Sucharita Das

Inspirational

3  

Sucharita Das

Inspirational

ব্যাকডেটেড

ব্যাকডেটেড

5 mins
62


 অনুপ্রেরণার বিষয়বস্তু : বাস্তব ঘটনা 


"ও দিদুন তুমি এসব বুঝবে না। তোমাদের তো সেই মান্ধাতার আমলের ধ্যান ধারণা, ব্যাক ডেটেড তোমরা। এখনকার দিনে এগুলো ন্যাচারাল। কেউ মাথা ঘামায় না এসব একলা বেড়াতে যাওয়া নিয়ে।" 



নাতনি এষানির কথায় মনোরমা দেবী ভাবলেন, সত্যিই হয়তো এসব আজকাল স্বাভাবিক। উনি হয়ত সত্যিই এখনও পুরানো চিন্তাধারাতেই আটকে আছেন। কই সমতা তো কিছু বলছে না ওর মেয়েকে। বরং কি জামাকাপড় নিয়ে মেয়ে যাবে , সেসব নিয়ে সে চিন্তিত।



সমতা মনোরমা দেবীর একমাত্র সন্তান। সমতার বাবা মারা যাবার পর সমতা মাকে আর একা রাখতে চায়নি। নিজের সঙ্গে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে চলে এসেছে। এখানে মেয়ে, জামাই , নাতনির সঙ্গে দিনগুলো কোথা দিয়ে কেটে যায় বুঝতেই পারেন না। কখনও একা মনে হয়না এখানে।

কিন্তু সব ঠিকঠাক থাকলেও একটা ব্যাপারে মাঝে মাঝেই মনোরমা দেবীর সঙ্গে তাঁর নাতনি আর মেয়ের মতের অমিল হয়। আর সেটা হলো নাতনির জীবনযাত্রার ধরন।



আসলে মনোরমা দেবী তাঁর একমাত্র মেয়ে সমতাকে যেভাবে মানুষ করেছেন, এ যেন তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কোথাও কোনো মিল খুঁজে পান না মনোরমা দেবী সে যুগের সঙ্গে এ যুগের। না চলাফেরায়, না পোশাক আশাকে, আর না ই দিনচর্যায়। ভোর রাত পর্যন্ত এষানি স্মার্টফোন না তো ল্যাপটপে ব্যস্ত। অনলাইনে নাকি কি সব কাজকর্ম করে সে। না কোনো খাবারের টাইম, না কোনো ঘুমানোর টাইম। কোনো কিছুরই যেন ঠিক নেই।সব অবিন্যস্ত, অগোছালো। অথচ মনোরমা দেবীর মনে আছে, সমতাকে তিনি কি সুন্দর নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে দিয়ে মানুষ করেছেন।



আজকে মনোরমা দেবীর চিন্তার কারণ অবশ্য অন্য। এষানি যাবে বন্ধুদের সঙ্গে ছদিনের জন্য পাহাড়ে। সমতা সব জানতো আগে থেকেই। মেয়ের গোছগাছ করছিল সে। সেই সময়ই মনোরমা দেবী জানতে চেয়েছিলেন মেয়েকে, কোথায় যাবার তোড়জোড় চলছে। সমতা মা'কে বলেছিল এষানিরা কয়েকজন ছেলে মেয়ে মিলে নাকি পাহাড়ে ঘুরতে যাচ্ছে।



ব্যস মনোরমা দেবীর পুরোনো যুগের চিন্তাধারা থেকে বললেন মেয়েকে,"তোকে কখনও এভাবে একা একা ছেড়েছি আমি কারুর সঙ্গে ? তুইও তো মডার্নই ছিলিস। কখনও সখনও কোথাও সামনে একটু গেছিস দু এক ঘন্টার জন্যে। তাই বলে ছ রাতের জন্য এভাবে মেয়েটা বাইরে যাবে। কোথাও কোনো বিপদ হলে, কে কাকে সামলাবে বল্। সবাই তো কম বয়সের।আজকালকার যা দিনকাল, চতুর্দিকে কত ভয়ানক ভয়ানক ঘটনা ঘটছে। এইভাবে অভিভাবক ছাড়া একদল ছেলেমেয়ে বাইরে বেড়াতে যাবে, কে জানে আমার পুরোনো চিন্তাধারায় যেন মন সায় দিচ্ছে না।"



