Bhaswati Ghosh

Inspirational

3  

Bhaswati Ghosh

Inspirational

বোধোদয়

বোধোদয়

4 mins
9.2K


সুন্দরী একবার উঁকি মেরে দেখে এল বড়মার ঘরে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রান্না ঘরে দৌড়ালো।''বউমণি, দাও গো তাড়াতাড়ি এইবেলা কুটনো কুটে দিই।''

"দাঁড়া সুন্দরী!"-প্রমীলা আর সুন্দরী দুজনেই ভয়ে কাঠ হয়ে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে পড়ে বজ্রগম্ভীর হাঁক শুনে।

সুন্দরী হচ্ছে মুখ্যার্জী বাড়ির ঠিকে ঝি।তার প্রবেশের অধিকার শুধু বাইরের ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।রান্না ঘরে নৈব নৈব চ, অন্ততঃ বড়মা যত দিন আছেন।বড়মাই হলেন মুখার্জী বাড়ির শেষ কথা।এই নিয়ম বড়মার শ্বশুর -শাশুড়ি বেঁচে থাকার সময়েই ছিল।মুখার্জী বাড়িতে তিন ছেলে।বড়মার স্বামী হলেন বড়ো, তার নিচে দুই ভাই।বড়মা নিঃসন্তান।মেজ ভাইয়ের এবং ছোট ভাইয়ের এক জন করে ছেলে।মেজ ভাইয়ের ছেলে প্রকাশ, তার-ই স্ত্রী প্রমীলা।প্রমীলার সাথে প্রকাশের বিয়েটাও এক গল্প।প্রমীলা হল প্রকাশের সহপাঠী।সেখান থেকে প্রেম।কিন্তু একটাই বাধা প্রমীলারা অবাঙালি ব্রাহ্মন।তাই প্রকাশের সাহসে কুলায় না বড়মার সামনে প্রমীলার বিষয়ে বলতে।শেষ পযন্ত প্রমীলাই বাধ্য হয়ে একদিন ফোন করে প্রকাশের বাড়িতে।ফোন আসার পর বড়মার এজলাসে ডাক পরে প্রকাশের এবং সেখানে পুরো বাড়িকে সাক্ষী রেখে ঝাড়া আধখন্টা বিচারের পর প্রমীলাকে বউ করবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷ কিন্তু তার সাথে ঠাকুর ঘরে না ঢোকা, চাকরি করলেও যেন প্যান্ট-শার্ট না পরা হয়, ইত্যাদি ইত্যাদি শর্ত আরোপের বোঝা চাপে প্রমীলার মাথায়।যাই হোক, শর্তে রাজী হয়ে প্রমীলা বধূরূপে মুখার্জী বাড়িতে প্রবেশ করে।কিন্তু প্রমীলা এসে থেকে অনেক কাজ-ই মন থেকে মেনে নিতে পারে না।তার মধ্যে অন্যতম হল অকারনে বড়মার মানুষকে ছুঁইছুঁই করার বাতিকটা।সরাসরি প্রতিবাদ করতে না পারলেও অনেক সময়েই বড়মার কথা অনুয়ায়ী কাজ প্রমীলা করে না।যেমন,আজই কাজের মেয়ে সুন্দরীকে রান্না ঘরে ঢোকানো।প্রমীলার দরকার হলেই বড়মার অজান্তে সুন্দরীর সাহায্য নেয় ।পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন সুন্দরীকে কি কারণে বড়মা অচ্ছুত্‍ ভাবে তা প্রমীলা শাশুড়ীমাকে প্রশ্ন করে জানতে পারে, সুন্দরী হল ডোমের মেয়ে। ছোট জাত হিসাবে তার অন্দরমহলে ঢোকা বারণ।বড়মার গর্জন শোনার পর সুন্দরী মাথা হেঁট করে জলভরা চোখে বেরিয়ে যায়।প্রমীলার নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়।ওর জন্য না বেচারির চাকরিটা যায়।প্রমীলা বড়মার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,-"যা কিছু আমার দোষ, আমিই ওকে.."

ওর কথা শেষ করতে না দিয়েই বড়মা একটা হাত তুলে থামিয়ে, রোষ ভরা দৃষ্টিতে একবার প্রমীলার দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে যায়।চাকরি সুন্দরীর যায়নি।কিন্তু সেইদিন বড়মা আর অন্নজল গ্রহন করেনি, পরের দিন রান্না ঘরের প্রতিটা জিনিস গঙ্গাজলে না ধোওয়া পর্যন্ত।

এই ঘটনার দিন দশেক পরে প্রমীলা অফিস যাবার জন্যে সবে তৈরী হচ্ছে এক সহকর্মীর ফোন।প্রমীলারা অফিস গ্রুপ মিলে একটা এন.জি.ও চালায়, যদিও শ্বশুর বাড়ির অজান্তে।প্রমীলার সহকর্মীটি জানায়, সম্প্রতি ওদের নিকটবর্তী জেলায় যে অঞ্চলে বন্যা হয়েছে সেখানে ওরা এন.জি.ও থেকে দশজন বাড়ি বাড়ি যাবে খাবার,মেডিসিন,পোষাক নিয়ে। ও কি যেতে চায়?প্রমীলা রাজি হয়ে যায়।প্রমীলারা ঐ বানভাসি এলাকায় পৌঁছায় সকাল দশটা নাগাদ।সমস্ত অঞ্চলটা জলের তলায়।ঐ সামান্য সামগ্রী কাকে কিভাবে দেবে নিজেরাই ভেবে অথৈ জলে পড়ে।চারিদিকে শুধু সব হারানো মানুষের হাহাকার আর অসহায় দৃষ্টি।তবু যতটা পারে ওরা সাধ্যমত নিজেদের কাজে লেগে পড়ে।সমস্ত কাজ মেটাতে দুপুর গড়িয়ে যায়।এই সময়েই প্রমীলার নজরে পড়ে ভেসে আসা কুঁড়েটা।প্রমীলা যখন বাড়িতে ঢোকে কাঁটায় কাঁটায় আটটা।ইতিমধ্যে তার মোবাইলে খানকুড়ি ফোন এসে গেছে বাড়ি থেকে।বাচ্ছাটাকে কোলে নিয়ে প্রমীলা ধীরে ধীরে বড়মার ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।বুঝতে পারে সকলে বড়মার ঘরেতেই।প্রমীলা ঢুকতেই সকলের চোখ আটকে যায় প্রমীলার কোলেতে।প্রকাশ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে।খানিকক্ষণ হতভম্ভ থাকার পর ঘোর ভেঙে চিত্‍কার করে, -"কে ও?" 

প্রমীলা একটা শ্বাস টেনে একটু থেমে আজকের সারাদিনের সব কথা এবং সেখানেই এই বাচ্ছাটাকে একটা ভেসে আসা কুঁড়ে ঘরের মধ্যে পায় জানায়। মা বাবার কারো খোঁজ নেই।দেখেই বোঝা যাচ্ছে বাচ্ছাটা দুতিন মাসের।এখন প্রমিলার কোলে শান্তভাবে ঘুমাচ্ছে।সব শোনার পর সকলেই ভাষা হারিয়ে ফেলে।প্রকাশ মাথায় হাত দিয়ে আবার বিছানায় বসে পড়ে।বড়মা এতক্ষণ একটাও কথা বলেনি।চুপচাপ সব শুনছিলেন একদৃষ্টে তাকিয়ে।এবার বলে উঠলেন,-"তোমার সাহস হয় কি করে একটা বেজাতের কি কুজাতের ছেলেকে নিয়ে মুখার্জী বাড়ির অন্দর মহলে প্রবেশ করতে!"

প্রমীলা কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে বড়মার দিকে।তারপর বলে,-"এই বাচ্ছাটাকে দেখে বলুনতো এর জাত কি?কি পারবেন বলতে আপনারা কেউ?বলু্‌ন, বড়মা চুপ কেন? বলুন এর জাত কি?"সমস্ত ঘর নিস্তব্ধ।কিছুক্ষণ থেমে আবার প্রমীলা বলে,-"জাত কোথা থেকে আসে? এই সমাজ থেকে,জন্ম থেকে নয়।একটা বাচ্ছার গায়ে লেখা থাকে না কি জাত!একটা তিনমাসের বাচ্ছাকে যদি ঐ জলের মধ্যে মৃত্যুর মুখে ফেলে আসতে হয় শুধুমাত্র জাতের ভয়ে, তাহলে সেই জাতকে আমি বিশ্বাস করিনা।ঈশ্বরের সৃষ্টিই তো মানুষ।মানুষকে যদি ঈশ্বরের পবিত্রতা রক্ষার কারণে ঘৃণা করতে হয়, ছোট্ট শিশুর মৃত্যুর জন্যে দায়ী থাকতে হয়, তাহলে আমার কোন দরকার নেই সেই ইশ্বরের পূজা করে।আমি জানতাম একে নিয়ে মুখার্জী বাড়িতে ঠাঁই হবে না।তবু এসেছি কারণ, না এলে আমাকে আপনারাই কলঙ্কিত করতেন।যাই হোক, আমি চললাম। প্রকাশ তোমার বোধায় ক্ষমতা হবে না এই সুখ স্বাচ্ছন্দ্য অগ্রাহ্য করে আমার হাত ধরার।"

প্রমীলা শিশুটিকে ভালো করে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।ধীর পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেটের দিকে যায়।সুন্দরী এসে দাঁড়ায়।বলে,-"বউদিমণি এত রাতে তুমি কোথায় যাবে?আজ রাতটুকু আমার বাড়িতে চল।কাল চলে যেও।"প্রমিলা বলে, "নারে এতে তোর চাকরী যাবে।"সুন্দরী অল্প হেসে বলে,-"তুমি চল, ও নিয়ে তোমায় ভাবতি হবেনি।"দুজনে গেট ঠেলে বেরোতে যাবে হঠাত্‍ বড়মার গলা-"সুন্দরী কিছুটা দুধ গরম করে আমার জামবাটিটা করে নিয়ে আয়।আর প্রমীলা আমার ঘরে এসে বাচ্ছাটাকে আমাকে দাও, তুমি গিয়ে পোষাক বদলাও। বাইরের অপরিস্কার জামাকাপড় পরে থাকা আমি পছন্দ করি না।প্রমীলা আর সুন্দরী অবাক চোখে তাকায় ।বাচ্ছাটা হঠাত্‍ ঘুমের মধ্যে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে৷

#positiveindia


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational