STORYMIRROR

Sonajhoori Maitra

Tragedy Crime Thriller

3  

Sonajhoori Maitra

Tragedy Crime Thriller

বন্দির দ্বন্দ্ব

বন্দির দ্বন্দ্ব

7 mins
19

শেষ বিকেলের পড়ন্ত রোদ, হাওয়ায় আলতো বৃষ্টি-ছোঁয়া | আল ধরে হেঁটে আসছে এক তরুণী | বয়স বছর কুড়ি হবে....বড়োজোর চব্বিশ-পঁচিশ | পরনে সাদা থান-কাপড় | খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করলে সিঁথিতে এখনো লাল আভা দেখা যায় অর্থাৎ খুব বেশিদিন হয়নি মেয়েটি বিধবা হয়েছে | সিঁথির সিঁদুর এখনো পুরোপুরি ফিকে হয়ে যায়নি | আরেকটু পরেই সন্ধ্যে নামবে , একটা দুটো করে জোনাকি দেখা যাচ্ছে , দূর থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝিঁপোকার ডাকের সাথে মেশা হালকা সোঁদা মাটির গন্ধ | মেয়েটি একা এগিয়ে চলেছে গ্রামের একমাত্র জেলখানার দিকে | একলা বিধবা মেয়ে তাও আবার জেলখানার রাস্তায়......দৃশ্যটি নিতান্ত সাধারণ নয় বৈকি |


মেয়েটি: অম্বিকেশবাবুর সাথে দেখা করতে এসেছি | দেখা করা যাবে কি ?


মৃদু নারীকণ্ঠে চমকে তাকালো নইটগার্ড | অল্পবয়সী বিধবা নারীমূর্তি দেখে বিস্ফারিত চোখে তাকালো সে | এমন দৃশ্য কদাচিৎ দেখা যায় কিনা |


নাইটগার্ড : এখন তো ভিজিটিং আওয়ার্স নয় , কি করে দেখা করতে দেই? আর এইসময় আপনি একা মহিলা?....এখানে?


মেয়েটি (মৃদু হেসে ): আমার সাজপোশাক দেখে নিশ্চই বুঝতে পারছেন গোটা জীবনটাই একা কাটাতে চলেছি | তাই একা এখানে আসাটা তেমন কিছু নয় | আচ্ছা একদমই কি দেখা করা যাবে না ? একটু জরুরি দরকার ছিল |


মেয়েটির কণ্ঠে একটা অদ্ভুত অসহায়তা আছে | একটু বোধ হয় মন ভিজলো নাইটগার্ড এর |


নাইটগার্ড : অম্বিকেশ.....অম্বিকেশ মুখার্জী ? মার্ডার কেস ?


মেয়েটি : আজ্ঞে হ্যাঁ |


নাইটগার্ড : কৌতূহল মার্জনা করবেন , ওনার সাথে আপনার বিশেষ কোনো দরকার ? আপনি আত্মীয়া হন ?


মেয়েটি : নাঃ আত্মীয়তার সম্পর্ক ঠিক নয় ওনার সাথে | আমি স্বর্গীয় বিহারিরঞ্জন বন্দোপাধ্যায়ের স্ত্রী , যাকে অম্বিকেশ বাবু খুন করেছেন |


এত সহজ ভাবে মেয়েটির মুখ থেকে নিজের স্বামীর খুনির পরিচয় শুনে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেলো নাইটগার্ডের সারা শরীর বেয়ে | 


নাইটগার্ড : কাল অম্বিকেশবাবুর ফাঁসির হুকুম আছে জানেন তো ?


মেয়েটি : হ্যাঁ জানি |


নাইটগার্ড : কাল আপনার স্বামী ন্যায়বিচার পাবে | তবে আপনার আজ এখানে আসার কারণ ?


মেয়েটি : ক্ষমা করে দিতে এসেছি |


আলোআঁধারিতে মেয়েটির শ্বেতশুভ্র অবয়ব , মৃদু - মিষ্টি গলা কেমন যেন গা ছমছমে ঠেকলো নাইটগার্ডের |


(তালা খোলার শব্দ )

নাইটগার্ড : আসুন এখানে আছেন উনি | বেশি সময় নেবেন না | আধঘন্টার মধ্যে কথা বলে বেরিয়ে আসুন এখন ভিজিটর আসার নিয়ম নেই |


তালা খুলে একটি সেল এর সামনে এসে দাঁড়ায় নাইটগার্ড | সেলের মধ্যে বসে শীর্ণকায় এক যুবক....বছর তিরিশেক মতো হবে | চোখে মুখে অজান্তে বেড়ে ওঠা অসমান দাঁড়ি, চোখ দুটো প্রায় কোটরে ঢুকে গেছে , গায়ের পোশাক তথৈবচ | তালা খোলার শব্দে সে সচকিতে তাকায় আওয়াজের উৎসর দিকে | দেখেই হাড় হীম হয়ে আসে তার | স্বেতবসনা নারীটির দিকে চেয়ে বলে , "মৃণালিনী , তুমি ?" 


মেয়েটি : গার্ডবাবু এবার আমরা একটু কথা বলি কেমন ?

(মাথা নেড়ে গার্ড এর প্রস্থান)


অম্বিকেশ: বিহারি কে আমি খুন করিনি মৃণালিনী | তোমরা আমায় ভুল বুঝলে , সবাই আমায় ভুল বুঝলে | কাল পৃথিবী থেকে চলে যাবো একরাশ ভুল বোঝার বোঝা নিয়ে .....আমায় একটিবার বিশ্বাস করো ... আমি করিনি এ কাজ |


মৃণালিনী : আপনি যে করেননি , তার কি কোনো প্রমান আছে অম্বিকেশবাবু? তর্কের খাতিরে ধরেই নিলাম অন্য কেউ করেছে...তাহলে তো বলতে হবে সে প্রমান লোপাট করায় সিদ্ধহস্ত |


অম্বিকেশ: জানি বিশ্বাস করবে না , জানি আমি | হ্যাঁ প্রমান লোপাট করা হয়েছে, এখনো বলছি আমি... হয়েছে, আমাকে ফাঁসানো হয়েছে | এ কাজ যার তার কক্ষনো ভালো হবে না দেখে নিও তুমি মৃণালিনী , আমি অভিশাপ দিচ্ছি কক্ষনো ভালো হবে না |


মৃণালিনী : আপনার অভিশাপ বুঝি কেবল আমার গায়েই লাগছে অম্বিকেশবাবু , এই দেখুন না কপালখানা তো আমারি পুড়লো | বিধবা হয়ে তিন বেলা উপোষ একবেলা সাবু খাচ্ছি | (সামান্য হাসি )


অম্বিকেশ : হ্যাঁ বিহারীর সাথে আমার মনোমালিন্য ছিল , তাই বলে ওকে আমি কোনোদিন খুন করবো না মৃণালিনী , এ কথা তুমিও জানো | যে লোক এ কাজ করেছে সে....


মৃণালিনী ( কথা শেষ হওয়ার আগেই ): আহা....লোকই কেন হতে হবে বলুন তো? মহিলাও তো হতে পারে ?


অম্বিকেশ : তুমি আমার সাথে মস্করা করছো মৃণালিনী? ঠাট্টা করছো আমার সাথে?


মৃণালিনী : বালাই ষাট | আমার ঘাড়ে কটা মাথা অম্বিকেশবাবু | শুধু এটাই বলছিলাম মেয়েরাও কিন্তু পারে | তবে শুনুন আপনাকে একখানা গল্প বলি | একটি মেয়ে ..১২ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গেলো ...ভালো ছেলে , পরিবার ভালো , ধনসম্পত্তিও প্রচুর | ছেলের একটাই দোষ, একটু পলিটিক্স করে | তবে ইংরেজি জানা ছেলে, সাহেবদের সাথে তার ওঠাবসা , তাই সাতখুন মাপ | মেয়েটি বিয়ের মানেও 

 জানলো না এদিকে মহা ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেলো তার |


নাহ , সংসার অসুখী ছিল না | মেয়েটি বেশ গৃহকর্মে নিপুণা, তেমন কথা বলতো না | মুখ বুজে বেশ কাজও করে যেত | সবাই সাচ্ছন্দ | বাধ সাধলো আরেক ছেলে | শহর থেকে এলো এই বাড়ি | মেয়েটির স্বামীর কোনো এক বন্ধু হবে | একসাথে পড়তো কলেজে | মেয়েটি তখন ষোড়শী | একথা বেশ ভালোই জানে যে বে-হওয়া মেয়ের পরপুরুষের দিকে তাকাতে নেই , কিন্তু কি এক অমোঘ আকর্ষণ যেন তাকে রোজ দুপুরে টেনে নিয়ে যেত চিলেকোঠার ওই ঘরটিতে | যেই দুমাস ছিল, ছেলেটি তাকে লিখতে পড়তে শিখিয়েছিলো | আর মেয়েটিও ছিল বেশ মেধাবী , কয়েক সপ্তাহেই কাঁচা হাতে নিজের নাম , ঠিকানা লিখতে পারতো | ছেলেটি যখন রবিঠাকুরের কবিতা পরে শোনাতো, মায়াভরা দৃষ্টিতে আবৃত্তিকারক -এর দিকেই তাকিয়ে থাকতো মেয়েটি | কবিতা কিছুই মাথায় ঢুকতো না ছাই | প্রেম না ভক্তি না শ্রদ্ধা , বুঝতে পারতো না মেয়েটি | একটা অজানা ভয় গ্রাস করতো তাকে | না ধরা পড়ার ভয় না , ছেলেটি চলে যাওয়ার ভয় | "ও চলে গেলে আমি বাঁচবো কি করে?" ওকে একদিন গানও শুনিয়েছিল মেয়েটি | " গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ .....", পলকহীন ভাবে তাকিয়ে ছিল সে বছর ষোলোর নববধূর দিকে |


ও চলেও গেলো | হটাৎ একদিন সকাল বেলায় ২-৩ টি সুটকেস গুছিয়ে "আসি মৃণালিনী " বলে চলে গেলো | তারপরে আর কোনোদিন ওর কোনো খবর পাইনি | কিন্তু আমার মধ্যে যেন একটা চেপে থাকা আগুন জ্বলে উঠলো | বার বার মনে হতে লাগলো , যার সাথে আছি তাকে সত্যিই ভালোবাসি কি? তার সাথে যে আমার কিছুই মেলে না | শখ - আল্লাদ , হাসি-ঠাট্টা , গল্প কিছুই মেলে না | সে যেন কাছে থেকেও কত দূরে | একটা সময়ের পর কেমন যেন অসহ্য লাগতে লাগলো তাকে | "মৃণালিনী ভাত বেড়েছ ?", "মৃণালিনী তরকারিতে নুন কম ", "মৃণালিনী মাথা টিপে দাও তো ", "মৃণালিনী পাখা করো " .... কোনোদিন সে বললো না , "মৃণালিনী বস দুটো সুখ দুঃখের গল্প করি |" সে কোনোদিন বুঝলই না আমাকে যেভাবে অন্য একজন বুঝেছিলো | দমবন্ধ হয়ে আসছিলো আমার | মনে হচ্ছিলো কবে রেহাই পাবো ? তারপরেই একদিন হাতে পড়লো আপনার চিঠি, "শীঘ্রই দেখা করিতে হইবে | জরুরি আলোচনা আছে | ----অম্বিকেশ " চিঠি দেখেই উনি বলেছিলেন , "মারতে চায় আমায় অম্বিকেশ , জানে তো ভোটে হারবে এবার, গোহারান হারবে | আমায় খুন করতে পারলেই ওর শান্তি |" কথাটা হয়তো আক্ষরিক অর্থে বলেননি উনি | কিন্তু আমার মাথায় ঘুরতে থাকলো , "খুন করতে পারলেই ওর শান্তি ...খুন করতে পারলেই ওর শান্তি |"