মনোরমা দেবী যখন সমতাকে কথাগুলো বলছিল, এষানি তখন বাইরে থেকে কথাগুলো শুনে দিদুনকে বলেছিল, "আজকালকার আধুনিক যুগে এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না দিদুন।আর কি আবার বিপদ হবে। আমরা সবাই তো একসাথে থাকবো।ওসব নিয়ে টেনশন করো না তুমি। দিদুন তুমি আগেকার দিনের মানুষ বলে তোমার মনে এসব কথা আসছে।" মনোরমা দেবী মনে মনে ভাবলেন, সত্যিই কি তাই? তাই যদি হতো তাহলে সমতার মুখেতে একটা দুঃশ্চিন্তার ছাপ তিনি কেন দেখতে পেয়েছিলেন? সমতা তো আর তাঁর মতো পুরোনো আমলের না। আসলে মেয়েকে কিছু বলতে পারছে না সমতা ।এটাই আসল কারণ। মন থেকে হয়ত তারও এভাবে একা অভিভাবক ছাড়া যেতে দিতে মন করছে না। কিন্তু এষানি রাগারাগী করবে ,এই ভেবে কিছু বলতে পারছে না মুখের উপর।



মনোরমা দেবী ভাবেন, সত্যি কতো পার্থক্য এখনকার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আগেকার ছেলেমেয়েদের। সমতা তো তাঁকে জিজ্ঞেস না করে বাড়ির বাইরে এক পাও রাখতো না। অথচ এষানি যেন নিজের মর্জির মালিক নিজেই। যখন তখন বেরিয়ে পড়ে। মনোরমা দেবী ভাবেন, এত উচ্ছৃঙ্খলতা ভালো কি জীবনে? কে জানে হয়তো সত্যিই তিনি ব্যাকডেটেড।



এষানির যাওয়ার দিন এসে গেল। সারাক্ষণ ফোনে তার প্লানিং চলছে। কোথায় যাবে, কোথায় থাকা হবে, কোথায় কোথায় ঘুরবে এইসব। মনোরমা দেবীর মনে এক অজানা দুঃশ্চিন্তা। কে জানে অত দূরে মেয়েটা কি করবে একা একা। যতই মুখে বলুক বড়ো হয়ে গেছে, মনের দিক থেকে তো এখনও ছোটই মেয়েটা। এক এক সময় কি ছেলে মানুষী করে দিদুনকে জড়িয়ে ধরে। মেয়েটা কদিন থাকবে না, বুকটা যেন কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এর আচ্ছা সমতা কি মন থেকে মেনে নিতে পারছে এষানির বাইরে যাওয়াটা? কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এখনকার ছেলেমেয়েদের বাবা, মা কোনো ব্যাপারেই মুখের ওপর না করতে পারে না। তাদের জেদের কাছে কেমন যেন হার স্বীকার করতে বাধ্য হয় এখনকার বাবা মায়েরা। মনোরমা দেবী ভাবেন, সমতাকে তো তিনি কখনও অন্যায় প্রশ্রয় দেননি। সমতাও তো তাদের একমাত্র সন্তান ছিল।




যথা সময়ে এষানি মা,বাবা,দিদুনকে বলে বেড়িয়ে পড়লো। ওখানে পৌঁছে গিয়ে খবরও দিলো। এষানি পৌঁছে খবর দেওয়াতে অনেকটা মনটা ভালো লাগছে এখন। নইলে কি দুশ্চিন্তায় যে ছিলেন। সমতাও এখন অনেকটা হাসিখুশি। ভেতরে ভেতরে ও যে মেয়ের জন্য ভীষণভাবে চিন্তিত, সেটা ওর মুখ দেখেই আন্দাজ করতে পারছিলেন মনোরমা দেবী। মেয়েটা ছ দিন থাকবে, এক একটা দিন দুশ্চিন্তায় কাটবে সকলের। যতদিন না মেয়েটা ভালোভাবে ঘরে ফেরে। যদিও টিকিট ওদের আগে থেকেই কনফার্ম করা আছে, যাবার এবং ফেরবার। রোজই ফোনে কথাবার্তা হয়, তাই মনোরমা দেবীও একটু নিশ্চিন্তে আছেন। মনে মনে ভাবলেন,মেয়েটা ভালোয় ভালোয় ফিরে এলে নিশ্চিন্ত হবেন। আর তো দু দিন, তারপর ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে এলেই নিশ্চিন্ত।




সেদিন সকাল থেকে এষানির ফোন সুইচড অফ বলছে। সকাল থেকে বিকাল হয়ে গেল, মেয়েটার ফোন একইভাবে বন্ধ। বাকি বন্ধুদের ফোন করেও পাচ্ছেনা সমতা। টেনশনে একবার ঘর আর একবার বাইরে করছে । মনোরমা দেবীর বুকের ভেতরটা এক অজানা আশংকায় কেঁপে উঠলো। তবে কি মেয়েটার কোনো বিপদ হলো নাকি। যতই এষানি যাই বলুক,এইভাবে বাড়িতে খবর না দিয়ে থাকবার মতো মেয়ে তো সে না। এবার কি হবে? সমতাও ভীষণভাবে চিন্তিত। হঠাৎই রাতের দিকে এষানির নাম্বার থেকে কল আসে সমতার ফোনে। তড়িঘড়ি ফোন উঠিয়ে চিন্তায়, টেনশনে সমতা চেঁচিয়ে উঠলো,"সকাল থেকে কোথায় ছিলিস তুই? জানিস আমরা সারাদিন কত চিন্তা করছি।কত উল্টোপাল্টা চিন্তা মাথায় এসেছে আমার। তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরে আয় সোনা, আমার আর ভালো লাগছে না তোকে ছেড়ে থাকতে।" বলেই সমতার এতক্ষণের চেপে রাখা টেনশন, চিন্তা,কষ্ট সব কান্না হয়ে ঝরে পড়ে তার দু চোখ বেয়ে। মনোরমা দেবী মেয়ের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে কানে লাগান। শুনতে পান ওপাশ থেকে নাতনি এষানির কন্ঠস্বর, "কাঁদছ কেন মা, আমি ঠিক আছি, কিছু হয়নি আমার। আসলে, সকাল থেকে আজ সময় পাইনি মা। একজন বয়স্ক মহিলা ,দিদুনের মতো বয়সের, অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন হঠাৎই। আমাদেরই রিসোর্ট এ ওনারা পাশেই উঠেছিলেন। ওনার সঙ্গে ওনার হাজব্যান্ড ছাড়া আর কেউই ছিলেন না।আর উনিও বয়স্ক মানুষ, একা অসহায় হয়ে পড়েছিলেন এই দূরে। আমরা সবাই মিলে সারাদিন ওনাদের সঙ্গে থেকে, সবকিছু ব্যবস্থা করে ডাক্তারখানায় নিয়ে গিয়েছিলাম। ওষুধের ব্যবস্থা, টাকাপয়সার ব্যবস্থা সব করে দিয়েছিলাম। এখন উনি অনেকটাই সুস্থ আছেন, আগামী কাল আমাদের সঙ্গেই ওনাদেরও ফেরবার টিকিট কনফার্ম করা আছে। এইসব কারণেই ফোনে যোগাযোগ করতে পারিনি মা। তুমি আর কেঁদো না। এখন রাখো, আমাদের সকাল থেকে সেভাবে কিছু খাওয়া হয়নি, খিদে পেয়েছে তো। বাড়ি পৌঁছে তোমার বাকি কথা শুনবো।" এষানি জানতেও পারলো না যে ফোনের অপর প্রান্তে তার মা না, তার দিদুন এতক্ষণ তার সমস্ত কথা শুনছিলো। 




মনোরমা দেবী ফোনটা রেখে ভাবলেন, সত্যি আজকালকার এইটুকু ছেলেমেয়েদের কি দায়িত্ব জ্ঞান, কতো সুন্দর সব সমস্যার সমাধান করে এরা অনায়াসে। এইটুকু বয়সে এরা কত পরিণত। কতকিছু জানে এরা পারিপার্শ্বিক জগত সম্পর্কে। অথচ মনোরমা দেবীর মনে আছে, এই বয়সে তিনি শুধু সংসারের চার গন্ডীর মধ্যেই আবদ্ধ ছিলেন। বাইরের জগতের কোনো ধারণাই ছিল না তাঁর। আজকালকার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সত্যিই কোনো তুলনা চলে না তাঁদের আমলের। মনোরমা দেবী ভাবলেন, না যুগের সঙ্গে এগিয়ে চলতে হবে তাঁকেও, কাজের দিক থেকে না পারুক, অন্ততঃ মনের দিক থেকে। নাহলে সত্যিই তিনি ব্যাকডেটেড থেকে যাবেন।


       



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational