বৃত্ত
বৃত্ত


দর্শন গ্রুপসের সি.ই.ও এর প্রথম প্রেসমিট। শয়ে শয়ে জার্নালিস্ট নিজের জায়গা নিতে চলে এসেছেন কনভেনশন সেন্টারে। প্রমিলা সেন ওই জায়গাটাই আগে থাকতে পেয়ে গিয়েছিলেন। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নিজে ব্যবস্থা করেছেন এই বার্ষিক প্রেস কনফারেন্স ও কোম্পানির পরের একবছরের রুটম্যাপ বিষয়ে মিটিং এর জন্য।
প্রথম মুখ্যমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে কিছু এমপ্লয়িকে সম্বর্ধনা দেওয়া হলো। প্রেসমিট শুরু হতেই প্রথম প্রশ্ন যেটা এলো, "মিস সেন আপনার এই দর্শন গ্রুপস বানানোর কথা প্রথম মাথায় এলো কখন?"
উত্তর এলো, "দেখুন কোনো কিছুই এমনি এমনি মাথায় আসে না। খুব ছোটোবেলায় দৃষ্টি হারানোর পর থেকে জীবনটা দৃষ্টিহীনদের জন্য কতটা জটিল হতে পারে তার প্রমাণ পেয়েছি। আমার মামা ব্রেইল দিয়ে লিখে লিখে প্রথম সি ল্যাঙ্গুয়েজ শিখিয়েছিলেন বলে আমার মনে পড়ে। পরবর্তীকালে কম্পিউটার সম্পর্কে আরও ধারণা হতে শুধু ব্রেইল দিয়েই লেখা সম্ভব এমন একটা ল্যাঙ্গুয়েজ বানানো যায় কি, এমন ভাবনা মাথায় এলো। ব্যাস তারপরই শুরু।"
এবার প্রশ্ন এলো, " আপনি কি তবে প্রযুক্তি নিরিখেই অর্থাৎ একটি আই.টি. কোম্পানি নিয়েই ভেবেছিলেন ? তাহলে স্কুল আর কলেজ নিয়ে ভাবতে কবে শুরু করেন?"
"আমার স্কুল অর্থাৎ বেহালা ব্লাইন্ড স্কুল, সেখানে আমার পাশাপাশি আমার বন্ধুদের মধ্যে একটা তীব্র ক্ষিদে ছিলো কিন্তু কোথাও জন্য সব্বার ইচ্ছা দমে যেত। পরীক্ষায় স্ক্রাইবের হেল্প নেওয়া ছাড়া গতি ছিলো না। আমি শুনতাম সব বড় বড় স্কুলে অনেক কম্পিউটার সংলগ্ন বিষয় শেখানো হয়। সেগুলো পড়া শুনে বা ব্রেইল দিয়ে লেখা বই থেকে বোঝা গেলেও যতক্ষণ না প্র্যাকটিকাল করছে তার প্রয়োগ বাস্তবায়িত হবে না। তাই আই.টি. কোম্পানি দর্শন টেক হিসেবে শুরু করলেও এখন দর্শন গ্রুপ প্রায় ১০০০ টা স্কুল ও ৬০০ টা কলেজ নিজের আওতায় পর্যবেক্ষণ করছে। পরে ক্রমবর্ধমান হবে এর সংখ্যা।"
সবশেষ যে প্রশ্ন এলো তার জন্য প্রমিলা প্রস্তুত ছিলেন না।" জীবনে একটা প্রতিবন্ধকতা থাকলে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা দেখে থাকি যে মানুষ ইচ্ছাশক্তিকে দমিয়ে ফেলে। যে কটি ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে মানুষের জয় দেখেছি সেই সবকটি ক্ষেত্রেই কোনো ঘটনা বা মানুষ প্রেরণা হয়েছে , আপনার ক্ষেত্রে বিষয়টা কি ছিল ? "
প্রমিলা "আই উইল অ্যানসার দিস ইন মাই অটোবায়োগ্রাফি, ইন নিয়ার ফিউচার। থ্যাঙ্কস। "
এরপর গত ফাইনান্সিয়াল ইয়ারে দর্শন গ্রুপে যাঁরা দারুণ কাজ করেছেন তাঁরা সম্মানিত হলেন। মুখ্যমন্ত্রী কিছু বক্তব্য রাখলেন। নিজে বললেন দর্শন গ্রুপের প্রধান কার্যালয় হিসাবে রাজারহাটে একটি জমি দেওয়া হবে, গ্রুপকে ন্যাশনালাইজ ও গ্লোবালাইজ করতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করবেন।
মিটিং শেষে মিস সেন বাড়ি ফিরছেন নিজের গাড়িতে।
আজ বারে বারে ১০ বছর আগের ঘটনাটার কথা মনে পড়ছে। ওই শেষ প্রশ্নটা আসার পর থেকে সেটা আরও জাঁকিয়ে বসেছে।
বিজনেস টাইকুন রঞ্জন কুমার সেন তখন নিজের উন্নতির চূড়ায়। রঞ্জন বাবু একদিন নিজের ডেস্কে একটি চিঠি পেলেন যাতে তাঁর পি.এ. এর প্রেম জ্ঞাপন ছিলো। তিনি নিজে বহুদিন আগেই সুলগ্নার প্রেমে পড়লেও নিজের কাজ নিয়ে এতই ব্যস্ত যে বলেই উঠতে পারেননি। তাই এই চিঠি ছিলো মেঘ না চাইতেই জলের মতো। লাঞ্চেই জানিয়ে দিলেন সুলগ্নাকে তাঁর মতামত।
সুখেই চলছিলো সেন দম্পতির জীবন। দুবছর পর কোল আলো করে প্রমিলার জন্ম হলো। জন্ম থেকেই প্রমিলা দৃষ্টিহীন। তাও হাসিমুখেই সামলে নিয়েছিলেন উভয়েই। প্রমিলা ধীরে ধীরে বড়ো হলো।
সুলগ্নার দাদা অনন্ত খুব ভালোবাসতেন প্রমিলাকে। কত কত বিষয়ে ছোট্ট থেকেই প্রমিলাকে অবগত করিয়েছিলেন তার ইয়ত্তা নেই। প্রমিলার কম্পিউটার বিষয়ে আগ্রহ মূলত তাঁর কারণেই।
প্রমিলা স্কুল পাশ করে ভালো নম্বর সত্ত্বেও প্রতিবন্ধকতার জন্য কোন বিষয় নেবে বুঝে উঠতে পারছিলো না ।
স্থির করেছিলো মিউজিক নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করবে। মিউজিক নিয়ে পড়লেও বাড়িতে সর্বদা কম্পিউটার ল্যাঙ্গুয়েজগুলো একে একে ব্রেইলে পড়েই শিখতে লাগলো। তখনও নিজে নতুন কিছু বানাবে প্ল্যান ছিলো না। কলেজ শেষ করে চাকরির জন্য কয়েকটা মিউজিক সেন্টারে অ্যাপ্লাই করলো।
একজায়গায় ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাক পেলো। সব প্রশ্ন ঠিকঠাক করে উত্তর দিচ্ছে। সবশেষ তাকে বলা হলো, যে ব্লাইন্ড লোকেদের ইন্টারভিউ নিলেও তাদের কাজে রাখতে তারা পারবে না। এর কারণ হিসাবে তাকে একটা রুমের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে নানা বাদ্যযন্ত্র ও গানের শব্দ ভেসে আসছে।
একজন বললেন, "এই মিউজিক স্কুলে মেকানিক্যাল ছাড়াও টেকনিক্যাল মিউজিক বা কম্পিউটারাইজড মিউজিক করা হয়। বরং পরেরটাই বেশী। নেহাৎ মিস্টার সেনের অনেক সাহায্য পেয়েছে এই স্কুল তাই আপনাকে ইন্টারভিউয়ে ডাকা... নইলে ...।"
বাড়ি ফিরে অঝরে কেঁদেছিলো সেদিন প্রমিলা। রঞ্জনবাবুও খুবই ব্যাথা পেয়েছিলেন ।
