STORYMIRROR

Sangita Duary

Romance Classics

4  

Sangita Duary

Romance Classics

অন্য মমতা

অন্য মমতা

5 mins
186

মনটা ভালো নেই মঞ্জুরীর। তুলি'টার সেই কাল থেকে কোনো খবর নেই, গ্রূপে না নতুন কোনো পোষ্ট, না কোনো মেসেজ। কি যে হলো!

বাবু সেই যে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে পুনে চলে গেল, তারপর তো মঞ্জুরী একাই। রিটায়ারমেন্টের পর শুধু বাগান করে আর টিভি দেখে কি আর একাকীত্ব দূর হয়!

চাকরি পেয়ে একটা স্মার্ট ফোন কিনে দিয়েছিল বাবু, ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ একাউন্ট করে দিয়েছিল, বলেছিল- "মা, একাকীত্ব কাটবে দেখো, অনেক বন্ধু জুটবে, তাছাড়া আজকাল অনেক গ্রূপ হয়েছে যারা সাহিত্য চর্চা করে, তুমি সেগুলো পড়তেও পারবে!"

হ্যাঁ, সময়টা ভালোই কেটে যেত মঞ্জুরীর। দুপুরটা আর একঘেয়ে লাগতো না, সন্ধ্যেটায় মন কেমন হতো না, অনেক বন্ধু জুটেছে তাঁর। অনেক গ্রূপের লেখা পড়ে তিনিও দুএকটা লিখতে শুরু করেছেন, বাহবাও কুড়োচ্ছেন ভালোই।

তেমনিই একটা সাহিত্য গ্রূপ, ডাইরি। ওখানেই লেখে তুলি। কি অসম্ভব সুন্দর লেখে মেয়েটা! জীবনের প্রতিটা অনুভুতি অসাধারণ দক্ষতায় মূর্ত করে তোলে, পড়লে মনে হয়, যেন নিজের জীবনের অধ্যায় গুলো নিজেই চাক্ষুষ দেখছেন। অসামান্য জীবনবোধ না থাকলে কি আর এমন আবেগ মেখে গল্প, কবিতা পরিবেশন করা যায়!

মঞ্জুরী তুলির একটা লেখাও বাদ দেননা পড়তে। ধীরে ধীরে পরিচয় হয় মেয়েটির সঙ্গে, মেসেঞ্জারেই কথা হত ওঁদের। ওইটুকু একটা মেয়ে ঘরসংসার সামলে কি সুন্দর নিজের শখটাকে জিইয়ের রেখেছে! অতীতে ফিরে যান মঞ্জুরী।

শখ তো তাঁরও অনেক ছিল।

কলম ধরবেন, বই প্রকাশ পাবে তাঁর, কত মানুষ তাঁকে পড়বেন, স্বয়ংসিদ্ধা হবেন!

কিন্তু সে সাধ আর তাঁর পূরণ হলো কই?


কলেজ পাশ করতে না করতেই বাড়ি থেকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলো, পাত্রের বড় চাকরি রেলে, সুন্দরী শিক্ষিতা মেয়ে হিসেবে মঞ্জুরীকে অপছন্দ করলেন না তাঁরা।

ভীষণই রক্ষণশীল পরিবারের বউ হলেন মঞ্জুরী। বাড়ির মেয়ে বউরা হুটহাট বাইরে বেরোনোর অনুমতি পেত না। কিন্তু বিয়ের পর যখন মঞ্জুরী তাঁর বাকি পড়া শেষ করার অনুমতি চাইতে গেলেন, শ্বশুরমশাই পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, "কেন, আমার ছেলের টাকায় কি ভরণপোষণ কুলচ্চেনা? যে বিদ্যেধরি হয়ে উপার্জন করতে হবে?"

মঞ্জুরী ঘোমটা টেনে বেরিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু সুকুমার মঞ্জুরীকে হাল ছাড়তে দেননি, নিজে তাঁকে সঙ্গে করে কলেজে নিয়ে যেতেন। বাবা জানতে পেরে বেজায় চোটে ছিলেন, "বিয়ের পর এত অধঃপতন ছেলের! বউয়ের আঁচল ধরতে শিখে গেল? অমন ছেলে থাকার থেকে না থাকাই ভালো!"


