🌺 বিসর্জন 🌺 পর্ব 🔸১

মাসিমণিদের চোখের সামনে পড়ে রয়েছে মিষ্টি ফুটফুটে তিতলির পোড়া দেহ । পুলিশ যতক্ষণে আসলো ততোক্ষণে সব শেষ । 

মাসিমণির কাছে শুনেছিলাম এই দুঃসহনীয় ঘটনা । একটি মেয়ের করুণ পরিণতির কাহিনী । প্রয়োজন স্বার্থে নামগুলি পরিবর্তন করলাম । 

আজ থেকে বছর পাঁচেক আগের ঘটনা । 

বছর পাঁচেক আগে একটি পরিবার থাকতো মাসিমণির পাড়াতে । বাবা - মা - ছেলে - বৌমা ও কুড়ি দিনের এক নাতনি । 

কলেজে পড়াকালীন সন্দীপন ও তিতলির প্রথম দেখা হয় কলেজ ক্যান্টিনে । সন্দীপন তখন থার্ড ইয়ারের কমার্সের ছাত্র আর তিতলি ফার্স্ট ইয়ার বাংলা অনার্স । তিতলি ও সন্দীপন দুজনেই ভালো গান করতো, আর এই সূত্রেই আলাপ খুব তাড়াতাড়ি

 জমে ওঠে । এই ধীরে ধীরে পরিনত হয় প্রেমে । কলেজ লাইফে জমিয়ে প্রেমের সাথে সাথে ভালো রেজাল্ট ও করলো দুজনেই । 

গ্রাজুয়েশন শেষ করে তিতলি বাংলায় মাস্টার্স কোর্স করে আর অন্যদিকে সন্দীপন M.Com ছাড়াও আরো অনেক কোর্স শেষ করে । সন্দীপন এক বিখ্যাত high school পেয়ে তিতলির সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে নিজের বাবা - মাকে জানায় । ২০১৪ সালের ১২ ই ডিসেম্বর খুবই জাকজমক করে বিয়ে হয় সন্দীপন ও তিতলির । খুব আনন্দেই কাটছিল ওদের বৈবাহিক জীবন ।

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সন্দীপন জানতে পারলো তিতলি অন্তঃস্বত্তা । ওদের বাড়িতে এই খবরে যেন খুশির ঢেউ এসে গেল । সন্দীপনের মা কাঁথা সেলাই করে, ছোট্ট ছোট্ট জামা বানিয়ে পাহাড় করে তোলে । আর সন্দীপন খেলনায় ভরিয়ে তোলে সারা ঘর । তিতলি বললো, " আচ্ছা, এখনো তো অনেক দেরী আছে , এখন থেকেই এতো কিছু ? উত্তর তোমরা পারো পাগলামি করতে । " কথায় কথায় তিতলি খেয়াল করলো শ্বাশুড়ী মা যেসব জামা তৈরি করেছে সবই ছেলে বেবির জন্য । আর সন্দীপনের আনা খেলনার মধ্যে সবই গাড়ি, রোবট, ব্যাট - বল, বন্দুক এইসব ছেলে শিশুর জন্য মেয়ে শিশুর জন্য কোনো পুতুল, রান্না-বাটি কিছূই নেই ।

খুব অবাক হবে তিতলির । তিতলি একদিন কথায় কথায় শ্বাশুড়ীকে জিজ্ঞাসা করে, " মা, তুমিও সব ছেলে বেবির জামা বানিয়েছো আর তোমার ছেলেও সব ছেলে বেবির খেলনা এনেছে । কেনো মা ? " শ্বাশুড়ী বলে, " কারণ আমরা জানি তোমার ছেলেই হবে । আমাদের বংশে সবারই প্রথম সন্তান ছেলেই হয়েছে , তোমারও তাই হবে । " সব শুনে তিতলি একদম চুপ করে যায় । যাইহোক তিতলি শ্বাশুড়ীর সামনে থেকে উঠে রান্নাঘরে চলে যায় কিছু খাবার বানাবে ভেবে, সন্দীপনের অফিস থেকে ফেরার সময় হয়ে এসেছে । সাথে সাথেই শ্বাশুড়ী দৌড়ে এলো, " কি করছো, কি করছো ? " তিতলি বললো, " তোমার ছেলের ফেরার সময় হয়ে এসেছে , কিছু জলখাবার করে রাখি । " শ্বাশুড়ী বললো , " না, তুমি যাও গিয়ে বিশ্রাম নাও, আমি কিছু বানিয়ে দেবো । " সত্যি খুবই ভালো শ্বাশুড়ী ছিল । কোনো কাজ করতে দেয় না, খাবার নিয়ে মুখের সামনে দেয়, মাঝে মাঝে খাইয়ে দেয় । সত্যি এরকম শ্বাশুড়ী ভাগ্য করেই পাওয়া যায় । অফিস থেকে ফেরার পথে সন্দীপন আবার খেলনা নিয়ে হাজির । এবার এনেছে Superman , Spiderman, Hulk , Krish, Shaktiman এইসব হিরোয়িক পুতুল । রাতে শুয়ে শুয়ে সন্দীপনকে জিজ্ঞাসা করলো, " কিগো, একটা কথা বলবো ? " সন্দীপন মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, " বলো " । তিতলি বললো, " তুমি সবসময় ছেলে বেবির জন্য খেলনা আনো কেনো ? কোনো মেয়ে বেবির খেলনাতো কখনো আনো না ? " তখন সন্দীপন তিতলির কপালে চুমু খেয়ে বললো, " পাগলী আমাদের একটা ছোট্ট প্রিন্স আসতে চলেছে । তুমি দেখো আমি আমাদের ছেলেকে ইন্জিনিয়ার বানাবো, নাঃ ডাক্তার বানাবো, নাঃ নাঃ পাইলট বানাবো । খুব হবে দেখো আমাদের ছেলে । " তিতলি সব শুনে শুধু একটু আলতো করে হাসে, আর মনে মনে ভাবে, " হায়! ভগবান, এরা সবাই ধরেই নিয়েছে আমার ছেলেই হবে । কিন্তু যদি মেয়ে হয় তাহলে, তাহলে কি হবে ?..... " এইসব ভাবতে ভাবতে তিতলি ঘুমিয়ে পড়ে । পরের দিন ফোনে নিজের মা ও বৌদিকে সব কথা খুলে জানায় । তিতলির মা বলে, "তুই ভাবিস না এই নিয়ে, ওরকম সবারই নাতি-নাতনি নিয়ে নানারকম আশা থাকে । দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে তোর ছেলে বা মেয়ের মুখ দেখলেই । " মায়ের কথায় অনেকটা স্বস্তি পায় তিতলি । আদরে - যত্নে - হাসিতে - খুশিতে ভরে উঠেছিল তিতলির জীবন । 

হঠাৎ একদিন রাত তিনটে নাগাদ পেটে অসহ্য যন্ত্রনা শুরু হয় তিতলির । শ্বাশুড়ী বুঝতে পারে প্রসব বেদনা শুরু হয়ে গেছে । উনি নিজের ছেলেকে বলে, " বাবু তাড়াতাড়ি গাড়ি বের কর, তিতলিকে এখনি হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে । " রাতারাতি তিতলিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হোলো । সবাই খুব চিন্তায় আছে । 9th October সকাল ছয়টা নাগাদ নার্স এসে জানায়, " Congratulations Mr. Sengupta আপনার খুব মিষ্টি একটি মেয়ে হয়েছে । একেবারে মায়ের মতো হয়েছে দেখতে । " এই বলে নার্স চলে যায় । মেয়ে হয়েছে শুনেই সবার আনন্দ, মুখের হাসি সব উড়ে গেলো । যাইহোক সীজার হয়েছে তাই ছয়দিন পর তিতলির discharge হোলো । তিতলি মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে 

আসলো । তিতলি খেয়াল করলো কারো মুখেই কোনো হাসি নেই, এমনকি বাচ্চাটিকে কেউ ধরেও না আদর করাতো অনেক দূরে । তিতলি খুব কষ্ট পায় কিন্তু কিছু বলে না । মেয়েটি এতো মিষ্টি হয়েছিল তাই তিতলি মেয়েকে " মিষ্টি " বলেই ডাকতো । হাসপাতাল থেকে ফেরার ঠিক দুদিন পর থেকে শুরু হোলো নানারকম শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার ।