অত্যাচার
অত্যাচার
সৌবিরাগ্রাম
সৌবিরাগ্রামের তুলোর খেতে আজ হুলস্থূল বেধে গেছে। তুলো তোলার কাজ প্রায় শেষের দিকে, কিন্তু এখনও অনেক কাজই বাকী রয়ে গেছে। গ্রামের সারা বছরের রোজগার দাঁড়িয়ে আছে এই তুলোর ব্যবসার ওপরে, ব্যবসায়ী- মহাজনেরা এসে পড়ল বলে।
কনোজী তাম্বে খানিকটা জমির মালিক, আজ তিনি প্রচণ্ড হাঙ্গামা শুরু করেছেন সকাল থেকে। তাঁর মেয়ে ইলাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দু'বছর হয়ে গেল, পাঠশালার পড়া বন্ধ করে মেয়েকে তুলোর খেতে কাজে লাগিয়েছেন তিনি, যদিও পড়াশোনার দিকে অসম্ভব ঝোঁক ইলার। তাম্বের স্ত্রী, পার্বতী নিরক্ষর নয়। কনোজী বোঝেন সে'ই এইসব কলকাঠি নাড়ছে।
'কী হবে লেখাপড়া করে? আমরা বড়লোক নই। ক'দিন পরে বিয়ে তো দিতেই হবে, কাজ করুক। ঘরের অন্নসংস্থানের কথাও তো ভাবতে হবে।'
গোদাবরী নদীর তীরে বসে আছে ইলা, কত রকম ভাবনা যে তার মাথায়। কেন যে বাবা এইরকম ব্যবহার করেন তাঁর সন্তানদের সঙ্গে! ছোট ভাই হরিকেও বাবা পাঠশালা থেকে ছাড়িয়ে এনে খেতের কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। বাবার উগ্রচণ্ডী মূর্তিকে বড় ভয় পায় ইলা। রোজ সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরেন বাবা মত্ত অবস্থায়, শুরু হয়ে যায় স্ত্রী ও সন্তানদের ওপরে তর্জন- গর্জন। আগুনে ঘৃতাহূতি দেওয়ার জন্যে হামেহাল হাজির থাকেন আজ্জি। আঈয়ের কষ্ট দূর করার চেষ্টায়, দিনভর খেতে কাজ করবার পরেও ইলা তাঁকে ঘরকন্নায় সাহায্য করে, ছোট্ট ভাইটিকে সামলায়... তার পরে সময় পেলে যদি সে তার বই পত্র নিয়ে বসে, বাবা আর আজ্জি এসে তার বই পত্র কেড়ে নেন।
'আমি তো তোমাদের সব কথা শুনি বাবা। পাঠশালায় যাই না, খেতের কাজ করি, আঈকেও সাহায্য করি। আমার পড়াশোনাটা তো বন্ধ কোর না। প্রাজক্তা তাঈ বলেছেন, আমাকে লেখাপড়ায় সাহায্য করবেন। পাঠশালায় না গেলেও চলবে... আমার বন্ধু লক্ষ্মী আর লীলার মদদও পাব।' 'তোমার বড়লোক বন্ধুদের সঙ্গে মিশেই তোমার এই দুর্মতি! আমাদের মত পরিবারে কাজ না করলে চলবে, খাবে কী?'
গর্জে ওঠেন কনোজী।
'আররে, এই মুলগি তো বড়ই বে-আদব! কথা কানেই তোলে না। পড়াশোনা করলে কি তোর দুটো পাখা গজাবে? তোর আঈও তো পড়াশোনা করেছিল, এখন তো চুলা-চৌকাই সামলাচ্ছে... না কি! আমি আর তোর বাবা তো পড়াশোনা করিইনি, আমরা কি মরে গেছি? দাঁড়া আজ তোর বই- খাতা আমি আগুনে পোড়াব। না থাকবে বাঁশ, না বাজবে বাঁশুরী।'
তাম্বের ক্রোধের আগুনে ঘৃতাহুতি দেন তাঁর মাতা, ইলার আজ্জি সীতাবাঈ।
ইলার কান্নাকাটিতে আজ্জি গললেন না, কোনওরকম সহানুভুতিই জাগল না তাঁর মনে। ইলার হাত থেকে তার বই- পত্র কেড়ে নিয়ে চুলায় ফেলে দিলেন তিনি।
ইলা বুদ্ধিমতী। সম্মানের সঙ্গে ষষ্ঠ শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছিল সে। পার্বতী তাঁর স্বামী আর শাশুড়ীর বিরুদ্ধাচারণ করেও ইলাকে পাঠশালাতে পাঠিয়েছিলেন, মেয়ের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে... তাঁর ইচ্ছে হয়েছিল ইলা কিছুটা লেখাপড়া শিখুক।
আঈয়ের হাত ধরে শালাতে গিয়ে, প্রথম দর্শনেই ইলা ভালবেসে ফেলল শিক্ষিকা প্রাজক্তা তাঈকে।
পিঠের ওপরে হাতের স্পর্শ পেয়ে ইলা চমকে উঠল।
'কী করছিস রে এখানে বসে? ঠিক জানি আমি, তোকে এখানেই পাওয়া যাবে। খেত থেকে চলে এসেছিস কেন? তোর বাবা প্রচণ্ড রেগে গেছেন, তুলকালাম করছেন তোকে দেখতে না পেয়ে।'
ইলা মুখ ফিরিয়ে দেখল গ্রামের প্রধান পুরোহিত কাওয়ালেজী'র মেয়ে, তার প্রিয় বন্ধু ভাগ্যলক্ষ্মী হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। সে কোনও উত্তর দিল না, তার কান্নাও বন্ধ হলনা।
'কী হয়েছে কী তোর, কাঁদছিস কেন? জানিস ইলু,' উত্তেজিত হয়ে বলে লক্ষ্মী, 'শিবাজী মহারাজ আসছেন আমাদের গ্রামে, জালনা যাওয়ার পথে একদিন বিশ্রাম নেবেন। চল চল, ওঠ এখন। আমার বাবা বলেছেন, পুরো গ্রাম আর মন্দির পরিষ্কার করে, সাজিয়ে ফেলতে হবে... শিবাজী রাজের অভ্যর্থনায়।
ইলার চোখে চমক জাগে, চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায় সে। ইলাকে নিয়ে লক্ষ্মী এগোতে থাকে মন্দিরের দিকে।
ইলা তার বাবাকে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে, পুরোহিত- গুরুজী কাওয়ালের দিকে অসহায় চোখে তাকায়। তাম্বে তার আগুন ঝরা চোখে ইলার আপাদ মস্তক জরীপ করতে থাকেন।পুরোহিতজী হেসে বলেন, 'তাম্বে, আজ তোর মেয়েটাকে ছেড়ে দে ভাঊ। শিবাজী মহারাজের স্বাগতমের জন্য ওকে আমাদের দরকার, এত গুণী তোর মেয়ে, ইলা। তাম্বে প্রধান পুরোহিতজীর অনুরোধের বিরোধিতা করতে পারেন না, প্রচণ্ড রাগে দুম দুম করে পা ঠুকে চলে যান তুলোর খেতের দিকে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে ইলা।
পাঠশালার দরজায় গিয়ে দাঁড়াল, ইলা আর লক্ষ্মী।
'তাঈ, তোমার ছাত্র- ছাত্রীদের একদিনের জন্যে ছেড়ে দাও না, অনেক কাজ আছে। তুমিও চল আমাদের সঙ্গে। বলে দেবে আমাদের, শিবাজী মহারাজকে স্বাগত জানাবার জন্য কী কী করতে হবে।'
'কেউই তো নেইরে শালাতে, ক'টা কুট্টি কুট্টি বাচ্চা ছাড়া। সবাইকেই নিয়ে গেছে, তুলোর খেতে কাজ করার জন্যে। কী আর করা যাবে বল, গ্রামবাসীদের রুজি- রোজগারের কথাও তো ভাবতে হবে।'
প্রাজক্তা তাঈকে দেখেই ইলার মনে পড়ে গেল সেই সুন্দর দিনগুলোর কথা, যখন তাঈয়ের হাত ধরে বিকেল বেলায় নদীর ধারে বেড়াতে বেরত সে।
'তাঈ, আমি তোমার মত হতে চাই। তুমি বিয়ে না করে শিক্ষকতার পথ বেছে নিয়েছ। আমার আঈ পাঠশালাতে গিয়ে পড়াশোনা করবার সুযোগ পেয়েছিলেন বিয়ের আগে, কিন্তু তাঁর বাবাও তাঁকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে নিজের কর্তব্য সমাপন করলেন... মেয়েকে তার নিজের বাড়ি, শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন। আচ্ছা তাঈ, বাবার বাড়ি মেয়েদের নিজের বাড়ি নয় কেন?'
কোনও উত্তর না পেয়ে, ইলা দেখল, তাঈ তাঁর ভাবনার দুনিয়াতে হারিয়ে গেছেন। ইলা চুপ করে অপেক্ষা করতে থাকল।
হঠাৎ যেন স্বপ্ন ভঙ্গ হলো তাঈয়ের। বললেন, 'আমারও ১২ বছর বয়েসে বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল, ইলা। আমি জানি না কীভাবে আমি সাহস পেলাম, গৃহত্যাগ করবার... আমার প্রিয় আত্মীয় স্বজনকে ছেড়ে, অন্যরকম জীবনের আশায়। আমাকে সাহস যোগাল আমার অন্তরের শক্তি। শোন ইলা, আজ তোমাকে সত্যবাদিনী আর ব্রহ্মবাদিনীর কথা বলি।
প্রাচীন বৈদিক যুগে মহিলাদের স্থান ছিল পুরুষদের সঙ্গে একাসনে। মেয়ে সন্তানের জন্ম তখন ধিকৃত হত না। ছেলেদের সঙ্গে একই ভাবে মেয়েরাও শিক্ষা গ্রহন করত, কখনও কখনও গুরুকূলেও। পুরুষের মতই নারীরও অধিকার ছিল নিজের জীবনপথ নির্ণয়ের...'
'তাঈ, কী যেন বললে তুমি,' ইলা মাঝখানে বাধা দেয়।
'কী ...বাদিনী?'
তাঈ আদরের সঙ্গে ইলার মাথার চুলে বিলি কেটে দিয়ে বললেন, 'হ্যাঁ, ব্রহ্মবাদিনী! যেমন ধর আমি। ব্রহ্মবাদিনীরা বিয়ে করবার কথা ভাবতেনই না, বিয়ের জন্যে তাঁদের কেউ জোরও করত না। কোনো মেয়েকেই অবশ্য জোর করা হতো না সেই যুগে। তাঁরা তাঁদের জীবিকা নিজেরাই স্থির করতেন, ইচ্ছেমত। ডাক্তারী, শিক্ষকতা, পৌরহিত্য, দার্শনিকতা... রাজা জনকের রাজসভাতে নামকরা দার্শনিক ছিলেন গার্গী। জান ইলা, তিনি মহাঋষি- মহাজ্ঞানী যাজ্ঞবল্ক্যকে তর্কে পরাজিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন।'
চোখ বড় বড় করে শুনতে থাকে ইলা, তাঈয়ের কথা। খুব ভাল লাগে তার।
'সত্যবাদিনীরা বিয়ে করতেন, নিজের ইচ্ছেতে স্বয়ম্বরা হয়ে, কিন্তু তার আগে তাঁরা নিজেদের যথাযথ ভাবে শিক্ষিত করে তুলতেন, তাঁদের উচ্চশিক্ষিত স্বামীদের উপযুক্ত ঘরণী হওয়ার জন্য... তাঁদের ভবিষ্যৎ সন্তানদের শিক্ষাদানে সমর্থ হতে। একজন মহিলাকে যদি শিক্ষিত করা যায় ইলা, একটা পুরো পরিবার শিক্ষিত হয়। মাতা'ই তো সন্তানের সর্বপ্রথম গুরু।'
'আমার আঈ তো শিক্ষিত হয়েও কিছুই করতে পারলেন না, তাঈ।'
