বন্ধনহীন গ্রন্থি
বন্ধনহীন গ্রন্থি


“সুপু বেরোলাম আমি। খেয়ে নিও সময় মতো, বুবুনকে আমি স্কুল থেকে তুলে ড্রপ করে দিয়ে যাবো একফাঁকে। চাপ নিও না। তোমাদের খাবার ক্যাসারোলে রাখা রইলো। অঞ্জনাকে আমি বলে দিয়েছি, ও আসার সময়ই নীচ থেকে একেবারে বুবুনকে নিয়েই উঠবে। এগোলাম, বাই!" বলতে বলতে নবারুণ দরজা টেনে বেরিয়ে গেলো। বেডরুম থেকে সুপর্ণা শুয়ে শুয়ে সব শুনলো। হুঁ হাঁ করে গেছে শুধু নবারুণের কথায়। খুব চাপ পড়ে গেছে বেচারা নবারুণের। সবদিক কী করে যে সামলাচ্ছে! সুপর্ণা এখনো বিছানাবন্দী। প্রায় দু'মাসের ওপর হয়ে গেল কোমর ভেঙে পড়ে আছে বিছানায়। পড়ে গিয়ে কোমরের হাড়ে বড়সড় ডিসলোকেশন। একটা হেয়ারলাইন ক্র্যাকও আছে। ট্র্যাকশনেই রয়েছে এখনো। কমপ্লিট বেডরেস্ট। এতোদিন ধরে সুপর্ণা হসপিটালে থাকতে চায়নি, বাচ্চা মেয়ের মতো কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিলো। অগত্যা ডাক্তারবাবুর সাথে আলোচনা করে নবারুণ বাড়িতেই সব ব্যবস্থা করেছে। এমনকি যতক্ষণ নবারুণ বাড়িতে থাকে, ততক্ষণ ওই সব করছে। শুধু ওর কাজে বেরোবার সময়টুকুর জন্য অঞ্জনা বহাল হয়েছে। নবারুণ ফিরলে অঞ্জনা চলে যায়। সুপর্ণা মোবাইল ফোনটা হাতে তুলে নিলো। একা ঘরে, বিছানায় শুয়ে আর কীইবা করবে! শুয়ে শুয়ে নানারকম ভিডিও দেখছিলো।
সুপর্ণার চোখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো দু'ফোঁটা জল। আহা, এই ভদ্রলোক কী আর সাধে বিশ্বকবি! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা প্রত্যেকটি লাইন যেন হৃদয় খুঁড়ে তুলে আবেগ ঢেলে লেখা। কী অর্থবহ!
"পথ বেঁধে দিলো বন্ধনহীন গ্রন্থি,
আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।"
কথাগুলো সুপর্ণার জীবনে যে এরকম মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে, তা কে জানতো? সুপর্ণা পিছিয়ে গেলো অনেকটা বছর আগে।
আজও পৃথিবীতে নবারুণের মতো মানুষেরা আছে বলেই হয়তো সুপর্ণার মতো অথৈ সাগরে ডুবন্ত মানুষও আজও পৃথিবীতে বেঁচে আছে! দশ বছরের সান্নিধ্যে সুপর্ণা প্রতিদিন নবারুণকে আবিষ্কার করে চলেছে। সুপর্ণার চোখে নবারুণ সাক্ষাৎ ভগবান।
******
কলেজ জীবনের ঢেউয়ে সুপর্ণা মোচার খোলার মতো ভেসে ভেসে বেশ কাটাচ্ছিলো। ফাইন আর্টসের ছাত্রী সুপর্ণা, ধ্রুপদী নৃত্যের ছাত্রী, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোড়াসাঁকো ক্যাম্পাসে। মাস্টার্স শেষ হবো হবো সময়ে হঠাৎই বিয়ের সম্বন্ধ। প্রবাসী বাঙালি পরিবার। তিনপুরুষ ধরে পুণেতে। পাত্র প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ার। কর্মসূত্রে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াতে হয়। অঢেল রোজগার। প্রচুর পৈতৃক সম্পত্তি। পাত্রের বাবা মা দাদা... সবাই পারিবারিক ব্যবসায়। নানারকম কোম্পানি তাদের। একমাত্র মেয়ে রাজরানী হয়ে থাকবে, এই আশায় সুপর্ণার বাবা-মা বিয়ের ঠিক করে ফেললো ঐ ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের সাথে। সুপর্ণার আর মাস্টার্স ডিগ্রী শেষ করা হলো না। সত্যি বলতে কী নব্যযুবতী সুপর্ণারও আপত্তি ছিলো না। শিক্ষিত পাত্র, সম্পন্ন নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার। বেশী ভাবনাচিন্তা করতে চায় নি, সুপর্ণা এবং সুপর্ণার পরিবার। বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়লো সুপর্ণা। তখন মনে অনেক নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন। সব সঙ্গী করে অন্য শহরে পাড়ি দিলো সদ্যবিবাহিতা সুপর্ণা, স্বামীর হাত ধরে। প্রথম প্রথম স্বপ্নের মতো কেটে গেলো দিনগুলো। বিয়ের দু'মাসের মাথায় সুপর্ণার বর আদি অফিসট্যুরে গেলো মাস খানেকের জন্য ইউরোপে।
পুণেতে শ্বশুরবাড়িতেই রয়ে গেলো সুপর্ণা। সারাদিন বাড়িতে একলা সুপর্ণা। আর কাজের লোকজনেরা। শ্বশুর শাশুড়ি ভাশুর সবাই যে যার মতো নিজেদের কাজে বেরিয়ে যায়, সন্ধ্যে পার করে বেশ রাত করেই বাড়িতে ফেরে সবাই। সারাটা দিন যেমন তেমন করে, টিভি দেখে, গল্পের বই বা ম্যাগাজিন পড়ে, আবার কখনো সখনো রান্নার মাসীকে সরিয়ে পোশাকি কোনো খাবারের ডিশ বানানোর চেষ্টা... ইত্যাদি করে কেটে গেলেও সন্ধ্যের পর কিছুতেই সময় কাটতেই চায় না। এই সময়েই সাধারণত আদি ফোন করে। কিন্তু সে আর কতক্ষণের জন্য! তবুও মুখিয়ে থাকে সুপর্ণা এই সময়টুকুর জন্য।
পুণে শহরের আবহাওয়াটা ঠিক যেন কলকাতা শহরের মতো নয়। সন্ধ্যের পরে একটু গা শিরশিরে শীত শীত অনুভূতি প্রায় বছরভর। সুপর্ণা আদির সাথে কথা বলে দোতলায় ওর বেডরুম লাগোয়া বাইরের বারান্দায় গায়ে পাতলা স্টোলটা জড়িয়ে দাঁড়িয়েছিলো। অদূরে আলো ঝলমলে পুণে শহর ছড়িয়ে আছে। খুব সুন্দর দেখায় এই সন্ধ্যের পরের সময়টা। দীপাবলির রাত যেন। সুপর্ণার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। বাবা-মা কত দূরে কলকাতায়। আর এখানে এতো দূরের শহরে সুপর্ণা একলা। আদি নেই বাড়িতে। সুপর্ণার গলার কাছে একটা ব্যথা মতো দলা পাকিয়ে উঠলো। ঠিক তখনই কাঁধে আলতো চাপ। অচেনা স্পর্শ। চমকে উঠে ঘাড় ঘোরায় সুপর্ণা। আদির দাদা অভি, অর্থাৎ সুপর্ণার ভাশুর। কখন বাড়িতে ফিরে এসেছে তা সুপর্ণা টেরই পায়নি। নরম গলায় অভি বলে, "কী, মন খারাপ?" সুপর্ণা কোনোরকমে কান্না চেপে জোর করে ঘাড় নেড়ে, "না", জানিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো সুপর্ণা। অভির ব্যবহার সম্পর্কে সুপর্ণা একটু যেন ধন্ধে। তবে একটু সতর্ক হয়ে গেলো ও। আদি যে কবে ফিরবে! সুপর্ণার মনে হলো কলকাতায় গেলে হতো, বাবা-মায়ের কাছে। কিন্তু আপাতত সে উপায় নেই।
