STORYMIRROR

Geetashree Chatterjee

Horror Others

4.0  

Geetashree Chatterjee

Horror Others

অবিনাশ বাবুর হবি

অবিনাশ বাবুর হবি

6 mins
120

অবিনাশ বাবু ছাপোষা লোক। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কেরানির কাজ করছেন বহু বছর ধরে। অবিবাহিত তাই কোনো হুজ্জুত নেই। সপ্তাহে পাঁচ দিন নটা টু পাঁচটা অফিস। শনিবার সকালে একটা স্কেচ বুক নিয়ে বেরিয়ে পড়া। হ্যাঁ - অবিনাশ বাবুর এই এক হবি। যত অজানা, অচেনা মফঃস্বল, গাঁয়ে, গঞ্জে ঘুরে ঘুরে ভাঙ্গাচোরা বাড়ি খুঁজে বার করা, যেই বাড়িতে কেউ বসবাস করে না - পরিত্যক্ত; তার ছবি আঁকা; শুধু ছবি আঁকা নয় - সেই বাড়িটি যদি আবার নতুন করে গড়ে তুলতে হয় তাহলে তার রূপ কেমন হতো বা হতে পারে - মানে আগাগোড়া নতুন - প্রত্যেকটা ঘরদোর, বারান্দা, রান্নাঘর, বাথরুম ইত্যাদি - তার ও স্কেচ তৈরি করা।

এককালে অবিনাশ বাবুর আর্কিটেকচার নিয়ে পড়াশোনা করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু যৌথ পরিবারের দায়িত্ব, অভাব অনটন, ওই যা হয় আর কি। কিন্তু অবিনাশ বাবু ওনার কলেজ জীবনের আকাঙ্ক্ষাকে হবি বানিয়েই এখন পরিতৃপ্ত। পয়সাও বেশি খরচ হয় না আবার প্যাশনেরও খিদে মেটে। মানে একটা মাঝপথ বেছে নেওয়া এই আর কি। এই মাঝপথই মধ্যবিত্তদের মেরুদন্ড - সমঝোতা, অ্যাডজাস্টমেন্ট, কম্প্রোমাইজ - করেই সন্তুষ্ট থাকা।

এই সপ্তাহান্তে অবিনাশ বাবু পাড়ি দিলেন বেশ কিছুটা দুরে। গুগলে দেখে। ট্রেনে করে চাকদা। তারপর বাসে করে অক্ষ নামে এক অজ গ্রাম। সেখান থেকে সাইকেল রিকশা করে তালিপুর। তার আগে কোনো বাহন যায় না। তাই হাঁটা দিতে হলো। অবিনাশ বাবুর তাতে কোনো আপত্তি নেই। আজ ভোরে বৃষ্টি হওয়াতে গরম বেশ কম। ফুরফুরে হাওয়া ও দিচ্ছে। অবিনাশ বাবু এরকম বহু পায়ে হেঁটে সফর করেছেন। এবার অবশ্য একটু বেশি হাঁটতে হলো। 

ধু ধু করছে মাঠ। মাঠ যেখানে শেষ সেখানে বাড়িটা শুরু। একেবারে ঝরঝরে। দরজা জানালা বলতে প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই। আছে শুধু বাড়িতে ঢোকার গেটটা। গেটের উপর একটা গাছ ঝুঁকে পড়েছে। কামিনী ফুলের বোধহয় । ফুল হয় কি হয় না কিন্তু গাছটা আছে। গেটের সামনে একটা ভাঙ্গা রোয়াক। অবিনাশ বাবু রোয়াকে বসে গেট দিয়ে উঁকি মারলেন। বেশ অনেক খানি জায়গা পেরিয়ে কিছু ধাপ সিড়ি উঠে গেছে। মোটা মোটা থাম দিয়ে ঘেরা বারান্দায়। থামগুলো যে এখনও দাঁড়িয়ে আছে দেখে অবিনাশ বাবুর অবাক লাগলো। খালি জায়গাটায় এক সময় মনে হয় বড় একটা পুকুর ছিল। সেই পুকুর ঘিরেই বাড়িটা। 

অবিনাশ বাবু অনেক ক্ষন বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন। এত বাড়ি ঘেটেছেন, এঁকেছেন, আগাগোড়া নতুন ভাবে গড়বার চেষ্টা করেছেন কিন্তু এই বাড়িটার একটা আলাদা ব্যাপার আছে। ব্রিটিশ আমলের তো বটেই তার ও চাইতে পুরোনো হতে পারে। এখনও যে টিকে আছে এটা আরেকটা আশ্চর্য। তাছাড়া এই রোয়াকে বসে অবিনাশ বাবুর কেমন একটা আচ্ছন্ন ভাব ঘিরে ধরছে। মনে হচ্ছে যেন -

"সো ইউ হ্যাভ অ্যারাইভড" - অবিনাশ বাবু চমকে পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলেন একজন খ্যাংরা কাঠির মতন ঢ্যাঙা লোক দাঁড়িয়ে মুচকি হাঁসছে । পরনে তার ময়লা, অনেক বছরের পুরনো , বহুল ছিদ্রযুক্ত গেঞ্জি আর ততোধিক ময়লা ও ছিদ্রযুক্ত ধুতি ল্যাঙ্গটের মতন করে জড়ানো। কিন্তু চোখের চাহনিটি প্রখর, বুদ্ধিদীপ্ত। আর ইংরিজিটা তো এ্যাকেবারে পারফেক্ট প্রায় ইংরেজদের মতন। গলার স্বরটা ও গম্ভীর তবে ঠোঁটের কোণের হাঁসিটি শিশুসুলভ।

এ বাড়িতে যে কেউ বাস করে অবিনাশ বাবুর জানা ছিল না। উনি নিতান্তই অপ্রস্তুত ভাবে সেটা জানাতে লোকটি প্রাণ খুলে হা হা করে হেঁসে বলল,"সেটা কোনো ব্যাপার নয়। অনেকেই হয়ত এটা জানেনা। আর আপনার গুগল বাবাজির তো একদমই জানার কথা নয়। তবে আপনি আপনার কাজ চালিয়ে যান। স্কেচটা কি কমপ্লিট?"

অবিনাশ বাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, " আপনি কি করে জানলেন আমি স্কেচ করতে এসেছি?" ভদ্রলোক অবিনাশ বাবুর কোলের উপর রাখা খোলা খাতাটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন। অবিনাশ বাবু ভুলে গেছিলেন কখন ভাবতে ভাবতে উনি খাতাটা খুলে ফেলেছেন। 

" না , এখনও শুরু করিনি। জায়গাটা ফীল করছিলাম।"লোকটি পাশে এসে বসে মাথা নাড়লো, " এই বাড়ির লম্বা ইতিহাস। বুঝলেন অবিনাশ বাবু।"

অবিনাশ বাবুর আবার অবাক হওয়ার পালা। "আমার নামটা....?" উত্তরে মুচকি হাঁসি আবার স্কেচ বুকের দিকে আঙুল দেখানো। "যখন কাজ আরম্ভই হয়নি তাহলে আগে একটু চা হয়ে যাক। তবে এখন কিন্তু দ্বিপ্রহরের খাবার সময়। "

অবিনাশ বাবু মোবাইলে দেখলেন সময় বারোটা পঁয়তাল্লিশ। সত্যিই তো এতখানি সময় কেটে গেছে উনি খেয়ালই করেননি ।

"তাহলে রান্নাটা চাপিয়ে চায়ের ব্যবস্থা করে আসি।" শত মানা করা সত্বেও ভদ্রলোক শুনলেন না। " আমি কিন্তু ভালো রন্ধন জানি। একটু সময় লাগবে। তবে তার আগে চা। " বলে লোকটি উঠে গেট দিয়ে ঢুকে বারান্দায় থামের আড়ালে যেন মিলিয়ে গেল।

অবিনাশ বাবু বসে রইলেন। এই প্রথম তাঁর স্কেচ বানাতে ইচ্ছে করছে না। এটাকি এতটা পথ হেঁটে আসার ক্লান্তি? না: বাড়িটার একটা অদ্ভুত আকর্ষণ অবিনাশ বাবুকে বার বার আচ্ছন্ন করে ফেলছে। মনে হচ্ছে যেন চোখের সামনে অনেক রকমের দৃশ্য দেখছেন। যখন এই বাড়িতে বসত ছিল। লোকেদের আনাগোনায় ভরপুর। এই মাঠটা যখন জনপদ ছিল। ঘোড়ার গাড়ির শব্দ। দারোয়ানের হাঁক। বাবুদের পায়ের জুতোর মচমচে আওয়াজ সিড়ি বেয়ে নেমে আসছে ।

ভদ্রলোক দু খুঁড়ি চা নিয়ে হাজির। কাপ নয় । গেলাস নয়। খুঁড়ি । অবিনাশ বাবু অবাক হওয়ার ক্ষমতা ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে। চুমুক দিলেন। চাটি চমৎকার। দামী, সুগন্ধি চা। 

"কি স্কেচ হলো?" ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন ।

অবিনাশ বাবুর না শুনে উনি আবার মাথা নাড়লেন।

"এই বাড়ির অনেক দিক আছে। একদিনে আপনার স্কেচ তৈরি হবে না। আপনি বরং দু এক দিন থেকে যান। ঘুরে ফিরে ভালো ভাবে দেখুন তারপর না হয় আঁকবেন।"

অবিনাশ বাবু অফিসের অজুহাত দিয়ে মানা করতে, ভদ্রলোক কথাটা "অফিস থেকে ছুটি ও তো নেওয়া যায়" বলে একদম উড়িয়ে দিলেন। অবিনাশ বাবুকে বাইরেটা ভালো করে ঘুরে দেখে স্কেচটা কিরকম বানাবেন তার আইডিয়া নিতে আর "আমি রান্না সেরে আসছি" বলে আবার থামের আড়ালে উধাও হলেন।

অবিনাশ বাবু বেশ কিছুক্ষণ বসে থেকে ঠিক করলেন আর না। স্কেচ আজকেই মোটামুটি শেষ করে বাড়ি ফিরবেন। আবার না হয় আরেকদিন ভদ্রলোকের আতিথেয়তা গ্রহণ করা যাবে। তবে এই ভগ্নাবশেষ ভবনে অতিথি সেবার কি করে ব্যবস্থা হতে পারে অবিনাশ বাবুর বোধগম্য হলো না।

মোবাইলে দেখলেন বিকেল চারটে। ভদ্রলোক বেশ কিছুক্ষণ হলো ভেতরে গেছেন। অবিনাশ বাবুর পেটে একটা কুনকুনে ব্যথা উঠছে। অনেক ক্ষণ না খেলে পেট খালি থাকার ব্যথা। সেই ভোর পাঁচটা নাগাদ এক কাপ চা আর দুটো মারি বিস্কিট খেয়ে বেরিয়েছেন। সাধারণত: পথেই কোনো দোকানে অবিনাশ খেয়ে নেন। কিন্তু আসার পথে এমন কোনো দোকান ও পড়েনি আর অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় খাবার কথা মনেও ছিল না। 

অবিনাশ বাবু কাঁধের ঝোলায় হাত গলিয়ে পেন্সিল আর রাবার টা বার করলেন। এই যা:!পেন্সিলটা যে এক্কেবারে নতুন। ছোলা হয়নি। ব্যাগে হাত গলিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করে ও সার্পনারটা পেলেন না। কাটারটা ও তাড়াহুড়োতে আনতে ভুলে গেছেন । এখন একমাত্র বিকল্প বাড়ির ভেতরে ঢুকে রান্নাঘর থেকে একটা ছুরি চেয়ে নেওয়া। অবিনাশ বাবু পা বাড়ালেন।

বাইরে সূর্য্য পশ্চিমের দিকে হেলে পড়েছে। তবু ও আলোর রেশ আছে কিছুটা। দালান পেরিয়ে ভিতরটায় ভীষনই কম আলো। অনেক গুলো ঘর। রান্নাঘরটা কোন দিকে অবিনাশ বাবু অনেক ঘুরেও ধরতে পারলেন না। বাড়ি নয় যেন ভুলভুলইয়া । একবার ভাবলেন বেরিয়ে পড়া যাক। আজ এখানেই ইতি। কিন্তু অবিনাশ বাবুর সেটা স্বভাব বা এতদিনের অভ্যাস বিরুদ্ধ। হঠাৎ খুক খুক করে কাশির আওয়াজ এলো ।অবিনাশ যেখানে দাঁড়িয়ে ঠিক তার বাঁ দিকে। এগিয়ে যেতেই দেখলেন ঠিক ধরেছেন। এটাই রান্নাঘর আর ভদ্রলোক একটি মাটির উনুনের সামনে উবু হয়ে বসে আছেন। উনুনটি কিন্তু নেভানো। আদৌ জ্বালানো হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। সারা ঘরে রান্নার কোনো সামগ্রী বা বাসনপত্র নেই। রান্না হয়েছে বলে মনেই হয় না। 

ভদ্রলোক স্মিত হেসে আপ্যায়ন করলেন। যেন জানাই ছিল যে অবিনাশ আসবেন। " আসুন! আপনি ঠিক জায়গায় এসে পড়েছেন।" 

"না মানে একটা ছুরি হবে। পেন্সিল কাটারটাই আনতে ভুলে গেছি।" অবিনাশ লজ্জিত হয়েই বললেন।

"হ্যাঁ! সব আছে। ছুরি, কাঁচি, দা। এই নিন " বলে ভদ্রলোক হাত বাড়ালেন। তাঁর হাতে চকচকে একটি ছুরি যেন এখনই শান দেওয়া হয়েছে। আর ছুরির গাঁয়ে ওটা কি লাগা - কালচে লাল রং? রক্ত না! আর ঠিক সেই সময় ঘর অন্ধকার কর সুজ্যিদেব টুপ করে আকাশের পশ্চিম কোনে ডুব দিলেন।

***

অবিনাশ বাবুর সেবার স্কেচ করা হয়েছিল কিনা জানিনা তবে দু সপ্তাহ আগে খবরের কাগজে একটি ছোট পুলিশী বিজ্ঞপ্তি বেরিয়েছিল।

নাম - অবিনাশ সেনবয়স - ৪০ বছরউচ্চতা - ৫.২"গায়ের রং - ফর্সানাকের ডান পাশে একটি আঁচিল আছেপরনে - কালো প্যান্ট আর সাদা বুশ শার্টমানসিক স্তিথি - সুস্থশনিবার ৮ই এপ্রিল ২০২৩ থেকে নিখোঁজ

একটা ছবিও দেওয়া ছিল। এই ব্যক্তিটির কোনো খবরাখবর পেলে অমুক থানায় জানাতে। 

আপনারাও একটু খেয়াল রাখবেন। ভদ্রলোকের কাঁধে ঝোলায় একটা স্কেচ বুক, নতুন পেন্সিল আর রাবার পেলেও পেতে পারেন। এঁকে শেষ তালিপুর, চাকদা জেলার আশেপাশে দেখা গেছে।

***


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror