অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি


শীতের শেষ প্রায়.....সন্ধ্যে সাতটা বাজে।আমি নিজের রুমে পড়াশোনাতে মন দিতে ব্যস্ত মা গেছে পাশের ঘরের দিদার বাড়ি আর বাবা বোনকে নিয়ে গেছে নাচের ক্লাস এ ।
আমার পরিচয়টা দিই... আমি বাবলি, কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী। কিছুদিন পর সেকেন্ড সেম শুরু হবে। মা-বাবা বোনের সাথে থাকি। ঠাকুর ঘরে প্রদীপ দিয়ে সমস্ত রুমে আলো জ্বালিয়ে বেরোনোর সময় মা আমাকে বলল, "বাইরের দরজার ছিটকানিটা লাগিয়ে দিতে"। কত সুন্দর করে বই খাতা সাজিয়ে বেড টেবিলটা নিয়ে পড়তে বসেছি আর উঠতে ইচ্ছা করল না, বাধ্য হয়ে মা বাইরে থেকে ছিটকানি লাগিয়ে দিয়ে গেল। বলল… কিছুক্ষণ পরেই ফিরে আসবে। আমাদের বাড়িটা একটা ছোট্ট খাটো দোতালা বাড়ি নিচে পাঁচটি রুম, মাঝে ডাইনিং রুম, তার এক পাশে আমার আর বোনের রুম। পাশে রান্নাঘর, ওপাশে দাদুর রুম আর বাইরে ঠাকুর ঘর। বই খাতা পেন নিয়ে বসে কত চিন্তা যে মাথায় আসছে।
ভাবছি…......
এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত কত ঝড় যে পার হলো আমাদের পরিবারের উপর দিয়ে তার ঠিক নেই। বোন এরও কিছুদিন আগে মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হল। গ্রামের বাড়ির বড় দিদা মারা যাওয়ার চার মাসের মাথায় দাদু ও চলে গেল। দাদু… বড্ড আদরের সম্পর্ক। আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসত। কত্ত গল্প শুনাতো পুরনো দিনের লুকিয়ে লুকিয়ে কি বদমাইশি না করতাম আমরা… ধরা পড়ে যেতাম। কখন যে দাদু উপস্থিত হয়ে যেত বুঝতেই পারতাম না। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যেত না। খুব ধীরে সুস্থে হাটতো।বুনু মজা করে বলতো "দাদু বিড়াল পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় না"। ভাবলেই হাসি পাচ্ছে.. পেশায় ডাক্তার ছিল দাদু ।কলকাতাতে ডাক্তার শান্তিরঞ্জন সাহার সাথে চেম্বার চালাতো। পরে নাকি দাদু তার বাবার জন্য বাধ্য হয়ে সব ছেড়ে চলে এসেছিল।গ্রামের বাড়ি থেকে আসা যাওয়া করে এখানে চেম্বার করতো। পরে এই বাড়িটা কিনেছিল। এই বাড়িটা আগে একতলা ছিল। চারদিকে ঝোপ জঙ্গল। পরে পুরোটা বাউন্ডারি দিয়ে সেটিং করে দোতলা করা হয়।
শখ করে বেশ সুন্দর নকশা করা গেট বসিয়েছিল দুটো । একটা ছোট ,একটা বড়। ছোটটা আমাদের যাতায়াতের জন্য আর বড়টা চারচাকা car এর জন্য ।ইচ্ছা ছিল car নেওয়ার। তিল তিল করে টাকাও জমিয়েছিল কেনার জন্য ,তারপর সব ওলট পালট হয়ে গেল । এখন বড়গেটটা সবসময় তালা দেওয়া থাকে।
বড্ড সরল মানুষ ছিল দাদু। তার প্রিয় বন্ধু তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বসল। যা কিছু জমা পুঁজিছিল সব ডুবে গেল। ধাক্কাটা সহ্য করতে পারেনি দাদু। ব্রেইন স্ট্রোক হয়ে গেছিল। চেম্বারেই পড়ে রয়েছিল দরজা বন্ধ করে। মায়ের সন্দেহ হয়েছিলো কল্ রিসিভ না করায়।3 টে হসপিটাল আর নার্সিংহোম ঘোরার পর সে যাত্রায় বেঁচে ফিরেছিল কিন্তু মাথার মধ্যে রক্ত জমে রয়ে গেছিল। ডাক্তাররা অপারেশন এর রিস্ক নেয়নি।
তারপর থেকে বাড়িতেই থাকতো দাদু ।আমাদের ভালোই লাগতো একসাথে সময় কাটাতাম ।সেই পুরনো দিনের গল্প শুনতে পেতাম ..গিটার শেখার নাকি খুব শখ ছিল দাদুর। আমাদেরকে বলত .."জানিস আমাদের তখন খুব কষ্টের সংসার ছিল রে ,এমনও দিন গেছে যেদিন স্কুল লাইফে টিফিনে জল খেয়ে কাটিয়েছি ।গিটার কেমন করে শিখবো। পরে কলেজ লাইফে যখন টুকিটাকি টিউশন পড়াতে শুরু করেছিলাম তখন ভেবেছিলাম যে শিখলে হয় ।স্যারের সাথে যোগাযোগও করেছিলাম কিন্তু গিটার কেনার টাকা জোগাড় করতে পারিনি ।"
খারাপ লাগত শুনে ..আজ আমরা নাচ শিখছি ,গান শিখছি, ড্রইং শিখছি অথচ আমাদের দাদু টাকার অভাবে গীটার শিখতে পারেনি।
বছর চারেক এভাবে কেটে গেল ।মাঝে মাঝে অনেকেই বাড়িতে আসত দাদুর সাথে দেখা করার জন্য ,তাদের সাথে জমিয়ে গল্প করতো দাদু ।তারপর ধীরে ধীরে স্মৃতি লোপ পেতে লাগলো ..কিছুক্ষণ আগের কথাও ভুলে যেতো, নাম ভুলে যেত ।আমাকে বোনের নাম ধরে ডাকতো । কিন্তু চিনতে ঠিক পারতো। কিছু কিছু কথায় এমন মনে রাখত মাঝেমাঝে আমরা অবাক হয়ে যেতাম।
প্রেসার সুগার বাড়তে লাগলো ।বাড়িতেই চিকিৎসার ব্যবস্থা হল ।দেখাশোনার জন্য একজন কেয়ারটেকার রাখা হল ।
গ্রামের বাড়িতে যখন বড় দিদা মারা গেল মা বাবা কিছুই জানালো না দাদুকে ।যাওয়া আসা করে মামাকে সঙ্গে নিয়ে ওখানের কাজ সব পার করলো ।আমি জিজ্ঞাসা করাতে মা বলল .."শেষ সময় মানুষটাকে আর কষ্ট দিতে চাই না ..থাক্ ।"
বড্ড হাসি খুশি মনের মানুষ। কিছু পছন্দ হলে আমাকে আগে দেখাতো ।আমার আর বোনের জন্য একই রকম ড্রেস এনে দিত ।সব কথা বলতো আমাকে, আমিও বলতাম ।সব ঘটনা শোনাতাম আমার..সঅঅঅঅব....
রোজ বিকেলে কানে হেডফোন নিয়ে গিটার গান শোনা রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছিলো দাদুর ।দাদু মারা যাওয়ার 6 দিনের দিন আমিও একটা গিটার কিনেছি। গিটার স্যার কিনে দিয়েছেন ।10 দিনের দিন বাড়িতে স্যারের সাথে গিটার নিয়ে গান করেছি" পুরানো সেই দিনের কথা.."। এখন সপ্তাহে একদিন করে ক্লাস করি ।একটু আগে প্র্যাকটিস করছিলাম দাদুর রুমে বসে ।যাহ্... গীটার টা তুলে রাখতেই ভুলে গেছি। বিছানার উপরেই পড়ে আছে। মা আসুক ,মাকে বলবো তুলে রেখে দিতে আর উঠতে ইচ্ছে করছে না। জলের বোতলটা সামনেই রাখা আছে ,একটু জল খাই বরং।
শেষ সময়ে বড্ড কষ্ট পেল দাদু ।বিছানাতে শুয়েই দিন কাটতো।কোমরে ঘা হয়ে গেছিল ।ব্রেনের প্রবলেম এর জন্য খিঁচুনি হত যখন-তখন ।মাথার কাছে বসে থেকেই আমাদের সকাল হতো ।আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো জলভরা চোখে ,যেন কাউকে খুঁজছে। খিঁচুনি আর থামছিল না ..ছটফট ছটফট ..স্যালাইন ..ইনজেকশন... উফ্ফফফফ......
যাহ্... পেনের আঁচল লেগে গেল বইটাতে ।চোখগুলো জলে ভরে গেছে ,মুঝে নিই।
মা এখনো আসছে না কেন !!দেখি মোবাইলটা ,গ্রুপে কি কি নোটস্ দিয়েছেন স্যার ,ওগুলো একটু বসে বসে করি ।নাম্বার ভালো না তুলতে পারলে তখন আবার সমস্যা ।
বাইরের ছোট গেটের আওয়াজ পেলাম মনে হলো !মা এল বোধহয় ।আসুক ভেতরে ,তারপর গীটারটা রাখতে বলছি। মাঝের রুমে চেয়ার টানার শব্দ , বসল বোধহয়। উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করলাম নাহ্.. পর্দাটার জন্য দেখতে পেলাম না ।বসুক একটু ,ক্লান্ত হয়ে গেছে হয়তো। দিদারও তো শরীর ভালো নেই ,তাই ওখানে গিয়ে টুকিটাকি কাজগুলো করে আসে । বুনুরাও এবারে চলে আসবে ।ক্লাস এতক্ষনে শেষ হয়ে গেছে।
গিটারের আওয়াজ!!!! 1..4..2 ..তিনটে তার পর পর বাজালো!! মা তো গিটার বাজায় না!! কার এত সাহস হলো রে বাবা ..যে সোজা দাদুর রুমে ঢুকে গীটারে হাত দিচ্ছে আমার !!দেখিতো...
বই খাতা মোবাইল সরিয়ে রেখে নামতে যাচ্ছি ..হঠাৎ করে পর্দাটা সরররর্ করে সরে গেল। একটা ঠান্ডা বরফের স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে ।গলার কাছে যেন একটা শক্ত পিণ্ড আটকে গেল। ভুল দেখছি কি?? চোখ দুটো ভালো করে মুছে আবার তাকালাম ..নাহ্ ভুল নাহ্.. পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছে দাদু ।সুস্থ সবল শরীর ।সেই কালো প্যান্ট আর চেক শার্ট, চোখে চশমা, বাঁ হাতে ঘড়ি, ডান হাতে দুটো আঙ্গুলে আংটি, মুখে মুচকি মিষ্টি হাসি ..তাকিয়ে আছে আমার দিকে ।এবারে হাসিটা একটু বাড়লো ,সামনের কয়েকটা দাঁত দেখা গেল ।আমিও হাসলাম ।আনন্দে দুচোখ আবার জলে ভরে গেল ।নামতে গেলাম বিছানা থেকে ..দাদু পর্দা ছেড়ে সরে গেল ।চিৎকার করে ডাকলাম ,দাদুউউউউউ..... ছুটে বেরোতে গিয়ে চৌকাঠে হোঁচট খেলাম। পর্দা সরিয়ে ডাইনিং রুমে ..নেই.. দাদুর রুমে ..নেই.. গিটার পড়ে আছে বিছানার উপরে ।দৌড়ে বার হলাম সদর দরজায়..পা টা ব্যাথায় টনটন করে উঠলো । বাইরেটা পুরো দেখা যাচ্ছে.. কেউ কোত্থাও নেই ,শুধু ছোট গেটটা হাট্ করে খোলা !!!