ঠিক যথাসময়ে আদি ফিরে এলো ইউরোপ থেকে। ততদিনে সুপর্ণা কেমন যেন, চোখমুখ শুকনো, একটু অন্যমনস্ক। খুব সতর্ক সবসময়। অভিকে এড়িয়ে চলে যথাসম্ভব। কারণ গত একমাসে বাড়িতে আদির অনুপস্থিতির দিনগুলোতে অভি কারণে অকারণে সুপর্ণাকে ছুঁয়ে দিয়েছে। সুপর্ণার একদম ভালো লাগেনি বিষয়টা। অথচ এমন একটা গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে কাউকে কিছু বলতেই পারেনি। এমনকি ফোনে বাবা-মাকে অথবা ফেরার পরে আদিকে, কাউকেই কিচ্ছুটি বলতে পারেনি। ঠিক করে বুঝেই উঠতে পারেনি ঠিক কী বলবে, বা কিভাবে বলবে? মুখ বুজেই থেকেছে সুপর্ণা। ভেবেছে যদি কেউ ওর এই কথা বিশ্বাস না করে? উল্টে তখন তো ওর নিজের চরিত্রের দিকেও আঙুল উঠতে পারে! সুতরাং মৌনব্রত।
আদি কতটা কী বুঝেছিলো সুপর্ণার ব্যবহারের এই অসংলগ্ন ভাব বা পরিবর্তন, তা সুপর্ণা জানে না। তবে আদির চোখেও যেন সন্দেহের একটা কালো আবছা ছায়া পড়তে দেখেছে সুপর্ণা। আর এখানেই ঘোর অস্বস্তি সুপর্ণার। ইউরোপ থেকে ফিরে ঠিক দু'মাসের মাথায় আবার আদির দিন পনেরোর জন্য ব্যাঙ্ককে যাওয়ার কথা শুনে ক্ষীণস্বরে সুপর্ণাও সঙ্গে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু সেই ঝটিকা সফরে এবং কাজের বিস্তর চাপ থাকায় আদি সুপর্ণাকে নিয়ে যেতে পারলো না। তবে যাবার পথে ফ্লাইট ব্রেক করে কয়েকদিনের জন্য কলকাতায় রেখে গেলো সুপর্ণাকে, ওর বাবা-মায়ের কাছে। সেই বিয়ের পরে, প্রায় ছ'মাস পরে সুপর্ণা বাবা-মায়ের কাছে। ক'দিন খুব আনন্দেই কাটলেও সুপর্ণার মনে খিচখিচে কাঁটাটা বিঁধেই আছে। বলি বলি করেও বাবা-মাকে কিছুই বলতে পারলো না সুপর্ণা। আর ওর বাবা-মা তো মেয়ের সুখে গদগদ একেবারে। দেখতে দেখতে পনেরো দিন পার। ব্যাঙ্কক থেকে ফেরার পথে আদি সুপর্ণাকে নিতে এসে কলকাতায় দিন চারেক কাটিয়ে পুণেতে ফিরলো।
তারপর মাস তিনেক আদিকে আর অফিসের কাজে বিদেশে যেতে হয়নি। দু-একদিনের জন্য মুম্বাই আর ব্যাঙ্গালোরে যেতে হয়েছে কেবল। এতোদিনে সুপর্ণা মানিয়ে নিয়েছে সংসারে। তবে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে অবাক হয়েছে সুপর্ণা, শ্বশুর শাশুড়ি আদি অভি এদের চারজনের মধ্যেই কেমন একটা আড়োআড়ো ছাড়োছাড়ো ভাব। সবাই যেন নিজের মতো নিজের জীবনযাত্রায় বেশী অভ্যস্ত। অবশ্য তাতে সুপর্ণার বরং ভালোই। এইসব ওর ভেবে কী লাভ? সুপর্ণাও তো চেয়েছিলো নিজের মতোই নিজে থাকতে।
চেয়েছিলো তো সুপর্ণা অনেকটা কিছুই, কিন্তু পেলো আর কোথায়? সুপর্ণাকে নিয়ে পরের ট্যুরেই আদি ইউএসএ ঘুরিয়ে আনার প্ল্যান করলো। খুশিতে ডগমগ সুপর্ণা। এবারে আদিকে ওর অফিস পুরো ছ'মাসের একটা অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে পাঠাচ্ছে। সব গোছগাছ সারা। তবে রওনা হবার আগে একবার বাবা-মায়ের সাথে কলকাতায় দেখা করতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো সুপর্ণার। তবে সময়ে কিছুতেই কুলিয়ে উঠতে পারছে না