🌺 বিসর্জন 🌺 অন্তিম পর্ব

সন্দীপনের মুখে সবাই মিলে ঠাকুর দেখতে যাবে শুনে তিতলি ভাবলো হয়তো ও আর মেয়ে যাবে কিন্তু না সপ্তমীর রাতে ভুলটা আবার ভেঙে গেলো । শ্বশুর-শ্বাশুড়ী সন্দীপন ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে গেলে তিতলি একটা নতুন সুতির শাড়ি নিয়ে বসলো মেয়ের জন্য জামা বানাতে । বসে বসে পাঁচ - ছটা জামা বানিয়ে ফেললো । তারপর মেয়েকে খাইয়ে মেয়ের পাশে শুয়ে রইলো । রাত দুটোর সময় সবাই ফিরে এলো ঠাকুর দেখে । সবাই খুব ক্লান্ত । সন্দীপন ক্লান্ত হলেও শরীরের ক্ষিদেতো মেটাতেই হবে তাই তিতলির অনিচ্ছা স্বত্বেও...... । সীজার হওয়ায় পেটের সেলাইয়ের জায়গায় অসহ্য যন্ত্রনায় কাতরাতে থাকে তিতলি কিন্তু সন্দীপনকে বললেও শুনতো না । আমাদের সব বাড়িতে বাচ্চা হলে একমাসের অসুজ থাকে কিন্তু তিতলির শ্বাশুড়ী সে সব কিছুই মানতো না ।

শুধু ঠাকুর ধরা আর শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর বিছানার সামনে যাওয়া বারণ ছিল কারণ অসুজ শুধু এই দুটি জিনিসের জন্য । রান্না করা, বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঘর মোছা এই সবের জন্য অসুজ ছিল না । রোজ দিনে- রাতে তিতলির চীৎকার আর কান্নার শব্দ পাড়া প্রতিবেশীরা শুনলেও কিছু করতে পারতো না কারণ তিতলি নিজেই তাদের অপমান করে বের করে দিয়েছিল ।

দশমীর দিন পাড়াতে মা দূর্গার বরণ প্রায় শেষ , রাতেই মায়ের বিসর্জন হয়ে যাবে তাই পাড়ার সবাই খুব ব্যস্ত । রাত আট টা হবে তখন, পাশের বাড়িতে আমার মাসি রান্না ঘরে কাজ করছে হঠাৎই খুব বিশ্রী পোড়া গন্ধ নাকে এলো । মাসি বুঝতে পারছিল না গন্ধটা কোথা থেকে আসছে, এরকম বিশ্রী ধরনের গন্ধ আগে কোনোদিন নাকে আসে নি । মিনিট খানেক সময় লাগলো বুঝতে গন্ধটা তিতলিদের বাড়ি থেকে আসছে এবং ধোঁয়াও বেরোচ্ছে । কিন্তু খুব জোরে তখন গান বাজছে তিতলিদের বাড়িতে । মাসি তাড়াতাড়ি পাড়ার পূজোর সামনে গিয়ে পাড়ার ছেলে - পুরুষ আর মহিলাদের সব জানায় । মা দূর্গার বিসর্জন নিয়ে সবাই এতোটাই ব্যস্ত ছিলো যে তিতলির বাড়ির পোড়া গন্ধ বা ধোঁয়া খেয়াল করে নি। মাসির মুখে সবাই শুনেই ছুটে আসে তিতলিদের বাড়িতে । প্রায় তিরিশ জন মহিলা-পুরুষ মিলিয়ে । সবাই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সন্দীপন আর সন্দীপনের বাবা - মাকে ডাকতে থাকে । কেউ উত্তর না দেওয়ায় সবাই মিলে দরজা ভেঙে বাড়ির ভিতরে ঢুকে দোতলায় গিয়ে দ্যাখে সারা ঘরে প্রচুর ধোঁয়া আর অসহ্য পোড়া গন্ধ । কিন্তু একি ? দাউদাউ করে জ্বলছে তিতলির শরীর । সন্দীপন আর সন্দীপনের বাবা - মা কেরোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে দিয়েছে তিতলিকে ।

উফ্! কি নিদারুণ দহন জ্বালা । পাড়ার ছেলে- পুরুষদের এক দল তাড়াতাড়ি করে তিতলিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায় । একদল মহিলা- পুরুষ মিলে সন্দীপন আর সন্দীপনের বাবা- মাকে মেরে আধমরা করে তুলে দেয় পুলিশের হাতে । আমার মাসিমনি তিতলির মেয়ে মিষ্টিকে নিয়ে যায় নিজের বাড়িতে । হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর যতক্ষণে পুলিশ পৌঁছালো ততক্ষণে তিতলির শেষ নিঃশ্বাসটাও বেরিয়ে গেছে শরীর ছেড়ে । সারা শরীরে আর কিছুই যেন অবশিষ্ট ছিল না, গায়ের চামড়া - মাংস সব পুড়ে গলে গলে পড়ছিল । পুলিশ কোনোরকম বয়ান নিতে পারেনি তিতলির কাছ থেকে । অনেক দিন ধরে তদন্ত চলে । তিতলির বাড়িতে সব সরজমিন তদন্তের সময় পুলিশ খুব অবাক হয়ে যায় এক বিশেষ ঘটনায় । তিতলির মেয়ের মাথার বালিশ - পাশবালিশ এসবের ভিতর থেকে পাওয়া যায় অসংখ্য ছোটো ছোটো চিরকুট । তিতলির সাথে রোজ যা হোতো সেগুলো তিতলি সুযোগ বুঝে ছোটো ছোটো চিরকুটে লিখে মেয়ের বালিশের ভিতর লুকিয়ে রাখতো । এই এক একটা চিরকুট তিতলির জবানবন্দী । সেই সব চিরকুট থেকে এমন কিছু ঘটনা সামনে আসে যা পাড়া প্রতিবেশীদের হুশ উড়িয়ে দেয় । 

চিরকুটে পাড়ার সবার কাছে ক্ষমা চেয়েছিল তিতলি নিজের ব্যবহারের জন্য । তিতলি লিখেছিল, " আপনারা সবাই আমাকে

 ক্ষমা করবেন , আমি আপনাদের তাড়িয়ে দিয়েছিলাম । আমার বুকের দুধ আমার শরীর বেয়ে ভেসে যেতো কিন্তু আমাকে

মিষ্টিকে খাওয়াতে দিতো না । আমাকে সব সময় ভয় দেখিয়ে বলতো কারো সামনে মুখ খুললেই ওরা মিষ্টিকে মেরে ফেলবে । তাই আমি সেদিন...... ।

" আরেকটি চিরকুটে লেখা ছিল সন্দীপন ও সন্দীপনের মায়ের অবর্তমানে শ্বশুর কিভাবে শারীরিক নির্যাতন করতো আর কাউকে বললে মেরে ফেলবে ওকে আর মিষ্টিকে । সেই ভয়ে শ্বশুড়ের নির্যাতন সহ্য করেছে এই ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েটা । আরেকটি চিরকুটে লিখেছিল, " আমি আমার মেয়ের বালিশ - পাশ বালিশের ভিতর সবকিছু লিখে লুকিয়ে রাখলাম কারণ ওরা কেউ কোনোদিন আমার মেয়েকে ছুঁয়েও দেখেনি আর বালিশ ধরার কোনো 

প্রশ্নই নেই । যদি কোনোভাবে আমার মৃত্যু হয় তাহলে যেনো ওরা চরম শাস্তি পায় তাই এগুলো লিখে রাখছি । আমার মেয়েটাকে সবাই দেখবেন....... " । এরকম অসংখ্য চিরকুট । সব জানার পর তিতলির বাপের বাড়ির লোক ও তিতলির শ্বশুর বাড়ির 

প্রতিবেশীরা কেঁদে ফেলে । 

পুলিশের জেরার পর সন্দীপন আর সন্দীপনের বাবা- মা সব স্বীকার করে নেয় । কন্যা সন্তান চায়নি তারা তাই তিতলির এই করুণ পরিণতি । 

 

আমি বলি, তোরা কি মানুষ ? সন্তান জন্ম কি কারো নিজের হাতে ? আমরা নারীরা পুত্রসন্তান জন্ম দেবো না কন্যা সন্তান জন্ম দেবো সেইটা আমাদের নিজেদের হাতে থাকে ? তিতলির শ্বাশুড়ী, সে কন্যা সন্তান নয় ? তার জন্মের পর তাকেও মৃত্যুর সাজা দিলে কেমন হোতো ? 

এতো মূর্খ তোমরা ? মা একজন কন্যা, ছেলের বিয়ের জন্য লাগবে ফুটফুটে রাজকন্যা , মা কালী - মা দূর্গা - মা লক্ষীর পূজো করছে তারাও কন্যা তাহলে নিজেদের ঘরে কন্যা সন্তান জন্মালেই দোষ ? তাহলে তিতলির মতো বহু বাড়িতে কন্যা শ্বাশুড়ী - কন্যা বৌমা - কন্যা পিসি ( ননদ ) - কন্যা ঠাকুমার ঘরে কন্যা নাতনির জন্মই অভিশাপ ? 

সত্যি লোকেরা ঠিকই বলে 

মেয়েরাই মেয়েদের পরম শত্রু , 

মেয়েরা নিজেরাই পিষ্ট হয়

মেয়েদেরই জাঁতাকলে ।। 

দশমীর দিন রাতে মৃন্ময়ী মা দূর্গার সাথে সাথে

আরেক জীবন্ত দূর্গা তিতলির ও বিসর্জন হয়ে গেলো । সন্দীপন আর সন্দীপনের বাবা- মায়ের হয়ে গেল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড । তিতলির মেয়ে মিষ্টি এখন মামাবাড়িতে খুব আদরে - যত্নে বড়ো হয়ে উঠছে । এখন মিষ্টির আনুমানিক পাঁচ বছর বয়স । শুধুমাত্র পুত্র সন্তান নয়, কন্যা সন্তান তাই এই দোষে মাত্র কুড়ি দিন বয়সে মাতৃহারা হতে হোলো মিষ্টিকে ।