ঠিক বিকেল ৪টায় উনি বেরোলেন | জানলা দিয়ে সুদূর দিগন্তে ওনাকে মিলিয়ে যেতে দেখেই সাজতে বসলাম আমি | অন্যরকম সাজ | হাতের শাখা - পলা খুলে রাখলাম একপাশে | কপালের সিঁদুরের টিপ্ টা ঘষে ঘষে তুলে ফেললাম | টিউবয়েলর নিচে বসে বার বার ঘষলাম মাথা , যেন সিঁদুরের লেশমাত্র না থাকে | গলার হার , বাজুবন্ধ সব খুলে রাখলাম | লাল ডুরে শাড়িটি ছেড়ে পরনে উঠলো সাদা থান | গুনগুন করতে করতে আয়নায় দেখলাম নিজেকে | কেমন যেন অচেনা লাগছিলো | এতোবছরের সেই একই সাজ , সবছেড়ে নিজের অন্য রূপ দেখে কেমন যেন করুনা হচ্ছিলো | তবে জানেন তো অম্বিকেশবাবু , দুধ সাদা বসন পরে হাতে কালো পিস্তল - বৈপরীত্য টা আয়নার কাঁচে

 কেমন যেন বেমানান ঠেকছিল |


অম্বিকেশ(ফ্যাসফ্যাসে গলায় ) : তারপর ?


মৃণালিনী : তারপর আর কি , চলে গেলাম যেখানে আপনাদের দেখা করার কথা ছিল | জানতাম আপনার চিরকাল দেরি করে আসার স্বভাব , আপনার গিন্নি তাই নিয়ে কম কোঁদল করে না | মনে মনে ভাবছিলাম আজ যেন সময়ে না আসেন | হলোও ঠিক তাই | গিয়ে দেখলাম বিহারি একা অপেক্ষা করছে আপনার জন্য | শুকনো পাতায় পায়ের আওয়াজ পেয়ে এদিকে ফিরে তাকালো | ভয়ার্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল জানেন , বলছিলো "মৃণালিনী তুমি , এ কি অবস্থা তোমার তুমি এই বসনে ? মৃণালিনী তুমি ? বন্দুক কোথায় পেলে ? বন্দুক..." আমিও আর মায়া বাড়ালাম না , বন্ধুকের নল তখনি টিপে দিলাম | কাঁচা হাতের নিশানা তেমন পটু নয় | তবুও লাগলো ঠিক বুকে গিয়ে | কাটা কলাগাছের মতো পরে যেতে দেখলাম চিরকালের সঙ্গীকে |


অম্বিকেশবাবুর সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে | "মৃণালিনী তুমি ?" , কাঁপাগলায় বলে উঠলেন অম্বিকেশবাবু |


মৃণালিনী : আপনি যেমন প্রথমে মানতেই চাইলেন না নারীও এত নৃশংস হতে পারে , ঠিক তেমনি আইনও ভাবতে পারেনি | পুলিশ এসে লাশের পশে আপনাকেই দেখতে পায় আর আপনাদের দুজনের বচসা তো কারো অজানা নয় | সোজা কেস , তেমন ইনভেস্টিগেশনের আর দরকার কি?


অম্বিকেশ : তুমি ....তুমি আমায় ফাঁসালে??? গার্ড গার্ড .... এ .....এ.... খুনি ....গার্ড 


মৃণালিনী (ছুটে আসা গার্ড কে উদ্দেশ্য করে): ওনার বোধয় একটু মাথার ব্যামো হয়েছে , এতদিন জেলে থাকা তো |


(আলতো করে উঠে গেলো মৃণালিনী )


চিঠিটা লিখতে লিখতে একবার কলমটা নিজের হাতেই কেঁপে উঠলো মৃণালিনীর | কাঁটাতারের বেড়ার গায়ে বসে আজ সন্ধ্যের পুরো ঘটনা বিস্তারিত বিবরণ-এ লিখলো সে | এবার তো নতুন জীবন শুরু, নতুন নাম , নতুন ঘর, নতুন পথচলা , নিজের মতো করে নতুন ভাবে বাঁচা | তবে মৃণালিনীর গল্প কি কেউ জানবেনা ? কাঁটাতারের খাঁজে গুঁজে দিলো চিঠিটা | দু -পা এগিয়ে আবার ফিরে এসে চিঠিটা হাতে নিলো | কিছু একটা লিখতে ভুলে গেছে সে | কালি শেষ হয়ে আসা কলমে আবছা অক্ষরে লিখলো : ইতি মৃণালিনী |


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy