দুর্ঘটনা
দুর্ঘটনা
ঘর থেকে বেরোনোর মুখে আরো একবার আয়নায় নিজেকে দেখে নিল রুমি। গোলাপি শাড়ির সাথে ম্যাচিং টিপ, লিপস্টিক, আইশ্যাডো আর মুক্তোর হার-দুলে ওকে মোহময়ী লাগছে। আগেরবছর প্যারিস থেকে কেনা সাদা চামড়ার ব্যাগটা নিয়ে লঘু পায়ে ফ্ল্যাটের দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। আজকের দিনটা ওর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেভাবে হোক মিঃ আহুজাকে নিজের বশে নিয়ে আসতেই হবে। মেঘা রায় ওই হাতির মত চেহারা নিয়ে এইচ.আর. হেডের পজিশনটা ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে তা হতে দেওয়া যায়না।
রুমি ছোট থেকেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী। নিজের বুদ্ধি আর সৌন্দর্য্য কাজে লাগিয়ে একের পর এক বাধা পায়ের তলায় পিষে দিয়ে এগিয়ে চলেছে। এবার মেঘার কেরিয়ার শেষ করার লক্ষ্যের দিকে চলেছে। সফল হতেই হবে।
গাড়িতে ওঠার মুখেই শান্তনুর ফোন। বিরক্ত চোখে ফোনের দিকে তাকিয়ে একবার ভাবল ফোনটা কেটে দিয়ে সাইলেন্ট করে দেয়, পরক্ষণেই আবার আহুজার ফোন আসতে পারে বলে ফোনটা সাইলেন্ট করা যাবেনা এটাও মনে হল। এখন যদি শান্তনুর ফোন না ধরে তবে গাড়ি চালানোর সময় ফোন করে করে মাথা খারাপ করে দেবে। এইসব ভাবনা চিন্তার মধ্যেই ফোনটা বেজে বেজে কেটে গেল। সঙ্গে সঙ্গে শান্তনুর ফোনে ফোন করতেই ফোন ধরে শিশুর মত উচ্ছ্বসিত স্বরে শান্তনু বলে উঠল, "দুপুর বারোটার শোয়ে সাউথ সিটির আইনক্সে মুভির টিকিট কেটেছি। আমি আর পনের মিনিটের মধ্যে আসছি, রেডি হয়ে থেক। রুমি কাটাকাটা স্বরে বলল, "অত্যন্ত দুঃখিত গো। আমার জরুরী মিটিং আছে। এখনই বেরোচ্ছি।" শান্তনু একটু স্তিমিত স্বরে বলল, "আজ তো শনিবার, তোমার অফিস ছুটি।" "অফিস ছুটি থাকলেও মিটিং থাকতে পারে। আমার ফিরতে রাত হবে। তুমি সময় মত খাবার গরম করে খেয়ে নিও। এখন আমি গাড়ি চালাব; আর ফোন কোরোনা।" বলে ফোন রেখে দিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিল রুমি।
শান্তনুকে বিয়ে করাটাই রুমির জীবনের একমাত্র ভুল। যখন বিয়ে
করেছিল তখন একটা বড় পজিশনে চাকরি করত। স্বাধীন ভাবে ব্যবসা করার জন্য হঠাৎ করেই রুমিকে না বলে চাকরি ছাড়ল। এখন সারাদিন ধরে ব্যবসা নিয়েই থাকে। তেমন একটা লাভ করছে বলে মনে হয়না। রুমির যেটা সবথেকে খারাপ লাগে সেটা হল শান্তনুর পাপ-পূণ্য বোধ। সর্বক্ষণ নৈতিকতার ধ্বজা ওড়ায়। আরো একটা খারাপ ব্যাপার হল, রুমির প্রতি অত্যন্ত যত্ন আর ভালোবাসা। এসব রুমির চূড়ান্ত অপছন্দ। ও শুধুমাত্র ক্ষমতার দম্ভ চায়। এমন পুরুষ মানুষ একদম ভালো লাগেনা।
বহু প্ল্যান করে আহুজাকে ডায়মন্ড হারবারের কাছের রিসর্টে ডেকেছে রুমি, সেখানে না গিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়ার প্রয়োজনই নেই।
ডায়মন্ডহারবার রোডে পড়তেই ট্র্যাফিকের জন্য গাড়ির গতি শ্লথ হয়ে যেতে মেজাজ বিগড়ে গেল। আহুজা হয়ত এতক্ষণে রিসর্টে পৌঁছেই গেছে! জোকার কাছাকাছি হতে গাড়ির গতি বাড়িয়ে একশো করে দিল রুমি। পৈলানের কাছে আসতেই গাড়ির সামনে একটা বাস হঠাৎ ব্রেক কষতেই গিয়ে বাসের পেছনে জোরে ধাক্কা মারল রুমির মারুতি সুইফট গাড়ি।
যখন জ্ঞান ফিরল তখন নিজেকে চারদিকে নল লাগানো অবস্হায় হাসপালের বেডে আবিষ্কার করল রুমি। পা দুটো অবশ লাগছে আর সারা শরীরে যন্ত্রণা। জ্ঞান ফিরতেই একজন নার্স শান্তনুকে ডেকে আনল। শান্তনুকে দেখে মনে হচ্ছিল যে ওর ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে।
শান্তনু শুধু বলল, "তুমি পৈলানে কেন যাচ্ছিলে আর তোমার কিসের তাড়া ছিল কিছুই জানতে চাইনা। শুধুমাত্র তোমার দ্রুত আরগ্য কামনা করি। আমি তোমার সাথেই আছি।" বলে চোখ মুছে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে।
শান্তনু সত্যিই কথা রেখেছে। হাসপাতাল থেকে একটা পা বাদ দিয়ে ফিরে আসা রুমির আদর যত্নের কোনো ত্রুটি রাখেনি। আদর ভালবাসায় ভরিয়ে রেখেছে।
একটা দুর্ঘটনা রুমির একটা পা নিয়ে নিলেও ভালোবাসার গুরুত্ব বুঝতে শিখিয়ে দিয়েছে।