বৃষ্টি মাখা তুমি
বৃষ্টি মাখা তুমি
কব্জি উল্টে হাতঘড়িটা দেখলো রিপন, সাড়ে'সাতটা। পায়েল আটটায় আসতে বলেছিল। রিপন নির্দিষ্ট সময়ের আধঘন্টা আগেই চলে এসেছে। বুকের ভিতর দ্রিমিদ্রিমি, স্কুলে ভয়ে পায়েলকে প্রপোজ করতে পারেনি। শুনেছিল, তখন নাইনে পড়া মেয়েটি ভীষণ সিরিয়াস, স্টুডিয়াস। প্রপোজ করলে যদি হেইচ এমকে কমপ্লেইন করে!
কমবয়সী-ইনফ্যাচুয়েশন মনের ঘরে তালা ঝুলিয়ে বন্ধ করে রেখেছিল এতদিন। কিন্তু এবার যে বলে দিতে হয়। রিপন বুঝেছে, এটা মোহ নয়, ভালোবাসা, নাহয় এতগুলো বছরে অন্য কাউকে তার মনে ধরবে না?
এবার রিপনকে বলতেই হবে। কিন্তু পায়েল যদি তাকে 'না' করে দেয়?
রিপন আলসে একটা হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে রাস্তার দিকে তাকালো। কাল সারারাত পায়েলের কথা ভাবতে ভাবতে নির্ঘুম কেটেছে। কি করে যে রাত শেষ হয়ে গেল! বাইরে বৃষ্টির অঝোর শব্দ সেই সঙ্গে রিপনের কল্পনায় পায়েলের অদৃশ্য ছোঁয়া; ভাবতেই রিপনের শরীরে একটা শিহরণ খেলে গেল।
সেই পায়েল; রিপন তখন টুয়েলভ পড়ে। সরস্বতী পুজোর অনুষ্ঠানে হঠাৎ করেই পায়েল যেন হলুদ মুনিয়া সেজে রিপনের চোখে ধরা দিল।
সেদিনই গোলাপ হাতে এগিয়ে গিয়েছিল রিপন, পিছন থেকে সৌম্য টেনে ধরে,"ওরে ফোর ফোরটি ভোল্টেজ মার্কা স্টুডিয়াস, প্রপোজ করলে এক্সেপ্টেনস না পেলেও স্কুল থেকে রাস্টিকেশন ইজ মাস্ট! ভেবে দেখ!"
রিপন আর সাহস পায়নি।
তারপর তো রিপনের কলেজ, পায়েলও মাধ্যমিক দিয়ে অন্য স্কুল, নিজেদের ক্যারিয়ার গোছাতে দুজনেই কেমন যেন আলাদা হয়ে গেল।
হঠাৎ সেদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় আবার দুজনের নতুন করে আলাপ, ফোন নম্বর বিনিময়, কথা...
অবশেষে আজ তাদের ডেট।
আজ পায়েলের ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন টেস্টের লিস্ট আউট। সেখানে পৌঁছনোর আগেই দেখা করবে দুজন; এরকমই কথা হয়ে আছে।
কতদিন পর দেখা হবে!
স্কুল জীবনের সেই প্রথম ভালোলাগা!
রিপনের মনে উত্তেজনা, পায়েল অনেকটা বদলে গেছে নিশ্চয়ই, ফোনে কথা বলে আর কতটুকু বোঝা যায়!
ক্লান্তিতে রিপনের চোখদুটো ভারী ঠেকছে।
তবু যেন আজ সবটুকু ভালো লাগছে রিপনের। সকাল সত্যিই এত সুন্দর হয়! কাল সারারাতের বৃষ্টি মেখে গাছের পাতাগুলো সতেজ হয়ে আছে। ভারী একটা পরিষ্কার ভাব। পিচগলা রাস্তা যেন সদ্য স্নান সেরে ভেজা কাপড়ে স্নিগ্ধ যুবতী, আকাশে নরম নীলচে-সাদা মেঘের খেলা, যেন নব-মেঘদূত! বৃষ্টি আসার খবর নিয়ে আসছে। বৃষ্টির নাকি পায়েলের! চারিদিকে মাতাল করা ভিজে 'ফুলেল-সোঁদা-গন্ধ'!
কোনোদিন রিপন এমন সকাল দেখেনি। এই প্রথম, পায়েলের জন্য।
ঐতো পায়েল আসছে। স্টেপ করে কাটা চুল, ডেনিম জিন্স, কচিকলাপাতা রঙের নকশি কুর্তি, পিঠে ব্যাগ। পায়েল আর প্রকৃতি যেন এই বর্ষায় সবুজে সবুজ হয়ে উঠেছে। রিপনের চোখে ঘোর।
এগিয়ে আসছে পায়েল। হাঁটুর ওপর জিন্স গোটানো, পায়ে কাদা।
মিষ্টি হাসি, চপল চোখ।
পায়েল সামনে এসে স্বপ্ন ভাঙাল,"অনেকক্ষণ?"
খুব বলতে ইচ্ছে করছে,"তোমার জন্য সারাজীবন...!"
রিপন মুখে বললো,"পায়ে কাদা যে! ধোবে তো?"
সামনে একটা টিউবওয়েল। পায়েল কল খুলে পা এগিয়ে দিল। জলে ধুয়ে যাচ্ছ কাদা, প্রকট হচ্ছে পায়েলের ধবধবে পা।
ঝিরঝির বৃষ্টি হঠাৎ শুরু হলো। কী হবে? কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
সামনে একটা কদম গাছে। রিপন পায়েলের হাত ধরে ছুটলো। গাছের তলায় কদমের পাপড়ি বিছানো, টুপটুপ অজস্র পাপড়ি ঝরে পড়ছে তখনও, পায়েল আবিষ্ট হয়ে চোখ বুজে মেখে নিচ্ছে মুহূর্তটা। একমুঠো কদম দুই হাতের মধ্যে নিয়ে রিপন হাঁটু মুড়ে বসে, "একশো বর্ষা একসঙ্গে কাটাতে চাই পায়েল, তুমি হাত ধরবে তো?"
রিপনের বাইকে হেলান দিয়ে বললো,"চলো ভিজি। বৃষ্টি মাখি!"
রাজপথ দিয়ে আলগা গতিতে হাঁটছে রিপনের যান, পায়েল রিপনের কোমর জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখেছে, চারিদিক থেকে বৃষ্টির পশলা যেন কদমের পাপড়ির মতোই নিক্ষেপিত হচ্ছে তাদের ওপর। এ এক স্বর্গীয় অনুভূতি। এই মুহূর্ত থমকে থাকুক অনন্তকাল!

