বিজয়িনী
বিজয়িনী
কফি শপের জানলা দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে মালিনী। মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছে সামনে রাখা কাপের গরম কফিতে। নীল সিল্কের স্কার্ফে মোড়া রক্তমাখা ছুরিটা পড়ে আছে তার হ্যাণ্ড ব্যাগের পাশে। কফিশপের ফান জোনে বাচ্চারা হুল্লোড় করছে। তার ঠোঁটের কোনে ফুটে ওঠে এক চিলতে হাস...'মা, আমি স্লিপে খেলতে যাব- তুমি এস প্লিজ..'
'অনেক বড় হয়ে গেছ তুমি, সোনা। যাও খেল, বন্ধুত্ব কর… কত বাচ্চা খেলছে। আমরা এখানেই আছি।
মালিনীর ভয়ের আর শেষ নেই। সব থেকে বেশী ভয় তার কুকুরে। সে আগে লক্ষ্য করে, কোনও কুকুর কাছে আছে কি না! গুটি গুটি পায়ে সে এগিয়ে যায় স্লিপের দিকে।
খেলতে খেলতে হঠাৎ তার খেয়াল হয় বেলা পড়ে এসেছে। বাচ্চারাও প্রায় সকলেই ফিরে গেছে। স্লিপ থেকে নেমে দৌড়োতে থাকে বাবা মা যেখানে বসে ছিলেন সেই দিকে।
'ও মা! এখানে তো তারা নেই… তাহলে কি মা’রা চলে গেলো, আমাকে একলা ফেলে রেখে!'
কান্নাতে ভিজে উঠলো তার দুচোখ। বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকল সে, ভয়ে ভয়ে। রাস্তার আঁকে বাঁকে কুকুরদের জটলা থাকে সব সময়েই, খেয়োখেয়ী করে, স্কুটার- গাড়ির পেছনে দৌড়োতে থাকে পাগলের মত। কত রাত যে তার ঘুমহীন কাটে… কুকুরের চিৎকারে। মনে হয় তারা যেন মালিনীর ঘরেই ঢুকে পড়েছে। খুব রেগে যান মা।'তোমার এই কুকুর ভীতি দিনে দিনে সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাবু। দেখ্ গিয়ে তোর বয়েসী বাচ্চারা কুকুর নিয়ে খেলা করে, তাদের বারণ করলেও শোনে না। বোকার মত ভয় পেয়োনা।'
মাঝরাতে বালিশ চাদর নিয়ে মা'র ঘরে ঢুকতে গিয়ে বাধা পেয়েছে মালিনী... 'একদম না! তোমার এই ভয় আমি তাড়িয়েই ছাড়ব। যাও, নিজের ঘরে। সাহসী হতে হবে তোমাকে...'
বাড়ি পৌঁছে মালিনী দেখল দরজায় তালা। সে সিঁড়িতে বসে রইল।
'তাড়াতাড়ি এস মা, আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। সত্যি বলছি আজ আর আমি কোনও ঝামেলা করব না। যা দেবে চুপচাপ খেয়ে নেব… প্রমিস' সকালবেলায় ময়লাওয়ালা ময়লা নিতে এসে সিঁড়ির ওপরে কুকুর কুণ্ডলী অবস্থায় মালিনীকে দেখে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল...
'বেবি, তুমহী ইধারে কেনো সুয়ে আছে, কি হইলো?'
'আমার বাবা মা হারিয়ে গেছে, কাকু। বাড়িতে তালা, ভেতরে যেতে পারছি না। মনে হয় ওরা কিডন্যাপড হয়ে গেছে। মা মণি সেদিন একটা মুভি দেখছিল। পাজী লোকেরা একটা বাচ্চাকে কিডন্যাপ করে, ফোন করে টাকা চাইছে... আমি কি করে ওদের ফেরত আনব কাকু? আমার কাছে তো টাকা নেই!'
ময়লাওয়ালার কাছে তো এত সময় নেই যে সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করবে। সে বলে...
'তুমহার রিস্তেদারেরা সব কুথায় থাকেন?'
'আমি কিছু জানি না।'
'ফির আজু বাজুমে কিসিকে ঘরমে যাও। ইখানে বসে থাকবে না।'
মালিনী উঠে দাঁড়াল। আশেপাশের বাড়ির কাউকেই তো সে চেনে না। মা- বাবাকে কখনও কারো বাড়িতে যেতে দেখেনি সে, তাদের বাড়িতেও পড়শিরা কেউ কখনই আসে না। মা বাবার বন্ধুরা আসত, বাড়িতে বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে। বেশি আসত শর্মা আংকল। আংকল এসেই মালিনীকে ডাকত লুকোচুরি খেলার জন্যে। আংকল খালি খালি খাটের তলায়, দরজার পেছনে লুকিয়ে পড়ে, মালিনী তাকে খুঁজতে গেলেই আঙ্কল তাকে চেপে ধরে ব্যথা দেয়…
বলে, 'এটাই তো এই সিক্রেট খেলার মজা। তোমার আর আমার সিক্রেট, কাউকে বলবে না।'
মালিনীর চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকে, হিসি করতে খুব ব্যথা লাগে কিন্তু সে কোনদিন কাউকে কিচ্ছু বলেনি, মাকেও না... খুব ভয় করে তার।
পাশের বাড়ির কল বেলটা টিপতেই কুকুরের ডাক শোনা গেলো, কি জোর আওয়াজ। তক্ষুনি পালিয়ে যাওয়ার জন্যে তৈরি হলো সে, কিন্তু মায়ের কথাগুলো কানে বাজল তার…
‘তোমাকে সাহসী হতে হবে।'
দরজা খুললো একজন আংকল।
'কি ব্যাপার, কি চাই?'
'আংকল, আমি ওই বাড়িটায় থাকি। কালকে বাবা- মার সঙ্গে পার্কে গেছিলাম… আর ওদের খুঁজে পাচ্ছি না। বাড়িতেও তালা। একজন আন্টির মুখ দেখা গেলো আংকলের কাঁধের ওপরে।
'কে গো, কি চায়?'
'মিত্রদের মেয়ে… পালিয়েছে ব্যাটারা, মেয়েটাকে ফেলে রেখে।'
মালিনী কিছুই বুঝতে পারে না, আংকল কি বলছে।
'আয় আয়, ভেতরে আয়।'
আন্টি তাকে ভেতরে যেতে ব'লে আংকলের দিকে তাকিয়ে চোখ টেপে।
'কিছু খাসনি বোধহয়? আয় খাবি।'
চোখের জল মুছে মালিনী আন্টির দিকে তাকায়। বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ইতস্তত করে সে।
'আমি কুকুর ভয় পাই।'
আন্টি হেসে ওঠে। 'ভয় নেই, কুকুর বাঁধা আছে, আয়।'
আন্টি তাকে নিয়ে সোজা রান্না ঘরে যায়। তার হাতে দুটো শুকনো রুটি ধরিয়ে দিয়ে বলে 'নে, চটপট খেয়ে নে... তারপরে বাসনগুলো মেজে ফ্যাল।'
মালিনী একবার হাতের শুকনো রুটি দুটোর দিকে তাকায়, একবার ডাঁই করে রাখা আধোয়া বাসনের পাঁজার দিকে। চুপচাপ সে শুকনো রুটি চিবোতে থাকে। রাত থেকে কিছুই খায়নি সে।
কি রে, খাওয়া হলো? তাড়াতড়ি কর, বাসনগুলো ধুয়ে নে… আরও অনেক কাজ আছে।'
'আমি বাসন ধুতে জানি না আন্টি...'
