Sucharita Das

Inspirational

3  

Sucharita Das

Inspirational

অঙ্গীকার

অঙ্গীকার

5 mins
716


পাশের বাড়ির ঋকের স্কুলে যাবার পথের দিকে তাকিয়ে আছে তনিমা। আর ভাবছে, সত্যি ওইটুকু একটা ছেলে, তার স্কুলের ব্যাগের ওজন মনে হয় তার দ্বিগুণ হবে। তার ওপর আবার ওর মায়ের হাতেও কি কি সব চার্ট পেপার ফোল্ড করে রাখা। সম্ভবত কোনো প্রোজেক্ট বানাতে দিয়েছে মনে হয় স্কুল থেকে। আচ্ছা ওইটুকু চার বছরের বাচ্চাটা কি প্রোজেক্ট তৈরি করবে কে জানে। কিন্তু ওই যে স্কুলের প্রোজেক্ট। অর্ধেক রাত পর্যন্ত জেগে ঋক আর ওর মা যুদ্ধ করেছে ওটা বানাবার জন্য। সত্যি কি অবস্থা আজকাল কার বাচ্চাদের। কোনো কিছুই নিজেদের ইচ্ছামত করতে পারে না ‌।অথচ তনিমা র মনে আছে, ওরা ছোটবেলায় কি আনন্দ টাই না করতো সব ভাইবোনেরা মিলে। একান্নবর্তী পরিবার ছিল ওদের, সারাদিন হই হুল্লোড় করেই কেটে যেত ওদের। কালবৈশাখীর ঝড়ে আমবাগানে ভাইবোনেরা সব দৌড়াদৌড়ি করে আম কুড়াতে যাওয়া। বর্ষার রাতে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে বাইরে, আর সব ভাইবোনেরা গরম গরম তেলে ভাজা আর মুড়ি খেতে খেতে, ঠাকুমা র কাছে ভুতের গল্প শোনা। আবার বর্ষার শেষে শরতের আগমনে ভোরবেলা শিউলি ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে সবাই মিলে শিউলি ফুল কুড়িয়ে নিয়ে আসা। আর পুজোর সময়? নতুন জামার গন্ধের বারবার আঘ্রান নেওয়া। আর একে অপরকে জিজ্ঞেস করা,কার কটা জামা হয়েছে। সেই সব দিনগুলো মনে দাগ কেটে আছে যেন তনিমার। অবসর সময়ে এখনও তনিমার এইসব পুরানো স্মৃতি রোমন্থন করে, মনে একটা অসম্ভব ভালো লাগার আবেশ তৈরি হয়।


অথচ এখনকার বাচ্চারা? কি যান্ত্রিক এদের জীবন। নিঃশ্বাস নেবার সময় নেই এদের কাছে। তনিমা তো শুধু ঋক কে দেখছে।এখন‌ তো প্রত্যেকটি ঘরেতেই এই ছবি। সারাদিন মায়েরা ব্যস্ত বাচ্চাদের পড়াশোনা, কম্পিউটার ক্লাস, নাচের ক্লাস, আবৃত্তি ক্লাস, ক্যারাটে ক্লাস এইসব নিয়ে। স্কুল থেকে ফিরে এসেই তাদের বিভিন্ন রকমের ক্লাসে অ্যাটেন্ড করতে হয়। ছুটির দিনে ও রেহাই নেই ওইটুকু ছোট্ট প্রাণ গুলোর। সেদিন বেচারা ঋকের এতটুকু ও ইচ্ছা ছিল না ক্যারাটে ক্লাসে যাবার। কিন্তু ওর মা ওকে জোর জবরদস্তি নিয়ে যাবেই। তনিমা থাকতে না পেরে ঋকের মা কে বললো,'আজ ছেড়ে দাও, যদি ওর ইচ্ছা না থাকে যাবার।' কিন্তু ঋকের মা বললো, একদিন না গেলে নাকি ও পিছিয়ে পড়বে অন্যদের থেকে। তনিমা অবাক কথাটা শুনে। একদিন ক্লাসে না গেলে ঋক এতটাই পিছিয়ে পড়বে যে,ওর শরীর খারাপ হলেও ওকে ক্লাস অ্যাটেন্ড করতেই হবে। সত্যি এই প্রতিযোগিতার যুগে কেউ কারও থেকে পিছিয়ে পড়বে , এটা তাদের পেরেন্টস রা ভাবতেই পারেনা। সবাই চায় তার বাচ্ছা প্রথম সারিতে থাক। তা সে পড়াশোনা হোক বা অন্যান্য এক্টিভিটি। সবেতেই নাম্বার ওয়ান পজিশন ইজ মাস্ট। 


এদের না কোনো খেলাধুলা করবার সময়, না কোনো বন্ধু। নিজেদের ঘরের মধ্যেই এরা বন্দী। কি করবে ঋক রা? সেকারণে ই কমবয়সে আসক্তি স্মার্টফোনের।আর একটু বড় বয়সে সোশ্যাল মিডিয়ার অন্যান্য নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি। দোষটা তো ওই বাচ্চা গুলোর না। কারণ ওদের এইসমস্ত জিনিসের প্রতি অভ্যস্ত আমরা করাচ্ছি। তনিমা অনেক সময় দেখেছে, ঋক যখন একদম ছোট ছিল,ওর মা ওকে মোবাইলে কার্টুন চালিয়ে দিত,, নইলে অন্য কিছু । তবে ও খাবার খেত। আচ্ছা এই ঋক যদি বড় হয়ে স্মার্ট ফোনে আসক্ত হয়ে পড়ে বা কিছু নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন সেই দোষটা কার হবে? তাকে তো সেই জ্ঞান না হওয়া থেকেই এই জিনিসের প্রতি অভ্যস্ত করে দেওয়া হয়েছে। অথচ তনিমার মনে আছে, ওরা ভাইবোনেরা সবাই একসঙ্গে কি সুন্দর খেয়ে নিত। কখনও কখনও তো মা একটা থালাতেই সব ভাই বোনদের খাইয়ে দিত গল্প করতে করতে। কি পরিতৃপ্তি যে ছিলো সেই খাওয়ার মধ্যে, তা আজ আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আজকালকার ছোট্ট ছোট্ট পরিবার, তাতে মা, বাবা আর একটা সন্তান।অন্য কারুর থাকবার জায়গা বেশিরভাগ ঘরেতেই হয় না। যাদের হয়, সেইসমস্ত বাচ্চারা ভাগ্যবান বা ভাগ্যবতী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাচ্চা আয়ার কাছে মানুষ। মা, বাবা দুজনেই কাজ করে। না হলে চলবেও না আজকালকার এই দুর্মূল্যের বাজারে। তার উপর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে আমাদের চাহিদা। যার থেকে মুক্তি র কোনো রাস্তা আমাদের জানা নেই। এই হচ্ছে আমাদের সমাজ।


কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা 'ছাড়পত্র' কবিতার লাইনগুলো আজ তনিমা র বড় বেশি করে মনে পড়ছে,"এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার"। সত্যিই কি আমরা এই পৃথিবী টাকে শিশু দের বাসযোগ্য করে তুলতে পেরেছি? প্রতিটা মূহুর্তে শিশু রা আজ মুক্তি চাইছে। হাঁপিয়ে উঠছে তারা প্রতি মূহুর্তে এই প্রতিযোগিতার যুগে পাল্লা দিতে দিতে। তাদের না আছে খেলবার অধিকার,না আছে নিজেদের শিশুসুলভ আচরণ প্রকাশের অধিকার। ছোট্ট থেকেই তাদের বলা হয়, তুমি অনেক বড়ো হয়ে গেছো। ছোট্ট কাঁধে ভারী স্কুলের ব্যাগ। এদের খেলা মানে বাড়িতে বসে ভিডিও গেম। কোনো শারীরিক পরিশ্রম নেই তাতে। ফলস্বরূপ ছোট বয়সে বিভিন্ন রকমের রোগের প্রাদুর্ভাব।পিজ্জা, বার্গার, বিরিয়ানি, বিভিন্ন রকমের মুখরোচক ফার্স্ট ফুড এদের প্রথম পছন্দ। কোনো বাচ্চা যদি এগুলো না জানে, তাহলে তো সমাজে সে পিছিয়ে পড়বে। সত্যি কোন্ পৃথিবীতে আমরা বাস করছি। যেখানে জামাকাপড়, খাবার, লাইফ স্টাইল এইসব দেখে মানুষকে বিচার করি আমরা। আর এইসব ধারণা আমরা নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও শেখাচ্ছি। সেদিন ঋক আর ওর মায়ের সঙ্গে তনিমা মার্কেটে গিয়েছিল একটু। শপিং মলের বাইরে একটা রোগা, পাতলা , শ্যামলা রঙের ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল। কতো আর বয়স হবে। হয়তো ঋকের থেকে বছর খানেকের বড়ো। ওরা শপিং মলে ঢোকার আগে তনিমা ঋককে কিছু চিপসের প্যাকেট, চকোলেট কিনে দিয়েছিল। ছেলেটির সম্ভবত খুব খিদে পেয়েছিল। ঋকের হাতে ধরে থাকা প্যাকেট গুলোর দিকে তাকিয়ে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল সে। তনিমা অবাক হয়ে দেখলো ঋক ওর থেকে একটা প্যাকেট বাচ্চা ছেলেটার দিকে এগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ঋকের মা ঋকের হাত ধরে ওকে টানতে টানতে নিয়ে গেল শপিং মলের ভিতর। বেচারা ঋক ঠিক বুঝতে পারছিল না যে ও কি অপরাধ টা করেছে।ওর কাছে তো অনেক গুলো চিপসের প্যাকেট ছিল। তাই ও একটা দিতে গিয়েছিল। এতে অপরাধ টা কোথায় ওর। ঋকের মনে ওই বাচ্চা টা কে দেখে যে মানবিকতা বোধের জন্ম হয়েছিল , সেটা কিন্তু ওর মা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিলো।কি শেখাচ্ছি আমরা নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে?যে নিজের নিয়ে থাকো শুধু। আর আশেপাশের কাউকে দেখার দরকার নেই। কিছুদিন পর তো এই বাচ্চাটা বড়ো হয়েও এটাই শিখবে। কোনো রকম শেয়ারিং সে অ্যাডজাস্ট করবে না। তা সে খাবার হোক বা অন্য কিছু। আর এই অ্যাডজাস্টমেন্ট না করার ফলস্বরূপ আমাদের দেশে বাড়ছে বৃদ্ধাশ্রমে মা বাবা কে পাঠিয়ে দেবার প্রবণতা। পুরাতন চিন্তা ধারার সঙ্গে নতুন চিন্তাধারার অমিল ও এক্ষেত্রে একটা বড়ো কারণ।


ঋক কে তার মা যদি শুরু থেকেই একটা ভালো সুস্থ পরিবেশ উপহার দেয়, তাহলে হয়ত ঋক ভবিষ্যতে একজন প্রকৃত অর্থেই ভালো মনের মানুষ হতে পারবে। কারণ তার মধ্যে যে মানবিকতা বোধ আছে, তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। শুধু ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবার কথা না বলে, সে যেন একজন ভালো মানুষ হয়ে উঠতে পারে, সে দিকে ও লক্ষ্য রাখা আমাদের দায়িত্ব। তবেই তো এই পৃথিবীকে প্রকৃত অর্থে প্রত্যেকটি শিশুর বাসযোগ্য করে তুলতে পারবো আমরা, আর এটাই আমাদের অঙ্গীকার হোক আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে।      


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational