বাজিকরের খেলা
বাজিকরের খেলা


।। এসো আমার আগমনী ।।
ধূলি ধূসরিত ক্লেদাক্ত বিগত দিনগুলির যবনিকাপাতে মনে বেজে উঠছে শিশিরসিক্তা শুভ্রা শিউলি সুবাসিত শারদসুন্দরীর আগমনী সুর। আমনধানের ঢেউ খেলানো সবুজ খেতে ফোঁটা ফোঁটা শিশির গায়ে মেখে মাথা দুলিয়ে উঁকি দিচ্ছে পূর্ণগর্ভা ধানের শিষ। টলটলে দীঘি সাদা গোলাপী শাপলা-শালুক বুকে নিয়ে যেন অগণিত তারাখচিত সাদা মেঘের ভেলায় ভাসা স্বচ্ছ নীলাকাশ। ধবধবে সাদা সারিবদ্ধ উড়ন্ত বলাকা স্নিগ্ধ সকালকে ধাবমান করছে দৈনন্দিনতার কর্মব্যস্ততায়।নদীপাড়ের কাশের বন উথাল-পাথাল করে ছুটছে এক গিরগিটি দম্পতি। টোকা মাথায় খালুই হাতে মিহি ফাঁসের খ্যাপলা জাল কাঁধে মৎস্যজীবির দিকে অপলক চেয়ে একপায়ে খাড়া মেটেরঙা মেছোবকটা। দূরে কোথাও থেকে একটানা খটাখট মাকুর আওয়াজ ঢালারঙের কোনও শাড়ির পাড়-আঁচল-জমিন জুড়ে অবিরাম বুনে চলেছে লতায় পাতায় ফুলকারীর নকশা। সাত বছরের দিদির হাত ধরে পাঁচ বছরের ভাই বই বগলে ইস্কুলমুখী আর তাদের বাবা দুধের ক্যান আর ছানার পুঁটলি নিয়ে সাইকেলের ঘন্টি বাজিয়ে শহরমুখী। পানিফল আর শালুক আঁটি বোঝাই ঝুড়ি বাঁকে চাপিয়ে ব্যাপারী হনহনিয়ে হাটের পথে। সদ্যোজাত নাদুস-নুদুস বাহারী তিন শাবককে খাইয়ে-দাইয়ে চেটে সাফ করতে ব্যস্ত কুচকুচে কালো তরুণী মা শারমেয়টি। স্বর্ণাভ পিতলের কলসী কাঁখে একহাত ঘোমটা টানা গৃহবধূর পাশ কাটিয়ে পথচলতি বাউলের একতারার টুংটাং আর উদাত্ত সুরেলা গলায়, "যাও যাও গিরি,আনিতে উমায় ...!" সম্বৎসর অপেক্ষার অবসান!
এই পর্যন্ত লিখে থামলেন বিদেশদা। প্রবন্ধটা "জাগরূক" দৈনিকের রবিবাসরীয় পাতার জন্য..... "গ্রাম বাংলার শারদোৎসব"কে কেন্দ্রীয় বিষয় করে। বিদেশদা অর্থাৎ বিদেশ সরকার। পেশায় সাংবাদিক, কন্টেন্ট রাইটার, ফ্রিল্যান্সার। নিজের খেয়ালে নিজে চলেন, শৌখিন নন তবে খুব রুচিবান গোছানো স্বভাবের হলেও এক দুর্বলতম শখের কোণ আছে মনে.......ইনভেস্টিগেটিং জার্নালিজম এবং তার জন্য মাঝে মধ্যে শখের গোয়েন্দাগিরির তকমাও জুটে যায়। মানুষটি অকৃতদার এবং এখনও যৌথ পরিবারের বাসিন্দা। বিদেশদার পেশাগত দক্ষতার সম্বন্ধে কোনো কথা হবে না, অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে সাংবাদিকতা করেন বেশ অনেকগুলি নামী-দামী-কমদামী-অনামী দৈনিক-পাক্ষিক-মাসিক নানান রকম পত্র পত্রিকায়, আর নিয়মিত লেখালেখিও করে আসছেন দীর্ঘ বছর। বয়স শেষ ত্রিশের কোঠায়, লম্বা শ্যামলা দোহারা গড়ন, মাথায় পাতলা হয়ে আসা চুল আর ঈষৎ চৌকোণা চোয়াল চিবুকের মুখখানা দেখলে প্রথম দর্শনে বিদেশদাকে ভারী রাশভারী কঠিন ধাতের রাগী রাগী দেখায়। কিন্তু যারা বিদেশদার কাছের মানুষ তারা জানে আদতে বিদেশদা একজন রসে টইটম্বুর আদ্যোপান্ত পরোপকারী অমায়িক ভালো মানুষ।
সবকটি কাগজের অফিসেই বিদেশদার যথেষ্ট জনপ্রিয়তা এবং সব জায়গাতেই তার সামনে পেছনে সর্বত্রই সবাই তাকে নারকোলের সাথে তুলনা করে থাকে। আর এই উপমাটিই বিদেশদা বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন। বিদেশদার আরও একটা প্যাশন বা দুর্বলতা যাই বলা হোক, তা হোলো সারা বাংলা ঘুরে ঘুরে নানান ধরনের একেলে সেকেলে আধুনিক পুরনো রকমারি মিষ্টির সন্ধান করা। নিজে সেগুলো গান্ডেপিন্ডে খাওয়া এবং চেনা পরিচিত মহলে লোক-জনকে খাওয়ানো। খাদ্য রসিক, ভোজন প্রিয়, এবং খাদ্য বৎসল উপাধি-ভূষিত এবং পরিচিত-আধা পরিচিত গন্ডীতে বিদেশদা প্রায় একেবারে সেলেব্রিটি মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত। আসলে হাজার হোক বাঙালী, এবং বাঙালী পুরুষের ভোজন প্রীতি সর্বজন সুবিদিত।
লেখাটা থামিয়ে বিদেশদা ভাবতে বসলেন অনেক দিন গ্রামে গঞ্জে ঘোরার সময় করে উঠতে পারছেন না, কিন্তু মনটা ফুড়ুৎ ফাড়ুৎ ইতিউতি উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। "নাহ্, আজ এবেলা আর লেখা হবে না," লগ আউট করে ল্যাপটপ চার্জে বসিয়ে নিজের অপরিসর ঘরের লাগোয়া তেরছা বারান্দাটায় গিয়ে দাঁড়ালেন। শহর কোলকাতার দক্ষিণে তাঁর পাড়ার পুজোর প্যান্ডেলের বাঁশ পড়ছে গলির মুখ থেকে বাঁক ঘুরেই, মাস দেড়েক বাকি পুজোর, সারা শহর জুড়ে...... উত্তর থেকে দক্ষিণ প্রতিটি পাড়ায় ব্যস্ততা এখন তুঙ্গে। কর্মকর্তাদের নাভিশ্বাস তুলে "তিনি আসছেন সপরিবারে।" বছর ঘুরে গেছে কখন! বাঁশ ফেলার খটাখট আওয়াজ জানান দিচ্ছে আরো একবছর বয়স বেড়েছে। নিজের ভাবনায় নিজেই হেসে লম্বা শ্বাস নিয়ে বিদেশদা একটা সিগারেট ধরালেন। প্রথম ধোঁয়ার রিংটার দিকে তাকিয়ে বিদেশদা দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পরে একটু কাছেপিঠে ঘুরে আসবেন ঠিক করলেন। কয়েক ঘন্টার জন্য এবং নিছকই অকাজে। মাথার জ্যামটা ছাড়বে না একটুও ভালোমন্দ মিষ্টি-টিষ্টি না খেলে।
বিদেশদা এবং ওনার ভাই স্বদেশ, স্কুল কলেজে ভারী রসিকতার শিকার হতেন। নাম আর পদবীর বিচিত্র মেলবন্ধনে। বিদেশ সরকার এবং স্বদেশ সরকার। মনে পড়তেই একাএকাই হেসে ফেললেন আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে। নাহ্, সত্যিই মাথার জটটা ছাড়াতে অন্তত একটা বেলার একটা ছোট্ট ব্রেক তাঁর চাইই চাই।
ছোট একটা স্লিংব্যাগে ছোট একটা নোটপ্যাড, ট্যাব আর সিগারেট-লাইটার ঢুকিয়ে বেরিয়ে পড়লেন দেড়টা নাগাদ। পরনে খাদির পাঞ্জাবি, জিন্স আর পায়ে কিটো। এক্কেবারে অকাজে যাবারই সাজ, সানগ্লাসটা খুলে আকাশটা একবার দেখে নিলেন উবেরে ওঠার আগে। ঝকঝকে নীল আকাশের দিগন্ত রেখায় কালো মেঘের আভাস বলেই তো মনে হোলো। যাই হোক, একে ঝাড়া হাত-পা তায় আবার সাংবাদিক মানুষ। পিছু হঠাটা ঠিক ধাতে নেই, উবের ছুটছে।গন্তব্য শিয়ালদা স্টেশন।
ইলেকট্রনিক্স বোর্ডে দেখাচ্ছে দুটোর লালগোলা প্যাসেঞ্জার আট নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে। বিদেশদা ট্রেনের মাঝবরাবর পেটে সেঁধিয়ে গুছিয়ে জানালার ধারে বসলেন। একে ছুটির দিনের দুপুর তার ওপর ট্রেনটি গ্যালপিং। তাই মারকাটারি মৌচাক মার্কা ভিড়টা নেই। কাজের সুবাদে এত বেশী রকম গাড়ি করে ঘোরাঘুরি হয় যে সুযোগ পেলেই বিদেশদা জীবনে এমন ছকভাঙা পরিবর্তন এনে ঘুরে বেড়ান লোকাল প্যাসেঞ্জার ট্রেনে চেপে এধার ওধার। বিদেশদার আরও একটি জীবন দর্শন হোলো.... সর্বক্ষণ টাকার পিছনে ছোটার কোনো মানেই হয় না। ভদ্রস্থ একটি রোজগার হলেই যথেষ্ট, বাড়তির প্রয়োজনও নেই বিদেশদার।
ট্রেনটি বেশ গতি নিয়ে চলছে, হুহু করে ছুটছে ট্রেন আর হুসহুস করে পেছনে চলে যাচ্ছে একটা একটা করে স্টেশন, সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে দৃশ্যপট, রুক্ষ কর্কশ শহুরে দৃশ্যাবলী শেষে শুরু হয়েছে দিগন্ত বিস্তৃত শ্যামলিমার আভাস। মাঝে দু-একটা স্টেশনে ট্রেন থেমেছে। যাত্রী ওঠানামাও হয়েছে, তারপর ট্রেন আবার ছুটতে শুরু করেছে গন্তব্য অভিমুখে।
আকাশে মেঘ আরও একটু ঘন হয়েছে......
শিশিরবিন্দু আকারের বৃষ্টি ঢুকে আসছে সোঁদা গন্ধ মেখে ঝিরঝিরিয়ে চলন্ত ট্রেনের জানালার শিকের ফাঁক গলে। বৃষ্টির ঐ শীতল পরশটা বিদেশদার খুব ভালো লাগছে। আর ভালো লাগছে একতারা আর মঞ্জীরার মিশ্রণে জড়ানো ভীষণ মিষ্টি সুরেলা এক নারীকন্ঠে....."ও সে কখন আসে, কখন যে যায় কে জানে ........."। ভারী সুন্দর সুমিষ্ট গলার অধিকারিণীকে দেখার অদম্য ইচ্ছা নিয়ে বিদেশদা কামরার প্যাসেজের দিকে চোখ ফেরালেন, কাউকে দেখতে পেলেন না বটে তবে গান তখনো থামে নি।
গোটা কামরা যেন ঐ সুরের মায়াজালে বিভোর।
বিদেশদার চমক ভাঙলো পাশ থেকে আসা এক পুরুষকন্ঠে, "কই গ গোঁসাই, কৃষ্ণপদে....." শীর্ণ হাতখানা বিদেশদার সামনে মেলে ধরা। বিদেশদা মানুষটির আপাদমস্তক জরিপ করে শতচ্ছিন্ন এক আলখাল্লা আর গেরুয়া ছোপানো ধুতিকে লুঙ্গির ছাঁদে পরা আর মলিন একখানা গামছা মাথায় পাগড়ি করে বাঁধা বৃদ্ধ অন্ধ মানুষটির হাতে একটি একশো টাকার কড়কড়ে নোট গুঁজে দিলেন। বৃদ্ধ মানুষটি হতচকিত বিদেশদার হাতের স্পর্শে, নিজের দু'হাত কপালে ঠেকিয়ে দুহাতের স্পর্শে টাকাটির দৈর্ঘ্য মাপতে থাকলো কিছুক্ষণ ধরে, তারপর নোট ধরা হাতটি বাড়িয়ে বললো, "না গ গোঁসাই, এত্তো বড় নোটের ভাঙতি আমোগো কাছে নাই গ, এ আপনে ফিরাই ন্যান গ।, খুইচরা না থাইকলে থাইক অখনে..... কৃষ্ণ পদে, কৃষ্ণ পদে!" বিদেশদা উঠে দাঁড়িয়ে মানুষটির হাত দুটি নিজের হাতে ধরে হেসে বললেন, "এটি আপনার কৃষ্ণ সেবায় লাগুক আর আমি কিন্তু গোঁসাই নই, মাছ-মাংস-ভাত খাওয়া পাপী তাপী, এক্কেবারেই সাধারন মানুষ।" মানুষটি দু'হাত জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে জানালো, "আমি হইলাম গিয়া ছিরি গোকুলদাস বাউল আর......." বলে থেমে ডাকলো, "অ নিত্যি, নিত্যি, এইহ্যানে আয়!" "আসি গো, আসি...." গলাটা চিনেছেন বিদেশদা, এই তো সেই কিছু আগের গান গাওয়া নারীকন্ঠ!
ট্রেন ঢুকছে কৃষ্ণনগর সিটি জংশন স্টেশনে।
নামার যাত্রী সংখ্যা অনেক, তবে ওঠার জন্য যাত্রী সংখ্যা আরও অনেক বেশী। কাজেই খানিক ঠেলাঠেলি ট্রেনের সরু প্যাসেজ জুড়ে। ট্রেন থেমেছে, বিদেশদা নেমে পড়েছেন, আর তাঁর পেছনেই নামতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো শ্রীগোকুলদাস বাউল আর তারও পেছনে নিত্যপ্রিয়া দাসী। নিজের চকিত রিফ্লেক্স অ্যাকশনে বিদেশদা দু'জনকেই ধরে সামলে নিয়েছেন প্ল্যাটফর্মে আছড়ে পড়ার আগেই।
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাতের লাঠি আর একতারা সামলে শ্রীগোকুলদাস বাউল কান এঁটো করা একমুখ হাসি নিয়ে বললো, "তাইলে আপনে হইলেন গিয়া আমাগোর কৃষ্ণসখা.....হেঁ হেঁ হেঁ! তা সখা চলেন তাইলে আমাগোর আখড়ায়। দেইখ্যা যান আমাগোর কৃষ্ণ স্যাবা একদিন, ভোগও নিবেন।"
কী যে আবেদন ছিলো সে আমন্ত্রণে! বিদেশদা ক্ষণেক ভেবে নিয়ে বললেন, "যেতে পারি, তবে এই আপনি আজ্ঞে করা চলবে না মোটেই।" আবার সেই অনাবিল হাসি তোবড়ানো গালে, "আইচ্ছা গ সখা, আইচ্ছা, আস গ তাইলে অহনে।"
কৃষ্ণনগর শহর ছেড়ে সামান্য দূরে গাছগাছালি ঘেরা মাটির পথ বেয়ে পায়ে পায়েই এগিয়ে চললো লাঠি হাতে গোকুলদাস বাউল আর তার পাশে পাশে একতারা-ঝোলা বোঁচকা কাঁধে নিত্যপ্রিয়া দাসী। আর তাদের অনুসরণ করে বিদেশদা। পিছুটান হীন সাংবাদিক-লেখক মানুষ তাই তো বাউল দম্পতির একডাকেই ওদের সঙ্গী হয়েছেন রসদের সন্ধানে। সবসময় লেখার জন্য কাহিনী খোঁজার উদগ্র ব্যাকুল আগ্রহে ওদের পিছু পিছু চলেছেন বিদেশদা। দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে, বুঝতে বুঝতে। ঝপ করে শেষ শ্রাবণের বেলা পড়ে এলো, একপশলা বৃষ্টি ভেজা সোঁদাগন্ধী মাটি থেকে অবিরাম ডেকে চলা ঝিঁঝিঁর আওয়াজে।
ভেরেন্ডা গাছের বেড়ায় ঘেরা আন্দাজ কাঠা দুই-তিনেক জমিতে নারকেল, সুপারী, আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, জামরুল, এমনকি একটা বেলগাছও আছে শ্রীগোকুলদাস বাউলের নিকানো পোঁছানো ছোট্ট আখড়ায়। নিত্যপ্রিয়া আগল ঠেলে আগে ঢুকলো গোকুলদাসের হাতখানা নিজের বাঁহাতে আঁকড়ে ধরে। গোকুলদাসের গলা, "কই গ হে সখা, কৃষ্ণসখা আমার, আইস গ," কী নিবিড় সে আহ্বান! আর নিত্যপ্রিয়ার আয়ত দুই চোখ, জোড়া ভ্রূ মধ্যে আর টিকোলো নাকে কাটা রসকলি তিলক, শ্যামলা রঙ, লাল কড়-রুলিতে নিরাভরণ দুই হাত, গেরুয়ারঙা লাল কস্তাপেড়ে শাড়ি, কপালের উপর নেমে আসা অগোছালো কোঁকড়া চুলের গাছি আর মধুঢালা সেই কন্ঠস্বর...... সব তাকে একসাথে ডাকলো, "কই গ সখা, ভিতরে আইস হে গ!" কখন যেন ভিতর থেকে আরও দুটি অল্পবয়সী মেয়ে, একটি বছর বারোর ছেলে আর এক অশক্ত বৃদ্ধা এসে উঠোনে দাঁড়িয়েছে। সবার মুখেই অতি পরিচিতের হাসি, নীরব আহ্বান, "আইস গ সখা....!"
মাঝে উঠোন ঘিরে ছ্যাঁচা বাঁশের দরমায় ঘেরা গোটা তিনেক ঘর, ঘরগুলির পিছনে ভেড়েন্ডার বেড়া বরাবর সার বাঁধা বড় গাছগুলি। ততক্ষণে অন্ধকার ঘনিয়েছে, লন্ঠন আর কূপীর কাঁপা আলোয় আখড়াজোড়া ঝুপসি অন্ধকার সবখানে দূর হয় নি। উঠোন ঘেরা খানতিনেক ঘরের একটি ঠাকুরঘর.... ওদের উপাস্য শ্রীকৃষ্ণ রাধারাণী আর তাদের অষ্টসখী অধিষ্ঠিত সেই ঘরে। গোকুলদাস লাঠি ঠুকে ঠুকে একা একাই গিয়ে বসলো ঠাকুরঘরের দাওয়ায়, পাশে হাত দিয়ে দেখিয়ে নিত্যপ্রিয়াকে ডেকে ওদের নতুন সখা বিদেশদাকে বসতে দিতে বললো। কিন্তু তার আগেই নিত্যপ্রিয়া মাটির দাওয়ায় পেতে দিয়েছে ফুলতোলা আসন। আর একজন অল্পবয়সী মেয়ে বিদেশদার সামনে ধরলো পেতলের ঝকঝকে মাজা ঘটিতে হাত-পা ধোবার জল আর একটা পাট করা ধোওয়া গামছা। কী আন্তরিক আতিথেয়তা! আদ্যোপান্ত শহুরে বিদেশদা ভাষাহীন। জুতো খুলে হাত-পা ধুয়ে মুছে বিদেশদা বসলেন গোকুলদাসের পাশে পেতে রাখা আসনটিতে। বিদেশদার শহুরে মন এবারে যাচাই করতে বসলো.... "মাত্র একশোটি টাকার বিনিময়ে কি এতটাই আপ্যায়ন প্রাপ্য হয়? নাকি এদের কাছে টাকার মূল্যমান অতীব গৌণ, মুখ্য হোলো সুযোগ পেলেই অতিথি সৎকারের আয়োজন!"
আখড়ায় ঐ ক'জন ছাড়া আর কাউকে দেখা গেলো না। নিত্যপ্রিয়া এবার ঠাকুর ঘরে। প্রাণঢালা সেই সুমিষ্ট গলা, "হরি দিন তো গেলো সন্ধ্যা হোলো, পার করো আমারে.........." গোকুলদাসের ডান হাতে একতারা, বাঁ হাতে মঞ্জীরা, নিপুণ সঙ্গত। সন্ধ্যারতি শেষে নিত্যপ্রিয়া প্রসাদ দিলো হাতে, এক টুকরো মিছরি আর সামান্য মাঠাতোলা মাখন। একগাল হেসে গোকুলদাসের গলা, "সখা, এইবেরে তবে আমাগোরে নিইয়া কাগচে লেইখ্যো।" আসার পথে ওটুকু সংবাদ আদান-প্রদান হয়েছিলো যে তাদের সাথে। কাঁসার বাটিতে করে মুড়ি, দুটি নারকোল নাড়ু আর একখানি ভারী সুস্বাদু মিষ্টি সহযোগে জলযোগ হোলো বিদেশদার। কখনো ঠিক এমনি ভাবে খান নি। অতি সাধারন সামান্য আয়োজন, কিন্তু অসাধারন হয়ে উঠেছে তাইই গৃহস্বামীর অকৃপণ অকৃত্রিম আন্তরিকতার পরশে।
রাতে খিচুড়ি, বেগুন ভর্তা, পোস্ত ছড়িয়ে আলু চচ্চড়ি আর মিষ্টি কুমড়োর টক দিয়ে রাধামাধবের ভোগপর্ব শেষে নিত্যপ্রিয়া কলাপাতায় সবাইকে পরিবেশন করলো সেই খিচুড়ি ভোগ। প্রথম গ্রাস মুখে দিয়েই বিদেশদা বুঝলেন খাদ্যবস্তুর আসল স্বাদ তার উপকরণে নয়, আন্তরিকতায়। কত সামান্য আয়োজনও যে কত মহার্ঘ্য হতে পারে তা বিদেশদা প্রথম বারের জন্য অনুভব করলেন।
এমনিতে সাংবাদিক মানুষের সব পরিস্থিতিতে মানিয়ে চলার অভ্যেস দস্তুর মতোই আছে, তথাপি ইতস্তত করছেন বিদেশদা এই বাউল পরিবারটির এহেন আন্তরিক আতিথেয়তায়। কুন্ঠিত বিদেশদা শয্যাগ্রহণ করলেন ঠাকুরঘরের পাশের ছোটো ঘরখানিতে। অনাড়ম্বর এক চৌকির শয্যায় বিদেশদার শোবার ব্যবস্থা হয়েছে এবং এঘরেরই মাটির মেঝেতে চাটাইয়ের সামান্য বিছানায় দিনান্তের ক্লান্তি ঢেলে দিলো গোকুলদাস বাউল। লন্ঠনের কম্পমান শিখা ঘরের এক কোণে, দূর হয় নি তাতে ঘরের সবখানিক জমাট অন্ধকার।
নীরবতা ভেঙে গোকুলদাসের গলা, "কৃষ্ণসখারে বড়ো কইষ্টে ফেইললাম গ..... কৃষ্ণপদে কৃষ্ণপদে!"
উত্তরে বিদেশদা, "এও তো যে এক অভিজ্ঞতা! সঞ্চয় হোলো যে!" কেউ কারুর মুখের অভিব্যক্তি দেখতে পায় নি অন্ধকার ভেদ করে, তবে দুজনের মুখেই ছিলো হাসির ছটা। গোকুলদাসের গলা, "ছোটো ছোটো তিনডা পোলাপান রাইখ্যা আমার বাউলানী পলাইয়ে গেল আখড়ারই আমার চ্যালাডার সঙ্গ কইরে। আর রাইখ্যা গ্যালো নিজের বুড়ি মায়রে আর সোমত্ত বোইনডারে এইহানে ফেলাই থুইয়া।" এতক্ষণে এই বাউল পরিবারের অন্দর চিত্রটা একটানে বেপর্দা হয়ে গেলো বিদেশদার কাছে। গলায় গুনগুনানি গোকুলদাসের, "খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায় .........?"
কিছুক্ষণ পরে আবার গোকুলদাস, "নিত্যিরে বহুবার কইলাম, নিত্যি তর দিদির ভুলের পেরাচিত্তির তুই ক্যান এমনে কইরতাছস? যা যা, মনের মাইনষের লগে পলা গিয়া। এই অন্ধ মাইনষের লাইগ্যা নিজের জেবনডা ভাসাইয়া দেইস না। যা যা, যা গিয়া! বোঝলা সখা, কিচ্ছুতেই শুনে না গ, অর লাইগ্যা মনডা পুইড়্যা যায় গ সখা!" গোকুলদাসের উচ্চারিত প্রতিটি বর্ণে বিদেশদা অনুভব করলেন অকুন্ঠ দরদ, কিন্তু কিছু বলতেও মন চাইলো না বিদেশদার।
গোকুলদাসের ধরতাই, "নামেই ওই আখড়া গ সখা। ভ্যাক্ ধইরেছি গ, ভ্যাক্! আসল কথাডা হইলো গিয়া প্যাটটা ভরানের লাইগ্যা সব গ সখা.... সঅঅব। এই কৃষ্ণ স্যাবা, এই গান, এই গেরুয়া, এই একতারা, এই আখড়া.... সব কিচ্ছু!"
গোকুলদাস বলে চলেছে, "মাইয়া দুইডা ডাগর হইয়া উইঠতেছে। ইয়া ছাড়া নিত্যিডাও আছে। তাই আর কুনঅ বাউলরে আখড়ায় রাখি না। চক্ষুর আলো না থাইকলে মাইনষের বেবাক আপদ বাইড়্যা যায় গ, সখা!" বিদেশদার মনে হোলো সেসময়টা কেবল চুপ করে শোনার সময়, নিজের নিঃশ্বাসের প্রশ্বাসের আওয়াজটুকু পর্যন্ত।
*********
ট্রেনটা খুব জোরে হুইসেল বাজিয়ে ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে যাওয়াতে বিদেশদা তাকালেন জানালার বাইরে, কৃষ্ণনগর সিটি জংশনে ঢোকার ঠিক মুখে দাঁড়িয়ে পড়েছে ট্রেনটা। পুরো পথটা পার হয়ে এসেছেন বিদেশদা, বারো বছর মানে একযুগ পরিক্রমা করে। এই এত বছর ধরে বিদেশদার এক অসম অথচ অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ঐ প্রায় নিঃস্ব পরিবারটি অর্থাৎ অন্ধ গোকুলদাস বাউলের পরিবারটির সাথে। বিদেশদা জড়িয়ে পড়েছেন হতদরিদ্র বাউল পরিবারটির অন্তরমহলে বয়ে চলা প্রেমের ফল্গুধারায়। অন্ধ বৃদ্ধ গোকুলদাস বাউল আর নিত্যপ্রিয়া দাসীর মুখে উদ্ভাসিত কী যে এক আলোর ছটা! তার উৎস অনুসন্ধানে কেটে গেছে বিদেশদার জীবনের বারোটি শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত-বসন্ত। প্রতি বছর বিদেশদা হাজার কাজের ফাঁকে একটা বেলার অবসর ঠিক খুঁজে বার করে নেন তাঁর সখা শ্রীগোকুলদাস বাউল আর নিত্যপ্রিয়া দাসীর বিনা বন্ধনে বাঁধা সংসারযাত্রায় সামিল হতে।
অধুনা অশক্ত গোকুলদাসের সংসারী আখড়ার কৃষ্ণসেবার আর্থিক দায়িত্বটুকু স্বেচ্ছায় বিদেশদা তুলে নিয়েছেন নিজের কাঁধে, গোকুলদাস বাউলের সাক্ষাৎ কৃষ্ণসখা হয়ে।
আর বিদেশদা ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে বিষম ভয় পেয়েছেন, যদি নিজের জীবনে সত্যিকারের ভালোবাসার সন্তুলন না ঘটে।
কামরার অন্য প্রান্ত থেকে তরুণ এক বাউল দম্পতির কন্ঠে ভেসে আসছে, "ও মিলন হবে কত দিনে, আমার মনের মানুষের সনে.......!"
বাজিকরের নিপুণ খেলায় মাঠে শুধু খেলুড়ে বদল সময়ের বিভেদে।