'খেতে তো বেশ ভালোই পারো, সে তো কাউকে শিখিয়ে দিতে হয়নি… পারবি পারবি, আমি দেখিয়ে দেব, চল।'
কয়েকদিনের মধ্যেই মালিনীর বয়েস বেড়ে যায়। বাসন মাজার সাথে সাথে সে ঘর ঝাঁট- মোছা, কাপড় কাচা, সবজি কাটা, রুটি বেলা সব শিখে নেয়। আন্টির সাবধান বাণী তার কানে বাজে...'ভাল করে কাজ করবি নাহলেই বুঝেছিস তো! টমিকে ছেড়ে দেব তোর ওপরে।'
'না আন্টি প্লিজ, টমিকে ছেড়ো না...তুমি যা বলবে, করব।
'এই! এই! কি বানিয়েছিস এগুলো, আমার শ্রাদ্ধের পিন্ডি? একে রুটি বলে... তুই রুটি খাসনি কখনও? ও হো! তুমি তো আবার রাজকুমারী! শোন্, এখানে থাকতে হলে এইসব ন্যাকামি চলবে না। ছি ছি ছি! এই রুটি তো টমিও মুখে তুলবে না।'আন্টি দুম দুম করে রান্নাঘরে ঢুকে রুটিগুলো তার দিকে ছুঁড়ে দেয়। গ্যাস বার্ণারে বসানো গরম চাটুটা তুলে নিয়ে মালিনীর খালি পিঠের ওপরে চেপে ধরে। ককিয়ে কেঁদে ওঠে মেয়েটা। অনেক সময়েই তাকে খালি গায়ে থাকতে হয়, জামা তো একটাই… ধুয়ে দিলে আর পরার কিছুই থাকে না।
সেই থেকেই সে বন্ধ আছে টমির সাথে একই ঘরে।
মালিনী নিশ্চল মূর্তির মত বসে আছে, কুকুরটার দিকে চোখ রেখে। প্রচণ্ড জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে তার শরীর। পিঠে পোড়া ঘা। চোখ আর খুলে রাখতে পারে না সে, ঢলে পড়ে মাটিতে। হঠাৎ চোখ খুলে যায় তার। ভয়ে আধমরা হয়ে, আধখোলা চোখে সে দেখে টমি তার পিঠের ঘা'টা শুঁকছে, চাটার চেষ্টা করছে। সে ভগবানের কাছে মৃত্যু কামনা করে। মৃত্যু কি তা সে জানে না, কিন্তু লোককে বলতে শুনেছে… তাই ভাবে মৃত্যু বোধহয় মুক্তির কোনও পথ। আবার জ্ঞান হারিয়ে ফ্যালে প্রচণ্ড কষ্টে আবার জেগে ওঠে সে। টমি ঘুমোচ্ছে। শরীরের সমস্ত শক্তি যোগাড় করে সে কোনোরকমে উঠে দাঁড়ায়। অনেক চেষ্টায়, বিনা শব্দে একটা জানলা খুলতে পারে সে। দুটো হাত জানলা দিয়ে বার করে প্রাণপনে নাড়তে থাকে মালিনী, কেউ না কেউ নিশ্চয়ই দেখতে পাবে... তাকে বাঁচাতে আসবে। আওয়াজ করতে সাহস হয় না।
আর কিছুই মনে নেই মালিনীর…
তার জ্ঞান ফেরে একটা বড় ঘরে। ঘাড় ঘুরিয়ে সে দেখে পাশে পাশে অনেক খাট রাখা আছে… সব খাটেই কেউ না কেউ শুয়ে আছে। তাকে ঘিরে রেখেছে অনেক জন। ওই তো, পুলিস আংকলও আছে। তাহলে ওরা নিশ্চয়ই বাবা-মা'কে খুঁজে পেয়েছে... শান্তিতে আবার চোখ বন্ধ করে মালিনী।
...বাবার হাত ধরে স্কুলে যাচ্ছে সে। মা তাকে তৈরী করে দিয়েছে। গাড়ি থেকে নামার সময়ে বাবা তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়ে বলেন, 'খুব ভাল থেক আমার ছোট্ট রাজকুমারী।'
মালিনী বাবাকে আদর ক'রে বলে- 'তুমি ওয়ার্ল্ডের সব থেকে বেস্ট বাবা...'
'কেমন আছ সোনা?' মাথার ওপরে রাখা, স্নেহভরা হাত তাকে জাগিয়ে তোলে।
'আমার বাবা-মা'কে খুঁজে পেয়েছ?'
'পাবে, শিগগিরই পাবে। পুলিস আংকলরা খুঁজছেন।'
'আমাকে বাড়ি নিয়ে চল, আমার পিগি ব্যাঙ্ক থেকে আমি সব পয়সা বার করে দেব… বাবা-মা কে ফিরিয়ে আনার জন্য...'
'হ্যাঁ হ্যাঁ যাব তো, আমরা সব্বাই মিলে যাব। তুমি ভাল করে খেয়ে ঘুমিয়ে স্ট্রং হয়ে নাও… কিডন্যাপারদের সঙ্গে লড়াই করতে হবে তো...'
মালিনী হাসে, সে
আবার হারিয়ে যায় তার স্বপ্নের দুনিয়ায়''...ক্লারা ম্যাম, আমি তোমাকে খুব ভালবাসি। বাবা- মা ফিরে এলেই আমি আবার স্কুলে আসব। আমি প্রমিস করছি, আমি আর কিছুতেই ভয় পাব না...'
আজ দীপ্তি আন্টি এসেছে, মালিনীকে নিয়ে যেতে। কি সুন্দর নতুন জামা এনেছে আন্টি। হাসপাতালের সিস্টার আন্টিরা তাকে তৈরী করে দিয়েছে। মেট্রন আন্টি বলেছে, ওই আশ্রমে মালিনীর মত অনেক মেয়েরা থাকে… যাদের বাবা-মাম্মা হারিয়ে গেছে। সিস্টার আন্টিরা কত চকোলেট দিয়েছে তাকে, কত্ত আদর করেছে।
গাড়িটা আশ্রমের ভেতরে ঢুকতেই বাচ্চারা দৌড়ে এল। মালিনীর খুব ভাল লাগল আশ্রমটা দেখে। দীপ্তি আন্টি তাকে একজন বড় দিদির হাতে দিয়ে বলল, 'এখানে তুমি সবিতা দিদির সঙ্গেই থাকবে।' সবিতা দি তাকে নিয়ে গেল নিজের ঘরে। কাছেই কোথাও কুকুর ডেকে উঠল, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাদের ঘরে ঢুকে পড়ল একটা বিরাট বড় কুকুর। সবিতাদিকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে রইল মালিনী।
'আরে, এ তো ব্রুনো! ভীষণ সুইট ডগ। তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে এসেছে।'
আরও চেপে জড়িয়ে ধরে সবিতাকে, মালিনী। চোখ না খুলেই বলে, 'ওকে চলে যেতে বল দিদি… প্লিজ। আমি কুকুরকে খুব ভয় পাই।'
চোখের ইশারাতে ব্রুনোকে চলে যেতে বলে সবিতা।
'মালিনী, তোমাকে সাহসী হতে হবে, নাহলে এই নিষ্ঠুর পৃথিবী তোমাকে বাঁচতে দেবে না। কখনও কারুর সামনে নিজের ভয়ের কথা প্রকাশ করবে না...'
জোরে জোরে মাথা নাড়তে থাকে মালিনী।
'নিজের ওপরে বিশ্বাস রাখো, সাহস নিজে নিজেই এসে যাবে।'
আবার স্কুলে যেতে শুরু করেছে মালিনী। আশ্রমের সব কিছুই তার খুব ভাল লাগে, শুধু সে খুব ভয় পায় সুবোধ দাদা কে… রান্না ঘরের ইনচার্জ। সবার সঙ্গেই খুব খারাপ ব্যবহার করে সে। মালিনীকে দেখলেই যেন কামড়ে খেতে আসে। একদিন দুপুরে খাওয়ার সময়ের কিছু আগেই মালিনী পৌঁছে গেছিল খাওয়ার ঘরে। তখন কেউই ছিল না সেখানে।'ও হো, তুমি পৌঁছে গেছ, ছোট শয়তান! কত বড় পেট রে তোর, ক'বার খেতে হয় দিনে… তি ন বা র? মালিনী আর তাকিয়েও দেখেনি, দৌড়ে সেই যে পালিয়েছিল আর খেতেই আসেনি সেদিন দুপুরে।
অনেকদিন হয়ে গেল। মালিনী এখন ক্লাস এইট এ পড়ে। আশ্রম- স্কুলের বেস্ট স্টুডেন্ট সে, সকলেই তাকে খুব ভালবাসেন।
স্কুলের 'প্রতিষ্ঠা দিবস' উৎসবের প্রস্তুতি চলছে। যে কোনও উৎসব উপলক্ষ্যেই আসেন নামী দামী ব্যক্তিত্বেরা… শিল্পী, গায়ক, লেখক, সমাজসেবী। আশ্রমের মেয়েদের তাঁরা নানারকম উপহার দিয়ে যান… বই, জামাকাপড়, খাবার।
আশ্রমের সকলে মিলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে, অতিথি- বিনোদনে।
দীপ্তি আন্টি তো খুবই খুশি হয়েছেন। মালিনীর উপহারটা মালিনীর খুব পছন্দ হয়েছে।… কেমন সুন্দর ধবধবে সাদা ফ্রক আর তার সঙ্গে গাঢ় নীল রঙের সিল্কের স্কার্ফ।
আনন্দানুষ্ঠানের দিনে করুণ এক বিষাদের সুরও বেজে চলেছে। আশ্রমের পুরনো চৌকিদার দুবে ভাইয়াও অবসর নিয়ে দেশে চলে যাচ্ছে। তার জন্যে সকলে মিলে সুন্দর বিদায়ী অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিল। অনেক কাঁদল মালিনীও বাকি বাচ্চাদের সঙ্গে মিলে, দুবে ভাইয়ার জন্য।
নতুন চৌকিদার মারাঠে ভাইয়া বেশ কয়েকদিন আগেই এসে পৌঁছেছিল। কেন যেন মালিনীর ওকে একদমই পছন্দ হয়নি। তার ষষ্ঠেন্দ্রিয় বিরোধ করেছিল। আসা যাওয়ার পথে যতবার তাদের দেখা হয়েছে তাদের, ধাক্কা লেগেছে... আর মালিনীর মনে হয়েছিল, এই ধাক্কা লাগাটা মারাঠের ইচ্ছাকৃত। সব থেকে বড় ভয় হল মালিনীর, যখন সে দেখল, মারাঠের সঙ্গে ব্রুনোর খুব ভাব হয়ে গেছে। কুকুরটা তার কথায় ওঠে বসে।
মালিনী পরিণত হয়েছে এক খুবই দায়িত্বশীল আর পরোপকারী কিশোরীতে কিন্তু এখনও সে তার কুকুর-ভীতি দূর করে উঠতে পারেনি, এতদিন কাছে কাছে থেকেও ভালবাসতে পারেনি ব্রুনো কে। সে মারাঠে ভাইয়া আর তার পরম বশংবদ ব্রুনোর থেকে দূরে দূরে থাকারই চেষ্টা করে চলে সব সময়। একদিন সে খেয়ে বেরোবার সময়ে দেখল ব্রুনো বসে আছে ঠিক দরজার সামনে। মালিনীর পা দুটো যেন মাটিতে গেঁথে গেল। চৌকিদার ভাইয়া মারাঠেও খাবার ঘরের দিকে আসছিল, মালিনীর অবস্থা দেখে তার চোখ দুটো চক চক করে উঠল... 'কী ভয় লাগে ব্রুনোকে? বাহ বাহ বেশ বেশ।' ব্রুনোকে নিয়ে সে আনন্দে শিস দিতে দিতে চলে গেল। মালিনী হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
দীপ্তি আন্টিকে বিশেষ দেখা যায় না আজকাল, আশ্রমে... তিনি খুবই ব্যস্ত থাকেন নানারকম কাজকর্ম নিয়ে। সবিতাদি স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে, আশ্রম-স্কুলের শিক্ষিকা হয়েছে। সে আর মালিনীর সঙ্গে থাকে না। মালিনীর সঙ্গে এখন থাকে ৯ বছরের একটা ছোট মেয়ে। সকলে বলে ওর বাবা- মা ওকে ফেলে চলে গেছে। 'ফেলে চলে যাওয়া' টা আর মালিনীর কাছে কোনও নতুন কথা নয়। এই আশ্রমের বেশির ভাগ বাচ্চারই কপালে এই দুর্ভোগ জুটেছে। মাঝে মাঝেই অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ে সে। তার বাবা- মার কথা মনে পড়ে তার। কোথায় আছেন তাঁরা, ভাল আছেন তো! মালিনীর কথা কি তাঁদের মনে পড়ে? তাঁরা কেন মালিনী কে ছেড়ে চলে গেলেন, না কী তাঁদের কোনও বিপদ হল...
বছরের সবথেকে বড় অনুষ্ঠান স্বাধীনতা দিবসের প্রস্তুতি দরজায় কড়া নাড়ছে। মালিনীর ওপরেই দায়িত্ব দিয়েছেন দীপ্তি আন্টি, অনুষ্ঠানটি সুষ্ঠু ভাবে আয়োজন করার। আশ্রম-স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে, দিন রাত এক করে অনুষ্ঠানটি সর্বাঙ্গ সুন্দর করে তুলল, মালিনী। এইমাত্র অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে। বাচ্চারা নিজেদের সবথেকে সুন্দর পোষাক পরে স্কুল চত্তরে প্রজাপতির মত উড়ে বেড়াচ্ছে। মালিনী পরেছে সাদা ফ্রক আর তার সাথে গলায় জড়িয়েছে নীল স্কার্ফ। আজ অনেক বিখ্যাত মানুষেরা এসেছিলেন। সবাইকে কত সুন্দর সুন্দর প্রাইজ দিয়ে গেলেন। মালিনী পেল একটা সুন্দর স্লিং ব্যাগ। আরও ১০০ টাকা পুরস্কার পেয়েছে সে… চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির আবৃত্তি করে।
মেঘ করে আকাশ কালো হয়ে এসেছে, বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে। এখনো অনেক কাজ বাকি রয়েছে। অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত আসবাবপত্র গুলো স্টোর রুম এ রেখে আসতে হবে। তার আদরের বানর সেনা তার সঙ্গেই ঘুর ঘুর করছে। ছোট খাট জিনিস গুলো রাখা হয়ে গেছে, একটা বড় চেয়ারকে সিংহাসন বানানো হয়েছিল, সেটাই তোলা বাকি। ছোটদের যার যার ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে চেয়ারটা নিয়ে মালিনী এগোল স্টোর রুমের দিকে। আগে সে ভালো করে দেখে নিল ব্রুনো কাছাকাছি আছ কী না! স্টোর রুমের কাছাকাছি পৌঁছোতেই হঠাৎ ঝুপ করে আলো নিভে গেল। মালিনীর শরীর আড়ষ্ট হয়ে গেল কী যেন এক অজানা আশঙ্কায়। দুটো বলিষ্ঠ হাত তার মুখ চেপে ধরে তাকে শূন্যে তুলে নিল। মালিনীর হাত ছেড়ে সজোরে মাটিতে আছড়ে পড়ল, চেয়ারটা। মালিনী নিজেকে ছাড়াবার জন্যে প্রাণপন চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু সবই নিষ্ফল... চেনা গন্ধটা পেয়ে মালিনী বুঝতে পারল যে তারা স্টোর রুমে রয়েছে। তাকে চেপে ধরে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছে সেই শক্ত সমর্থ দুটো হাত। মুখে ভরে দিয়েছে কিছু কাপড়ের টুকরো তার মুখ থেকে গোঁ গোঁ ছাড়া কোনও আওয়াজ বেরচ্ছে না। অন্ধকারে দুটো জ্বলন্ত চোখ আর ভারী শ্বাসের আওয়াজ মালিনীকে ব্রুনোর উপস্থিতি সম্মন্ধে ওয়াকিবহাল করে দিল। কানে নানারকম টুকরো টুকরো শব্দ বাজতে লাগল…
সাহসী হতে হবে তোমাকে…
কাউকে জানতে দিও না কখনও, তুমি ভয় পাও… তোমার শক্তি তোমার ভেতরেই আছে…
অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে কখনও ইতস্তত করবে না...
শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে জোরালো এক লাথিতে তার ওপরে ঝুঁকে থাকা শরীরটাকে ছুঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াল মালিনী। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘরটা ভেসে গেল আলোয়। মুখে গোঁজা কাপড়ের টুকরো গুলো বের করে তৈরি হল মালিনী। টেবিলের ওপরে রাখা ছুরিটার দিকে নজর গেল তার… এই ছুরিটাই তারা স্টেজ সাজানোর সময়ে ব্যবহার করেছিল। এক লাফে টেবিলের কাছে গিয়ে ছুরিটা তুলে নিল মালিনী। ততক্ষণে মারাঠে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। মালিনী ঘুরে দাঁড়িয়ে, তার মুখোমুখি হয়ে চাপা হিসহিসে গলায় বলল, 'একপাও এগিও না, আমি তোমাকে খুন করে ফেলব।'
বিকৃত হেসে মারাঠে শিস দিয়ে ব্রুনোকে মালিনীর ওপরে ঝাঁপানোর ইঙ্গিত করল। ব্রুনো কাছে এগিয়ে আসতেই, মালিনী তার শরীরে ছুরিটা ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল… কিন্তু ব্রুনো এক লাফে যেন উড়ে গিয়ে পড়ল মারাঠের ওপরে। মালিনীর ছুরিটা লাগল ব্রুনোর পায়ে… রক্তে ভেসে গেল স্টোর রুমের মেঝে। মারাঠের আর্তনাদ শুনে মালিনী তাকিয়ে দেখল, ব্রুনো কামড়ে ধরেছে মারাঠের হাত।
'হে ভগবান! এ আমি কী করলাম। ব্রুনো তো আমাকেই বাঁচাতে চেয়েছিল, আমি বুঝতেই পারিনি।
'ওহ হো, মারাঠে! তাহলে এইসব কুকীর্তি তোমারই।'
সুবোধের গলা গম গম করে উঠল। মালিনী আহত ব্রুনোর গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল। সুবোধ হাত নেড়ে তাকে বাইরে যেতে বলল।
'আমি ওর ব্যবস্থা করছি।'
ব্রুনোর চোখ দুটো বন্ধ ছিল, তার পা থেকে রক্ত ঝরছিল। ব্রুনোর মাথায় একটা চুমু দিয়ে মালিনী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ব্রুনোকে আমি মেরে ফেললাম, আমি আর এই আশ্রমে থাকতে পারব না। আশ্রমের গেট থেকে বেরিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারে দৌড়োতে লাগল সে। প্রাইজ পাওয়া স্লিং ব্যাগটা তার গলা থেকে ঝুলছিল, হাত দিয়ে একবার দেখে নিল মালিনী।
আলো ঝলমলে বাজারে এসে পৌঁছল মালিনী। মুখ তুলে দেখল সে দাঁড়িয়ে আছে 'ক্যাফে কফি ডে' র সামনে। মা-বাবার সঙ্গে কতবার এসেছে সে কফিশপে… কিন্তু মা কখনও তাকে কফি খেতে দেননি।
গলা থেকে স্কার্ফটা খুলে নিজের রক্ত মাখা হাত দুটো মুছে নিল মালিনী। রক্তমাখা ছুরিটা তখনও তার হাতেই ধরা ছিল। স্কার্ফের মধ্যে মুড়ে নিল সে ছুরিটা। কাঁপতে থাকা হাত পা গুলোকে শান্ত করে সে ঢুকে পড়ল কফির দোকানে।
আজ মালিনী সত্যিই বড় হয়ে গেছে। আজ থেকে নিজের খেয়াল সে নিজেই রাখতে পারবে। সব ভয়কে জয় করে ফেলেছে সে। কফির দাম মিটিয়ে উঠে পড়ল মালিনী… আশ্রমে ফিরে ব্রুনোর শুশ্রূষা করে তাকে সারিয়ে তুলতে হবে।