আদি। সেদিন খাবার টেবিলে কথাটা উঠতেই আগ বাড়িয়ে যেচে বলে ওঠে অভি, "ঠিক আছে আমি দিন দুয়েকের জন্য ঘুরিয়ে আনতে পারি ওকে। আসলে আমাকে তো দিন দুয়েকের জন্য ব্যবসার কাজে কলকাতায় যেতেই হচ্ছে!" কথাটাকে একেবারে লুফে নিলো আদি, "হ্যাঁ দাদা, ঠিক বলেছিস একদম। আমার কিছুতেই শেডিউল অ্যাডজাস্ট হচ্ছে না রে।" শুতে এসেও সুপর্ণা কিছু বলারই সু্যোগ পেলো আদিকে। তারপর যা হয়, চব্বিশের তরুণী আর তিরিশের তরুণ যখন একই রাতবিছানায়, তখন কথাবার্তা আলাপ আলোচনারা গৌণ। আর শরীরী প্রেমে চাপা পড়ে হয়তো সাময়িক ভাবে বাকী সবকিছু, এমনকি নিরাপত্তাহীনতাও।
পরদিনই সুপর্ণা অভির সাথে কলকাতা রওনা হলো। আদি এয়ারপোর্টে ছাড়তে এসেছিলো। ফ্লাইটের পুরো সময়টাই অভি সুপর্ণার শরীর অনেকবার ছুঁয়েছে, চিপকে থেকেছে সুপর্ণার গায়ের সাথে। সুপর্ণা কাউকেই বলতে পারছে না কিচ্ছু। কী বলবে ও, আর কী ভাববে সবাই! মাত্র দু'দিন তো! ফিরে গিয়েই বলতে হবে আদিকে। তারপর ভাবলো বিদেশে পৌঁছে তারপর বলবে। অশান্তি ঝুট ঝামেলা হয় যদি। থাক গে, একটু সাবধানে থাকলেই হবে, আর মাত্র কয়েকটা দিন। কলকাতা থেকে পুণে ফেরার সময়ও একই রকম অসভ্যতা করে গেলো অভি পুরোটা রাস্তা। পুণেতে ফেরার পরে ওদের ইউএসএ রওনা হবার ঠিক তিনদিন আগে আদিকে একটা জরুরি মিটিঙে থাকতে হবে বেশীরাত পর্যন্ত, তারপর আবার পার্টি আছে। ফিরতে রাত হবে, বলেই গিয়েছিলো আদি। তবে ঠিক কটা বাজবে সেটা জানাতে পারেনি। সুপর্ণা খেয়েদেয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। আদি বলে দিয়েছিলো শুয়ে পড়তে। আদি ফিরে এসে নক করবে। ততক্ষণ ঘুমিয়ে নেয় যেন সুপর্ণা। সামনে লম্বা জার্নি, সুপর্ণার প্রথমবার। কাজেই শরীর পুরো ফিট থাকতে হবে। সুপর্ণার একটু চোখটা লেগে এসেছিলো, দরজায় নক শুনেই ও ধড়মড় করে উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই, অভি ঝাঁপিয়ে পড়ে সুপর্ণার মুখটা চেপে ধরে দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর জঘণ্যতম অপরাধটি ঘটে গেলো। সুপর্ণা ধর্ষিতা হলো ভাশুরের হাতে।
তার পরের ঘটনা অবশ্য অনুমানযোগ্য। ঘটনার পরে শ্বশুর শাশুড়িকে গিয়ে বললো সুপর্ণা সব, সেই শুরু থেকে এই পর্যন্ত। যথারীতি বিশ্বাস করেনি তারা, উল্টে শুনিয়েছে নাচনেওয়ালি মেয়ের আবার এতো শুচিবায়ুগ্রস্ততা কেন? ওরকম হয়েই থাকে। ওতে কিছু এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয় না। চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গিয়ে শুয়ে থাকার পরামর্শ দিয়েছে তারা। সুপর্ণা কাঁদতেও ভুলে গিয়েছিলো। কী সাংঘাতিক শীতল নির্বিকার এরা? ছিঃ ছিঃ! এই পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কের আর কোনো মানেই হয় না। আসলে ততক্ষণে সুপর্ণা আদির উপর থেকেও বিশ্বাস ভরসা পুরোপুরি হারিয়েছে। ওর মনে বদ্ধমূল ধারণা হলো আদিও ব্যাপারটা উড়িয়েই দেবে। আর যে সুখবরটা সুপর্ণা আদিকে আমেরিকায় পৌঁছে দেবে ভেবে রেখেছিলো, তা আজীবনের জন্য সুপর্ণার একলার হয়েই থাক। সুপর্ণা এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়লো বাড়ি ছেড়ে। যথেষ্ট রাত। শহর প্রায় অচেনা। তবুও আর কীইবা ক্ষতি হবার আছে, ভেবে রাস্তায় হাত দেখিয়ে দেখিয়ে একটা ট্যাক্সি দাঁড় করালো, ভেতরে এক আরোহীসমেত, পেছনের সিটে। সুপর্ণা ভাঙা হিন্দিতে ড্রাইভারকে গন্তব্য জানালো পুণে স্টেশন।
******
চোখ মেলে সুপর্ণা নিজেকে আবিষ্কার করলো অচেনা অপরিচিত জায়গায়। হসপিটালে রয়েছে সুপর্ণা। ট্যাক্সিতে উঠেই ও জ্ঞান হারিয়েছিলো। ট্যাক্সির পেছনের সিটের আরোহীই হসপিটালে নিয়ে এসেছে সুপর্ণাকে। ইণ্ডিয়ান এয়ারফোর্সের অফিসার নবারুণ পাইলট ছিলো। অ্যাক্সিডেন্টে একটা পা হারিয়েছে বটে, তবে তাতে সুপর্ণার দায়িত্ব যেচে নিজের কাঁধে তুলে নিতে পিছপা হয়নি। আর কী আশ্চর্য, জ্ঞান আসার পরে সুপর্ণা এই স্বল্প সময়ের জন্য দেখা অপরিচিত মানুষটির হাত দুটো জড়িয়ে ধরে নির্দ্বিধায় অবলীলাক্রমে বলে গেছে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া আগাগোড়া সব ঘটনা। নবারুণের চৌকো কঠিন মুখের রেখায় কোনো অভিব্যক্তি ধরা পড়েনি সুপর্ণার চোখে। তবে চোখের ভাষায় খুঁজে পেয়েছে অপার আশ্বাসের ভরসা। সেই থেকে নবারুণের ফ্ল্যাটেই সুপর্ণা। কারণ কলকাতায় সুপর্ণা পৌঁছোনোর আগেই পৌঁছেছিলো খবর, ফোনেই। তাতে অবশ্য সুপর্ণাকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে, স্বামীর অনুপস্থিতিতে ভাশুরকে শারীরিক প্রলোভন দেখানোর অভিযোগে। দুশ্চরিত্রা, নষ্টা, কলঙ্কিনী। এসব করে আবার কুলের মুখে চুনকালি দিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। ধাক্কাটা হাই ব্লাড প্রেসারের রুগী মা নিতে পারেনি। আর বাবাও বোধজ্ঞান হারিয়েই ফেলেছে। সুপর্ণাকে নিয়ে গিয়ে নবারুণ পরিস্থিতি বুঝে কলকাতাতেই এক ওল্ড এজ হোমে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে সুপর্ণার বাবার। তাও আজ দশ বছরের কথা।
সুপর্ণার ছেলে মানে সুপর্ণা আর আদির ছেলে বুবুন, ভালো নাম উদয়াদিত্য। নবারুণই রেখেছে নামটা। বুবুনের পালক পিতা। সুপর্ণা আর নবারুণ বিয়েটা আর করেনি। বিয়েতে বিশ্বাস নেই ওদের। নবারুণের এয়ারফোর্স থেকে পাওয়া অবসরকালীন টাকায় ভুবনেশ্বরের উপকন্ঠে একটা অ্যাকাডেমি খুলেছে। সেখানে সুপর্ণা ধ্রুপদী নাচ শেখায়। আর নবারুণ সব দেখাশোনা করার ফাঁকে ফাঁকে অ্যাকাডেমিতে পিয়ানো শেখায়। চলে যায় ওদের তিনজনের ছোট্ট সংসার। সেখানে কোনো টানাপোড়েন নেই, কোনো অশান্তি নেই, কোনো চাওয়া পাওয়া লেনদেনের হিসেবনিকেশ নেই। আছে শুধু অপরিসীম ভালোবাসা আর পারস্পরিক নির্ভরতায় বাঁধা শক্তপোক্ত নিরাপদ বন্ধনহীন গ্রন্থি।