'মন খারাপ কোর না ইলা। তোমার বাবার সঙ্গে আমি কথা বলব। কিন্তু এই লড়াই একান্ত তোমারই। অধিকার কেউ কাউকে দেয় না বেটা, অধিকার অর্জন করে নিতে হয়। তুমি তোমাকে অসম্মান ও অবজ্ঞা করবার সুযোগ কাউকে দেবে কি না, তা পুরোপুরি তোমার ওপরেই নির্ভর করে। তোমার আত্মশক্তির অগ্নিশিখাকে প্রজ্বলিত কর, সে'ই তোমাকে রক্ষা করবে।'
তুলো তোলার কাজ শেষ। ব্যবসায়ী- মহাজনরা প্রভূত জিনিষপত্র ও সোনা- রূপার বদলে সেই তুলো নিয়ে ফিরে গেছেন। গ্রামবাসীরা খুবই খুশী, তাদের হাতে পয়সা- কড়ি- দ্রব্যাদি এসেছে।
মুঙ্গি গ্রামের ব্যবসায়ী, বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ক্রুষ্ণদেব নিম্বারকরের আনাগোনা কিন্তু চলতেই থাকল, কনোজীর বাড়িতে। বাবার বয়েসী এই ব্যক্তির চোখের দৃষ্টি মোটেই ভাল লাগে না ইলার। আঈ-বাবার কথোপকথন শ্রুতিগোচর হয় তার। 'আমি নিম্বারকরের সঙ্গে ইলার বিয়ে ঠিক করেছি, অনেক টাকা দেবে ও।'
'ও তো ইলার বাপের বয়েসী।'
ক্রুদ্ধ তাম্বে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। ইলার মনে পড়ে প্রাজক্তা তাঈয়ের কথা।
'মহারাষ্ট্রের মেয়েরা ভাগ্যবতী ইলা। পড়াশোনা করার সুযোগ পেলে, তুমি জানতে পারবে ভারতবর্ষের অন্যান্য জনপদের মেয়েদের কি দুরবস্থা! তুমি, আমি অত্যন্ত দুর্ভাগা যে এইরকম অসুস্থ ও অশিক্ষিত মানসিকতার মানুষের ঘরে জন্ম নিয়েছি।'
অমাবস্যার ঘন অন্ধকার রাতে ইলা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে, তার জানা নেই কোথায় যাবে সে কিন্তু তার মন এখন ভয়শূন্য। পথে জৈন মন্দিরে প্রবেশ করে ইলা... কালো রেতিতে তৈরী মূর্তি, ভগবান মুনিশুভ্রনাথের চরণে প্রার্থনা জানাতে। ভগবান নাকি কারও প্রার্থনা অপূর্ণ রাখেন না।হঠাৎ মন্দিরের দেওয়ালে একটি কম্পমান ছায়া দেখে চমকে ওঠে ইলা। তার পেছনেই আছে আরও কেউ... কে সে?
জ্বলতে থাকা টিমটিমে দিয়ার আলোয় কিছু ঠাহর হয় না ঠিকমত। ঝট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেওয়ালের দিকে সরে যায় ইলা, প্ৰতিপক্ষের মুকাবিলা করার জন্যে শরীরে- মনে তৈরী হয় সে। ছায়ামূর্তী, দিয়া হাতে নিয়ে এগিয়ে আসতে থ
াকে। বড় বড় শ্বাস পড়ে ইলার, চোখের পলক পড়ে না। দিয়ার কাঁপতে থাকা শিখার আলোয় মোহনের চেহারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
'তুমি! কী করছ এত রাতে, এখানে ?’
‘এই একই প্রশ্ন তো আমিও জিজ্ঞেস করতে পারি, তাই না? একটা মেয়ে এই আঁধার রাতে বাড়ির বাইরে কেন ?‘
'আমাকে প্রশ্ন করার অধিকার কে দিয়েছে তোমাকে?’
ইলার প্রশ্নটাকে পাশ কাটিয়ে মোহন বলে, ‘আমার ঘুম আসছিল না গরমে, বাইরে বেরিয়েছিলাম। তখনই তোমাকে দেখতে পাই বাড়ি থেকে বেরতে, আর সেই থেকেই তোমার পিছু নিয়েছি আমি।'
‘ঠিক করনি একদমই…’
‘জানি না কেন আমার মনে হল, তোমার বিপদ হতে পারে আর আমার দায়িত্ব রয়েছে তোমাকে রক্ষা করার।ইলার চোখ ভরে ওঠে জলে, গাল বেয়ে নেমে আসে সেই মুক্তোকণা। বড় যত্নে সেই অশ্রুধারা মুছে নেয় মোহন।
‘আমাকে তোমার শুভানুধ্যায়ী মনে করে, তোমার মনের সব কথা খুলে বল ইলা।’
‘আমি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি মোহন, নিজের জীবন এবার থেকে নিজেকেই চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে... জানি না কী ভাবে!’
‘বাইরের দুনিয়াটা কিন্তু সহজ নয় ইলা, ভাল করে ভেবে নিয়েছ তো? তোমার বাড়ির থেকেও অনেক বেশি কঠিন পরিস্থিতি হয়ত অপেক্ষা করছে তোমার জন্যে, তুমি তৈরি তো?'
'ভাবার সময় ছিল না মোহন। তুমি জান, আজ্জি আর বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন, আমার বাবার বয়েসী এক মানুষের সঙ্গে।'
'আমি শুনেছি, আমার আঈ আর বাবা কথা বলছিলেন। আমার বাবাও তো একই পথের পথিক ইলা। আমাদের বাড়িতে লেখাপড়ার কোনও পরিবেশই নেই... আমাকেও কখনও পড়াশোনা করতে উৎসাহ দেননি আমার বাবা। বোনগুলোকেও তাদের অল্প বয়েসেই, বিয়ে দিতেই ব্যস্ত তিনি। নিম্বারকরের সঙ্গে তোমার বিয়ের কথায় আঈ দুঃখ করছিলেন, তো বাবা রেগে উঠলেন। বললেন "কি করবে, তাম্বে তো অপারগ। নিম্বারকর মহাজন, অনেক টাকা ঋণ দিয়েছে। তাম্বে শোধ করবে কী করে?'
'তাই জন্যে, নিজের মেয়েকে বলি চড়াতে হবে? পয়সার এত তঙ্গি তো নিজের নেশার খরচটা কম করলেই হয়! আমি পড়াশোনা করতে চাই। তুমি কী জান মোহন, দেবগিরি কোন্ দিকে? সেখানে আমার মামার বাড়ি, গিয়ে দেখি যদি ওখানে কোনও সুরাহা হয়।'
'চল, আমরা একসঙ্গেই যাই। আমারও ভাল লাগছে না আর এই বাড়িতে। আমিও পড়াশোনা করব, তোমার মনের মত করে আমি নিজেকে তৈরি করে নেব ইলা। পয়সা- কড়ি কিছু নিয়ে বেরিয়েছ সঙ্গে? আমার কাছে তো কিছুই নেই।' ইলা মাথা নেড়ে না বলে।
'তাহলে, আমাদের পায়ে হেঁটেই যেতে হবে।' 'পারব।' উজ্জল দুটি চোখ তুলে তাকায় ইলা মোহনের দিকে, হেসে বলে, 'পারতেই হবে। তুমি আছ যে আমার সঙ্গে!'
সৌবিরাগ্রাম আজ আবার মেতে উঠেছে আনন্দ কোলাহলে। বছর দশেক আগে হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া দুটি ছেলে মেয়ে আবার ফিরে এসেছে, তাদের নিজ বাসভূমিতে। কিন্তু ইলা আর মোহনের পরিচিত সেই মুখগুলি কোথায়? তারা দু'জনে বিস্ময়াভিভূত হয়ে দেখতে থাকে তাদের প্রিয় গ্রামের ভগ্নদশা... যেন কোনও ভয়ংকর ঝড়- তুফান অথবা সুখার কবলে পড়েছিল সৌবিরাগ্রাম। কোথায় সে সুজলা- সুফলা, শস্য- শ্যামলা ধরণী? দারিদ্র্য আর বিষণ্ণতায় ঘেরা এই একদা বর্ধিষ্ণু গ্রামটির দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় চোখ জলে ভরে ওঠে, মোহন ও ঈলার।
আঈ গাঙ্গুবাঈ আর পার্বতীর অশ্রুধারা আজ আর বাঁধ মানছে না, হারিয়ে যাওয়া সন্তান দু'টিকে ফিরে পেয়ে।
ইলা আজ সফল হয়ে ফিরে এসেছে বাড়িতে, বাড়ির পরিবর্তন গুলো তার নজরে পড়ছে খুব বেশী করে। বাবা অনেকটাই বুড়িয়ে গেছেন, যতটা না বয়েসের ভারে... অভাবের করাল গ্রাস যেন তাঁকে জীবনের শেষপ্রান্তে এনে ফেলেছে। পুরো জনপদটিই আজ অন্ধকারাচ্ছন্ন। মহাজনের হাতের পুতুল হয়ে কোনরকমে বেঁচে আছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তুলো উৎপাদনকারী, পৈঠানের অধিবাসীরা। পৈঠানের সে রমরমা আজ আর নজরে আসে না।
আজ্জি আর নেই, তার কথা মনে করে দু'ফোঁটা চোখের জল ফেলল ইলা। কত কষ্টই না দিয়েছেন তিনি ইলাকে, তবুও... তাঁর স্মৃতি যে ছড়িয়ে রয়েছে ঘরের আনাচে কানাচে।
আজ্জি আর বাবা যদি সেদিন তাকে সবরকম সুযোগ দিতেন, বিরোধিতা না করতেন, ইলা হয়ত নিজেকে এইভাবে তৈরি করে তুলতে সক্ষম হত না।
ছোট ভাই, লক্ষ্মণ... যে তার খুব ন্যাওটা ছিল, যার দেখভালের ভার ছিল ইলারই ওপরে, কত্ত বড় হয়ে গেছে... হাঁ ক'রে তার তাঈয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে, বুঝবার চেষ্টা করে সে এই ঘটনার ঘনঘটা। ইলার গ্রামত্যাগের সময়ে, কোনও কিছু বোঝার বুদ্ধিই ছিল না তার।
ইলার পরের বোন রাধার বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন বাবা খুবই ছোট বয়েসে, শ্বশুরবাড়ির কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ফিরে এসেছে সে। শাশুড়ি আর স্বামী দু'জনই তার জানের দুশমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাবা মেনে নিতে পারেননি, কন্যার এই শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে আসাটা... কিন্তু আঈ পার্বতী এই সময়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। সন্তানসম্ভবা, দুঃখী- বঞ্চিতা মেয়েটির সহায় হয়েছিলেন তিনি। তাকে ফিরিয়ে এনে, ঘরে যায়গা দেওয়ার জন্যে স্বামীর সবরকমের বিরোধের সামনা করেছিলেন।
প্রাজক্তা তাঈ গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে, সৌবিরাগ্রামের কেউই আর উদ্যোগ নেয়নি পাঠশালাটিকে চালু রাখবার। সে আজ পরিত্যক্ত ভূতুড়ে বাড়ির মত দাঁড়িয়ে আছে... রোদ- জল, ঝঞ্ঝা- তুফানের সঙ্গে অবিরত যুদ্ধ ক'রে। জানলা- দরজা ভেঙে পড়েছে, বিচালির ছাউনি উড়ে গেছে। গ্রামের কোনও ছেলে মেয়েই আজ আর পড়াশোনা করে না।
মোহন আর ইলা ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে গ্রামের জীর্ণদশা। তারা দুজনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, তাদের প্রথম কাজ হবে বিদ্যালয়টির সুধার করা। টাকা- পয়সার যোগাড় হবে কেমন করে... ভাবনায় পড়ে যায় সোনালী ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে থাকা এই ছেলে- মেয়ে দুটি।
প্রাজক্তা তাঈয়ের পৌরোহিত্যে মোহন আর ইলার লগন (বিয়ে) সম্পন্ন হল। স্বামীর সঙ্গে তার না-পসন্দ শ্বশুরের ঘর করতে গেল ইলা।
এই রিশতা কনোজী তাম্বের পছন্দ না হলেও তিনি দন্তস্ফুট করলেন না... শিরদাঁড়া ভেঙে গিয়েছে তাঁর। গ্রাম- প্রধান রামভাউ পাটিলের একদমই মত ছিল না এই বিয়েতে, কিন্তু বিরোধিতাও করে উঠতে পারলেন না তিনি, আজ নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা দুই সার্থক, পূর্ণবয়ষ্ক মানুষের মতামতের।
বিয়ের পর থেকেই কিন্তু তিনি সর্বদাই ফিকির খুঁজতে থাকলেন, কীভাবে প্রতি পদে ইলাকে বিপর্যস্ত করা যায়। তবে, ইলাও এখন জলে ঝড়ে পরিপক্ক এক কঠিন মানবী। তাকে সমস্যায় ফেলা অতি দুরূহ কাজ। তিনি তাঁর ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করার চেষ্টা করতে থাকেন, ক্রমাগত পুত্র মোহনের কানে বিষ-মন্তর দিয়ে।
দূরের টিলার পেছনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে সাদা ধবধবে এক সৌধ। ইলা হাঁটতে হাঁটতে একদিন চলে যায় সেখানে। দূর থেকে বোঝা যায়নি, গাছের আড়ালে থাকা স্থাপত্যটি একটি গীর্জা।
ইলার মাথায় ঘুরতে লাগল নানারকম চিন্তা। সৌবিরাগ্রামে ঈসা মসীর বাণী কীভাবে এতটা প্রচার পেল? এই গ্রামে হিন্দু ধর্মের সাথে সাথে বৌদ্ধ আর জৈন ধর্মাবলম্বী কিছু মানুষ তো সব সময়েই ছিলেন। ঔরঙ্গাবাদ শহরটিতে ইসলামের প্রভাব দেখা গেলেও, সেই ধর্মের প্রচার এসে পৌঁছতে পারেনি এখনও পৈঠানে, কিন্তু খ্রিষ্টান? চার্চ যখন তৈরি হয়েছে... খোঁজ খবর করতে হবে তো। সন্ধ্যে হয়ে আসায় ইলা ফিরে চলল বাড়ির দিকে।
পার্বতীর কাছে গিয়ে বসল ইলা খানিক্ষণের জন্যে। চেহারা কত খারাপ হয়ে গেছে আঈয়ের, অভাব তাদের সংসারটাকে পুরোপুরি বিধ্বস্ত করে ফেলেছে।
ইলাকে কাছে পেয়ে তার আঈয়ের আর কথা ফুরোতেই চায় না। পার্বতীর কাছেই জানতে পারল ইলা বছর পাঁচেক আগের ভয়ঙ্কর বাঢ়ের কথা। বেশ কিছুদিন ধরে চলেছিল মুষলধার বরষণ... গোদাবরীর জল বিপদ সীমার ওপরে বইতে শুরু করেছিল আর ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তার কূলবর্তী গ্রামটিকে।
আঈয়ের ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে, তাঁর কাঁপতে থাকা হাত দুটো ধরে বসে জলভরা চোখে ইলা শুনতে থাকে সেই নিদারুণ দুঃসময়ের কাহিনী। কী সাংঘাতিক কষ্ট করে যে তারা কয়েকজন গ্রামবাসী বরাতজোরে বেঁচে গিয়েছিল। তুলোর খেত ভেসে গেছে, মহাজনদের ঋণের বোঝা বাড়তে বাড়তে আজ আকাশ ছুঁয়েছে। কেউ জানে না কীভাবে আর কবে যে এই দুর্দিন থেকে মুক্তি পাবে।
আঈ বলে চললেন, 'সেই সময়েই এসে হাজির হয়েছিলেন এই খ্রিষ্টান পাদ্রীদল। বিদেশ থেকে এসেছিলেন তাঁরা, ত্রাণ নিয়ে। ওনাদের দয়ায় বেঁচে গিয়েছিল সৌবিরাগ্রামবাসীরা। তার পরে পরেই তাঁদের স্বরূপ প্রকাশ পেল। চার্চ তৈরি হল গ্রামের প্রান্তে, শুরু হলো ধর্মপ্রচার… ধর্মান্তর। দলিতেরা তো আজ প্রায় সকলেই খৃষ্ট- ধর্মাবলম্বী। কিন্তু ভালই আছে তারা ইলা, খেয়ে পরে বেঁচে তো আছে। মহাজনদের অত্যাচার সহ্য করতে তো হয না।
ধর্মপ্রচারকদের ব্যাপারটা ভাল করেই জানা আছে ইলার। ইতিহাসই তো তার ভালবাসার বিষয়। অনেক পড়াশোনা করেছে সে ইতিহাস নিয়ে। খ্রিষ্টান মিশনারীরা এদেশে আসতে শুরু করলেনই, দেশের অভাবগ্রস্ত, পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোকে আলো দেখাবার উদ্দেশ্যে।
আজ এই বিশাল দেশ ভারতবর্ষ কূপমণ্ডুকতা আর কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। কোথায় সেই বৈদিক ভারতবর্ষের তুলনাহীন সমাজ ব্যবস্থা! উন্নত এই মারাঠওয়াড়ার সংস্কৃতিরও অধোন্নতি হয়েছে।
বিভিন্ন জনপদের সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানে আজ সমগ্র ভারতেরই দুর্দিন এসেছে। মধ্যযুগীয় বর্বতার শিকার এই উন্নত প্রাচ্যের অধিবাসীরা, আর সেই সুযোগ নিচ্ছে ইসলাম ও খৃষ্ট ধর্মের প্রচারকেরা। উচ্চবিত্ত এবং ব্রাহ্মণ্য ধার্মিকদের অত্যাচারে নিম্নবর্গের অত্যাচারিতেরা দলে দলে ধর্মান্তরিত হয়ে চলেছে, খাদ্য- বস্ত্র- শিক্ষায় সমানতার আশায় আশায়। কিন্তু তাদের অবস্থার উন্নতি আপাতদৃষ্টিতে দেখতে পাওয়া গেলেও, স্থায়ী হচ্ছে না। প্রথমদিকে হয়তো কিছু সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়েছে তাদের, পরে তারা পড়ে থেকেছে যে তিমিরে সেই তিমিরেই... শোষণনীতির প্রয়োগে তো সব ধর্মের মাথারাই সিদ্ধহস্ত।
অঙ্গীকারবদ্ধ হয় ইলা আর মোহন... সবরকমের শোষণ আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, তাদের প্রিয় জন্মভূমি এই সৌবিরাগ্রামকে আবার সুন্দর করে গড়ে তুলবে... শিক্ষার আলোকে উজ্জ্বল হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবে গ্রামের মানুষ।