অনন্ত না থাকলে সেদিন প্রমিলা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতো না। অনন্ত এসে বললেন, "তুই মিছে কাঁদছিস। ওরা চালাকি করে তোকে দেয়নি। বহু বহু মিউজিক স্কুলে ভিসুয়ালি ইম্পেয়ার্ড লোকেরা শিক্ষক হিসাবে আছেন। তবে আজকাল এতো অটোমেটিক মিউজিক বেড়ে গেছে তার জন্য এদেশ থেকে খুব শীঘ্রই ওনাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। যাহোক, তুই অন্য পথ ভাব। আমি বলবো না কিছুই।"
মামার থেকে কথাগুলো শুনে তার মনের মরে যাওয়া ক্ষিদেটা ফের চাগাড় দিয়ে উঠলো। তার আসল পথ টেকনোলজি , মিউজিক নয়। ব্রেইল দিয়ে জাভার সব কোড সে লিখতে শুরু করলো, ব্রেইল বোঝে এমন এক সফটওয়ারে। ক্রমে সে ৫ বছরের চেষ্টায় বি++ বানালো যাতে জাভা তো বটেই এস.কিউ.এলের কাজও ব্রেইল দিয়ে করা যায়। এগুলো লেখার জন্য সে ব্রেইল কিবোর্ড ব্যবহার করেছিল, আই.টি মার্কেটে ছাড়তেই তা লুফে নিলো সকলে। সেই পেটেন্ট নিয়ে ক্রমে স্টার্ট আপ হিসাবে শুরু করলো দর্শন টেক ও তার পরে তার বিবর্ধিত রূপ দর্শন গ্রুপ। অন্ধদের জন্য বানালো স্কুল ও কলেজ।
আজ প্রথম প্রেসমিট হয়ে বাড়ি ফিরতেই রঞ্জনবাবু দরজার মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন । মেয়ের পুরো মিটিং টিভিতে সম্প্রচার দেখেছেন তিনি। আনন্দে চোখ দিয়ে জল পড়ছে বাবা ও মায়ের। মেয়েকে দুজন মিলে বুকে টেনে নিলেন।
"আমি রিটায়ারের পর খুবই চিন্তায় ছিলাম তোদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। বলে না ভগবান একদিকে মারলে অন্যদিকে ভরিয়ে দেন, আজ তার প্রমাণ পেলাম । আমি আজ বুক ফুলিয়ে বলতে পারবো আমি দর্শন গ্রুপের সি.ই.ওর বাবা। "
এর ঠিক কিছুদিন পর নিজের ডেস্কে বসে প্রমিলা সেন একটা ফোন পেলেন । রিসেপশনিস্ট জানালো, "মলয় বিশ্বাস বলে একজন ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন।"
ইন্টারভিউ চলাকালীন প্রমিলা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন আরও দুজন কর্ণধার। পরিচয় দেওয়ার সময় জানা গেলো মলয় হলো শহরের প্রখ্যাত মিউজিক স্কুলের শিক্ষক দেবদত্ত বিশ্বাসের ছেলে। একটা নাইট আউটে তার গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে যাতে তার চোখের জ্যোতি চলে যায়। এক লহমায় দশ বছর আগের মিউজিক স্কুলের সেই ঘটনার কথা মনে পড়ে গেলো।
ইন্টারভিউ শেষে যখন সব ঘটনার কথা মনে করছেন প্রমিলা তখন হঠাৎ দেবদত্ত বাবুর ফোন এলো।
"দশবছর আগের ঘটনার কারণে আপনি আমার ছেলের চাকরি মঞ্জুর নাও করতে পারেন। আমি সব জেনেই পাঠিয়েছিলাম ওকে কারণ অতীত আর বর্তমানকে একবার একজায়গায় ফেলতে চেয়েছিলাম। ফাণ্ডের অভাবে পাঁচবছর আগে আমার স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। অতএব ..." কাঁদতে কাঁদতে তিনি ফোন রেখে দেন।
প্রায় একমিনিট ধরে প্রমিলা হাসতে লাগলেন ফোন শেষে। সত্যি জীবন একটা বৃত্তের মতো, সব ঘুরে ফিরে ফিরে আসে।