাৎ করে উঠলো । একটু দূরেই টার্নিংয়ে ট্যাক্সি টা দাঁড়িয়েছে, প্রবীর গাড়ি থেকে নেবে ভাড়া মিটিয়ে দিচ্ছে । একি ও তো এইদিকে আসছে। রিমির অস্বস্তি বেড়ে গেলো। সাথে একটা ভালো লাগতে ও মন টা ছেঁয়ে যাচ্ছে ।
তারমানে প্রবীর ওকে দেখেছে ।
কাছে এগিয়ে এসে এক মুখ হাসি নিয়ে প্রবীর বললো,
- ভাগ্যিস দেখলাম , না হলে তুমি তো ডাকতে না।
রিমি একটু হেঁসে বললো,
- কেমন আছো?
- ওই যেমন টা রেখে গিয়েছিলে।
- অনেক রোগা হয়ে গেছো।
- কাজের একটু চাপ বেড়েছে।
তারপর দুজনেই চুপচাপ , কথা বাড়ানোর জন্য প্রবীর বললো,
- কেমন আছো মিষ্টি।
প্রবীরের মুখে সেই আদরের নাম টা শুনে , গলা ব্যাথা করে কান্না বেড়িয়ে আসতে চাইলো রিমির । অনেক কষ্ট চোখের জল চাপতে গিয়েও যেনো চোখ টা ভিজে আসলো ।
অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বাস আসছে কিনা দেখার অছিলায় ফুটপাথ থেকে নেবে কায়দা করে চোখের জল টা মুছে রিমি বললো ।
- হ্যাঁ ভালোই আছি।
কিছুক্ষণ চুপ করে প্রবীর বললো,
- খুব তাড়া আছে কি তোমার?
- না তেমন একটা তাড়া নেই ।
- তবে চলো হেঁটে গড়িয়া হাট অবধি যাই ঐখান থেকেও তো তুমি বাস পাবে ।
সন্ধ্যে তখন পুরোপুরি নেমে গেছে । মহানগরীর রাস্তায় তখন ঝিলমিলে ল্যাম্প পোস্টের আলোতে মাখামাখি। ব্যাস্ত যান চলাচল । ফুটপাথ জুড়ে মানুষের ভিড়। এর মাঝেই হেঁটে চলেছে দুইজন খুব পরিচিত অচেনা মানুষ । হঠাৎ একটা চায়ের দোকান পেরোতে পেরোতে প্রবীর বললো,
- চা খাবে?
- মন্দ হয় না।
পাশাপাশি বেঞ্চিতে বসে আজ অনেক বছর পর একটা আলতো টান অনুভব করছে রিমি । হৃদস্পন্দন এখন সঠিক ভাবে চললেও একটা অস্তির ভালোলাগা ওকে যেনো চঞ্চল করে তুলেছে ।
রিমি কথা খুঁজে পাচ্ছে না । চায়ের কাপে প্রথম চুমুক দিয়ে প্রবীর বললো,
- সাত বছরে কতো কিছু বদলে গেছে তাই না?
- সময় তো পরিবর্তন শীল ।
- হ্যাঁ , তবে জানো মিষ্টি কিছু কিছু জিনিস কোনোদিন বদলে যায় না আমরা শত চেষ্টা করলেও সেটা বদলাতে পারি না ।
- যেমন
- এই তোমাকে দেখার পর আমার হৃদ্গতির বেড়ে যাওয়া আর আমি জানি ঠিক একই অনুভূতি তোমারও হয়েছিল ।
একটু থেমে প্রবীর আবার বললো,
- আমাদের মাঝে সব কিছু বদলে গেলেও এই অনুভূতিটা ঠিক একই রকম আছে ।
মাথা নিচু করে বসে , খালি চায়ের ভার টা হাতের মাঝে রেখে নখ দিয়ে একটা কোনো খুঁটছিল রিমি । লজ্জা , রাগ , অভিমান , ভালোবাসা সব কিছু তখন যেনো এসে ওর বুকের মাঝে জমা হয়েছে।
ওর হাত থেকে খালি চায়ের ভার টা ফেলে দিয়ে, প্রবীর ওর ঝুঁকে পরা মুখটা নিজের দু হাতে তুলে বললো,
- সব কিছু ভুলে কি আবার নতুন করে শুরু করা যায় না মিষ্টি । আমার কি আর একবার নিজেদের আরও একটা সুযোগ দিতে পারি না ?
রিমির চোখ জলে ছলছল করছে ।
চায়ের দাম মিটিয়ে প্রবীর এসে আবার বসলো বেঞ্চটাতে রিমির পাশে । কিছু বলতে যাবে , এর মধ্যে রিমির বাস এসে হাজির । কিছু বলার অবকাশ হলো না। মুহূর্তের মধ্যে সব ঘটে গেলো। রিমি উঠে গেলো বাসে। জানলার পাশের সিটে বসে প্রবীরের দিকে তাঁকিয়ে আছে সেই পুরানো পরিচিত দৃষ্টিতে । প্রবীর উঠে দাঁড়িয়ে কিছু টা এগিয়ে এসেছে । সন্ধ্যের শহরের ভিড়ের মাঝে দূরে, বহু দূরে হারিয়ে গেলো বাস টা ।
মনের মধ্যে একটা চাপা অন্ধকার নিয়ে আবার চায়ের দোকানের বেঞ্চটাতে ফিরে এসে বসলো প্রবীর । পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরিয়ে । দুটো টান দিয়ে , পাশ থেকে অফিসার ব্যাগ টা কাঁধে নিয়ে উঠতে যাবে হঠাৎ পুরনো রং চটা বেঞ্চের উপর একটা কালো মলাটের ডাইরি চোখে পরলো ওর ।
হঠাৎ করেই প্রবীরের মনে পরে গেলো আজ ৯ বছর আগের একটা বিকেলের কথা ঠিক এইভাবেই প্রথম একটা ডাইরি থেকেই শুরু হয়েছিলো রিমি সাথে পথ চলা।
বুক ভরা উত্তেজনা আর এক মুখ হাসি নিয়ে ডাইরি টা হাতে নিয়ে প্রথম পাতা খুলে দেখলো ।
একটা ফোন নাম্বার আর তার সাথেই লেখা ....
"চাইলেই ফিরে আসা যায়..."