সুকুমার মঞ্জুরীর হাত ধরে বেরিয়ে এসেছিলেন, রেল কোয়ার্টারে থাকতেন। মঞ্জুরী নিজের পড়া শেষ করেন, এর মধ্যেই বাবু চলে আসে পেটে।

বাবুর যখন পাঁচ বছর বয়স, সুকুমার হৃদরোগে চলে গেলেন। স্বামীর চাকরিটাই পেলেন মঞ্জুরী। ভাগ্যিস, লেখাপড়াটা শেষ করেছিলেন! নাহলে ওইটুকু ছেলের হাত ধরে কোথায় গিয়ে দাঁড়াতেন?


একা হাতে সন্তান সংসার সামলে নিজের শখটা, ইচ্ছেটা আর মিটিয়ে উঠতে পারলেন কই!


তবু এই শেষ বয়সে এসে ওই সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যানে একটু আধটু লেখার উৎসাহ পাওয়া যায়। ভালোও লাগে।


তুলির সাথে তেমনই এক লেখার মাধ্যমে পরিচয়। আস্তে আস্তে মেয়েটা কেমন জড়িয়ে গেল মঞ্জুরীর সঙ্গে। নতুন কিছু লিখলে মঞ্জুরী যেমন প্রথম তুলিকে পড়ায়, তুলিও তেমনি মঞ্জুরীকে না পড়িয়ে কোথাও দেয়না। দুপুরে ,রাতে রান্নার ছবি, মঞ্জুরী ঠিক সময় খেলেন কিনা, ঠিকঠাক ওষুধ নিলেন কিনা, সব দিকে তুলির কড়া নজর ছিল।

অবসরে চোখ বুজে ভাবেন মঞ্জুরী, নিশ্চয়ই গত জন্মে তুলি ওনার মেয়ে ছিল। হয়তো এ জন্মেও, একটা অতীত ঝাপটা দেয় মস্তিষ্কে। বিয়ের পর পরই অন্তঃসত্বা হয়ে পড়েন মঞ্জুরী, শ্বশুর মশাইকে লুকিয়ে তখন কলেজ যেতে হত। একদিন ক্লাসের দেরি হয়ে গিয়েছিল। দৌড়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে কলতলায় স্লিপ করে পড়ে যান, ছয় মাসের গর্ভজাত মৃত কন্যা মায়ের মুখ না দেখেই বিদায় নিলো।


বুকটা হুহু করে ওঠে মঞ্জুরীর। তুলি ঠিক তাঁর হারিয়ে যাওয়া সেই মেয়ে। নাহলে সম্পুর্ন অপরিচিত একজনের জন্য মনটা এমন আনমনা কেন হয়?শেষ কথা হয়েছিল পরশু রাতে।' শুভরাত্রি মণি' মেসেজটা এখনো জ্বলজ্বল করছে, কিন্তু নামের পাশের সবুজ আলো টা আর জ্বলছেনা। মঞ্জুরী ফোনও করেছিলেন মেসেঞ্জারে, কোনো উত্তর পাননি।

কেমন একটা অবিচ্ছেদ্য অদৃশ্য সম্পর্কের বন্ধনে জড়িয়ে গেছেন মঞ্জুরী তুলির সঙ্গে।

নানারকম দুশ্চিন্তা ভীড় করে এসে মনে, ঠিক আছে তো মেয়েটা!

এটা এমনই একটা ব্যাপার, কাউকে বলা যাবে না, কেউ বিশ্বাস করবে না, এভাবে কি কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তাও আজকের দিনে?

তাঁর নিজের সন্তান বাবুও তো সেই মুম্বইয়ে আটকে আছে। ফোনে যদিও যোগাযোগ থাকে, কিন্তু ওই টুকু সুতোয় মায়ে পো এর আলাপচারিতা বাঁধা আর যায় কই?

মঞ্জুরী অভিযোগ করে না। ওয়ার্ক ফ্রম হোম সেই সঙ্গে ডোমেস্টিক ওয়ার্ক সব তো নিজের হাতেই করতে হচ্ছে বাবুকে!


তবু ঠিক সময় করে সন্ধ্যেবেলা মঞ্জুরীকে ফোন করে যখন বলে, "কেমন আছো মা?"


প্রাণটা জুড়িয়ে যায় মঞ্জুরীর। যেদিন খুব চাপ থাকে কাজের, আলগোছে একটা মেসেজ ছেড়ে দেয় বাবু, যদিও সেটা খুবই অনিয়মিত।

গলার কাছে দলা পাকানো কষ্টটা বাড়তে থাকে।


বাবুকে কি জানাবেন তুলির কথা? বাবু যদি হাসে, বলে, "বুড়ো বয়সে মতিভ্রম হলো তোমার মা? ওরকম কত হয়!"

না, মঞ্জুরী জানেন, এরকম অনেক হয়না। কেবল একটি তুলি এবং একটি মঞ্জুরীর মধ্যেই হয়।


আরও একটা দিন কেটে গেল, মঞ্জুরী সকাল থেকে উঠে বাড়ির সমস্ত কাজকর্ম সারছেন, মাঝেমধ্যে দৌড়ে এসে দেখছেন তুলি এলো কিনা। না! তুলি আজও আসেনি। খাবার দাবারও কেমন যেন পানসে লাগছে আজ।


শেষ দুপুরে তুলির পুরোনো গল্পগুলো পড়তে পড়তে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন মঞ্জুরী, ফোনটা বেজে ওঠে। মঞ্জুরী দৌড়ে ফোন ধরেন, বাবু। তাইতো তুলি তো তাঁর নম্বর জানেনা। ইশ! এত বোকামি করলেন মঞ্জুরী? তুলির নম্বরটা চেয়ে রাখেন নি কেন আগেই? তাহলে ফোন করে অন্তত খবর নেওয়া যেত। আসলে সম্পর্কের সমীকরণ এমন এক শীর্ষস্থানে পৌঁছে গিয়েছিল যে এরকম একটা পরিস্থিতি আসতে পারে ভাবেননি মঞ্জুরী, হয়তো তুলিও ভাবেনি, তাই সেও তার মণি'র নম্বর চেয়ে রাখেনি।

অপ্রান্তে বাবু কথা বলে চলেছে। নেক্সট উইক থেকে ওর অফিস খুলবে। অন্যদিন মঞ্জুরী ছেলের সব কথা মনে দিয়ে শোনেন, আজ তাঁর মন অন্য কোথাও।

বাবু সম্বিৎ ফেরায়, "মা, কি হলো? তোমার শরীর ঠিক আছে তো?"


মঞ্জুরী আলগোছে বলেন, "মাথাটা বড্ড ধরেছে রে বাবু, একটু চা বানাই, তুই কাজ কর, আমি সন্ধ্যেবেলা ধরছি তোকে।"

ছেলের থেকে পালিয়ে বাঁচেন মঞ্জুরী। আবার চোখ চলে যায় মেসেঞ্জারে, কোথায় তুই তুলি? মণি কে কি একবারও মনে পড়ছে না রে?


ভোরের দিকে ঘুমটা ভেঙে গেল। মঞ্জুরী ফোন হাতে নিয়ে চমকে উঠলেন। তুলি দুই ঘন্টা আগে মেসেঞ্জারে একটিভ ছিল। চটপট একটা মেসেজ লেখেন মঞ্জুরী, *********মাই কন্ট্যাক্ট নম্বর,কল মি ইমিডিয়েট।


ফোনটা আসে ঠিক নটায়। রিসিভ করেই বাচ্চার মত ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন মঞ্জুরী, বলেন, "হ্যাঁ রে আমি কি তোর কেউ নই, কোথায় ছিলি এই দুদিন? রক্তের সম্পর্কই সব, নারে? মণি কে কি একবারও মনে পড়েনি?"

তুলি কাঁপা গলায় বলে, "সরি মণি, আসলে সেদিন সকালে উঠে দেখি ফোন ডেড। কিছুতেই অন হলোনা। বাড়ির কম্পিউটারটাও খারাপ হয়ে আছে, আর এখন যা পরিস্থিতি, বাইরে গিয়ে হুটহাট ফোন কিনবো কেমন করে? অনলাইন ফোনের অর্ডার দিয়েছি। গতকাল রাতে তোমার জামাইয়ের ফোন থেকে মেসেঞ্জার খুলেছিলাম, তারপরেই দেখি আজ সকালে তোমার মেসেজ। তুমি ঠিক আছো তো মণি? আই এম সরি!"

অজানা দুটি মানুষ অন্য ভালোবাসায় জড়িয়েও থাকতে পারে ঠিক, রক্তের টান না থাকলেও মমত্ব অনেক সময় অপত্য জাগিয়ে রাখে জীবন ভর। কারুর চোখে হয়তো বা ন্যাকামি, কিন্তু মনের চোখে দেখেন যাঁরা তাঁরাই বোঝেন, ভালোবাসার জন্য কাছের কোনো সম্পর্কের কিংবা রক্তের সাক্ষীর প্রয়োজন পড়ে না।।

মঞ্জুরী চোখ মুছে বলেন, "আগে কথা দে, পরের জন্মে আমার কোলে আমার আত্মজা হয়ে আসবি ঠিক?"


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance