ভুল সংশোধন
ভুল সংশোধন
আজ সকাল থেকে মেজাজ খারাপ হয়ে আছে নেহার। বাবা আর মা, এই দুজনে মিলে ওর জীবনটা পুরো নষ্ট করে দিলো।
মাত্র পাঁচশো টাকাই তো চেয়েছিল! টাকাটা তো দিলোই না; উল্টে নিজের ফূর্তির টাকা নিজেকেই জোগাড় করে নেওয়ার জন্য ফালতু খানিকটা জ্ঞান দিয়ে ছাড়ল।
পিহু চেন্নাইতে পড়তে চলে যাচ্ছে বলে আজ ওদের বন্ধুদের একটা কফিশপে পিহুকে খাওয়ানোর আর কিছু উপহার কিনে দেওয়ার কথা ছিলো। সবাই মিলে ঠিক করেছিল যে, প্রত্যেকে পাঁচশো টাকা করে দেবে। এদিকে নেহার হাড় কৃপণ বাবা এক পয়সাও ঠেকালোনা। যদি এমন কৃপণতাই করতে হয় তবে ওকে ভালো স্কুল-কলেজে পড়ানোর দরকারটাই বা কি ছিলো!
বন্ধুদের জন্মদিন বা অন্য কোনো খরচের কথা শুনলেই এরা দুজন এমন করে। এতোদিন গাঁইগুঁই করে টাকাটা দিয়েই দিতো, এবারে তো দিলোইনা।
টাকাটা নিয়ে না গেলে বন্ধুদের সামনে নেহা মুখ দেখাতেই পারবেনা সেটাও এরা বুঝলোনা। খানিকক্ষণ নিজের ঘরে চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে মাথায় বুদ্ধিটা এলো। মা যখন রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত...তখন আলমারি খুলে সংসার খরচের টাকা থেকে পাঁচশো টাকা সরিয়ে নিয়ে কলেজে চলে গেলো নেহা।
ক্লাস শেষ হবার পরে সবাই মিলে তিনজন বন্ধুর গাড়িতে চেপে রাজারহাটের নতুন তৈরী হওয়া মলের দিকে রওয়ানা দিলো। ও সোহমের গাড়িতে সামনের সিটে বসেছিলো। হঠাৎ মানিকতলা মোড়ের কাছে ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়িটা থামতেই একটা অতি পরিচিত সাদা-কালো চেক শার্টের দিকে নজর পড়লো। এটা কি সত্যি দেখছে? ভালো করে তাকিয়ে নেহার চোখ বড় বড় হয়ে নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠলো। সোহম ওর অস্হিরতা লক্ষ্য করে বলে উঠলো, "কী হয়েছে রে নেহা, তোকে অস্হির লাগছে কেন?" নেহা চোখ না সরিয়েই বললো, "আমার খুব জরুরী একটা কাজ মনে পড়ে গেছে রে, এখানেই নামবো।"
পেছন থেকে বিতান, শুভা, রিনি হইহই করে উঠে ওকে নামতে বারন করলেও তা কানে না নিয়ে নিজের ব্যাগটা
আঁকড়ে ধরে নেমে পড়ল নেহা।
দ্রুত রাস্তা পার হয়ে ফুটপাতে উঠতেই সিগন্যাল খুলে গেল আর সব গাড়ি একসাথে গর্জন করে বন্য জন্তুর মতো ছুটতে শুরু করে দিল।
সাদা-কালো চেকশার্ট পরা চেহারা অন্য দুজন মানুষের সাথে ততক্ষণে একটা ভারি বস্তা নিয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে। নেহা তার পেছন পেছন চলতে চলতে গিয়ে একটা লোহা লক্করের দোকানের কাছে পৌঁছে গেল। দেখলো, ওর চোখ ফোটার সময় থেকে দেখা অতি পরিচিত চেহারার ওর বাবা দোকানে ঢুকে যাচ্ছে। ও অস্ফুটে ডাকল, "বাবা!" সেই নুয়ে পড়া চেহারা ফিরে তাকিয়ে প্রথমটায় হকচকিয়ে গিয়ে তারপর জোর করে মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে বলে উঠলো, "তুই এখানে?"
নেহা বললো, "একটা কাজে এদিকে এসেছিলাম বাবা, তুমি লরি থেকে এসব বস্তা নামাচ্ছো কেন বুঝতে পারলামনা। অফিসে যাওনি?"
বাবা মাথাটা নামিয়ে নিয়ে বললেন, "বাইরে গিয়ে দাঁড়া, আমি আসছি।" তার প্রায় মিনিট পাঁচেক পরে এসে সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, "আমার সুপারভাইজারের চাকরিটা মাস দুয়েক হলো চলে গেছে রে মা। এই বয়সে কোনো বিশেষ শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলে চাকরি পাওয়া কতটা কঠিন সে তো জানিস। এক পরিচিত মানুষের দয়ায় এই চাকরিটা পেয়েছি। লরি থেকে মাল গোডাউনে আনা আর হিসেব করে মালপত্র ছাড়া, এই কাজ আমার। জানি তোর প্রত্যাশা পূরণ করতে আমি বরাবরই অক্ষম, তাও চেষ্টা করছি তোর পড়াশোনাটা ঠিকমতো চালানোর জন্য। আমায় ক্ষমা করে দিস মা।"
নেহা বিড়বিড় করে বলে উঠলো, "তুমি আমায় ক্ষমা করে দাও বাবা।" বলে নিজের মনে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
বাড়ি ফিরে আগে মায়ের আলমারিতে পাঁচশোটাকার নোটটা রেখে দিলো। তারপর চুপচাপ বসে নিজের মনে সঙ্কল্প করল যে ওকে কিছু টিউশনি জোগাড় করতেই হবে। আর পড়াশোনার দিকে মন দিতে হবে। একটা চাকরি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জোটাতেই হবে। এতোদিন যা ভুল করে এসেছে তা সংশোধন করতেই হবে।