অভিভাবকত্ব
অভিভাবকত্ব
শম্পা ও বিধান সেই গোষ্ঠীর মানুষ, যেসমস্ত গোষ্ঠীর
মানুষ তার নিজের ঘরদোর সাজায় বাড়িতে অতিথি আসার কথা থাকলে। জানালায় নতুন পর্দা লাগায়, বিছানায় পাতে বাহারি বেডকভার, ঝাড়পোঁছ করে আসবাব সামান্য এধার ওধার করে সুন্দর করে গোছায়, ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখে রঙিন টাটকা ফুলের তোড়া। গৃহস্বামী ও গৃহকর্ত্রীর রুচির প্রশংসা করে অতিথি। তারপর অতিথি একসময় ফিরে যায় আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে। টেরই পায় না এই গৃহের নিপুণ অঙ্গসজ্জা দিয়ে আসলে বাড়ির সত্যিকারের বিবর্ণ দশাটা লুকোনোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন বাড়ির মালিক। বাড়ির মালিকপক্ষ শুধুমাত্র জানেন আসল কথাটিকে।
তবু সেই বিবর্ণ সংসারেও প্রেম আসে, ভালোবাসার বাঁধনে জড়িয়ে পড়ে মানুষের অস্তিত্ব। শম্পা আর বিধানের সংসারেও প্রেম যে কোন ফাঁকে ঢুকে পড়েছিলো, তার আগাম হদিশ ওদের কাছে ছিলো না। আর তাই পনেরো বছর আগের এক আখরোট কাঠের তৈরি বাক্সে কখন যে কি করে একটার পর একটা চিঠি জমা হয়েছিলো তা ওরা জানতেই পারেনি। ওদের সদ্যকিশোরী মেয়ে যে কখন তরুণী হয়েছে তাও হয়তো চোখ এড়িয়ে গিয়েছিলো, অভ্যাসবশে চোখেই পড়েনি মেয়ের চোখের স্বপ্নের রং। কখন যে মাথা তুলেছে মেয়ের চোখে স্বপ্নের ছোট্ট চারাগাছ, তা শম্পা বিধানের চোখ এড়িয়েই গিয়েছিলো। ওদের একমাত্র মেয়ে ববি সেদিন যখন জিনস পরে স্কুটি চালিয়ে চলে গেলো, তখনও শম্পা জেগে স্বপ্ন দেখছিলো যে ওদের সদ্যযুবতী কন্যা ববির বিয়ে হচ্ছে। শম্পার কল্পনায় তখন ববি অপূর্ব নববধূর সাজে, পরনে আধুনিক লেহঙ্গা চোলি, লাল স্বচ্ছ ওড়নায় মাথার সুন্দর হেয়ারস্টাইল চাপা। ববি বিয়ের পোশাক পরে যেন র্যাম্পে হাঁটার মতো করে চলছে, পাশে ববির সদ্যোবিবাহিত স্বামী। অচেনা এক মুখ। সুন্দর, বলিষ্ঠ এক তরুণ। ফোনের কর্কশ আওয়াজে শম্পার স্বপ্নভঙ্গ এক মুহূর্তে।
ফোনের কথোপকথনের পরে শম্পার থমথমে মুখ, বিধানের মাথায় হাত ঠেকিয়ে বসে থাকা সকলের চোখের আড়ালে। শম্পা যত্ন করে তুলে রাখলো ববির জিনিসপত্রগুলো এক এক করে। তারপর আলমারি খুলতেই আবিষ্কার হলো ঐ আখরোট কাঠের বাক্সটা। বাক্সটা শম্পা কিনে দিয়েছিলো মেয়েকে ইমিটেশনের গয়না রাখার জন্য, ডাল লেকের ভাসমান বাজার থেকে। কাশ্মীর ভ্রমণের স্মৃতি। একটা, দুটো, তিনটে, চারটে... আর পড়তে পারলো না শম্পা। গুনতেও প্রবৃত্তি হলো না। শম্পা সন্তর্পণে বাক্সের ভেতরকার চিঠিগুলো আলগোছে আড়াল করে তুলে নিয়ে গেলো রান্নাঘরে। তারপর গ্যাস ওভেন অন করে চিঠিগুলো ছুঁড়ে দিলো আগুনে। সরল বিশ্বাসে শম্পা সব প্রমাণ, সমস্ত স্মৃতির নিশানি ধ্বংস করে দিয়ে ভাবলো, মুক্তি ঘটলো হয়তো। কিন্তু সেই যে এক একটি মুহূর্ত দিয়ে গড়া শম্পার একুশ বছরের মাতৃত্ব তাতে মুক্তি পেলো কি? শম্পার চোখ ঝাপসা হয়ে অকাল শ্রাবণধারা। ওদের পাশের বাড়ীর নিষ্পাপ এক বালক, জয়দীপ। পাড়ারই ছেলে জয়, সর্বক্ষণ ঘরে আসছে যাচ্ছে, হৈ হল্লা করছে, পরিবারেরই একজন যেন। দু-একদিন শম্পার চোখে পড়েছে ওদের বাগানের গাছের নীচে রেখে আসে কিছু একটা। ছেলেমানুষী খেলার অঙ্
গই ভেবেছে শম্পা। গুরুত্বই দেয়নি কখনো দেখার, কী রাখা আছে গাছের তলায়? তারপর নিষ্পাপ বালক জয় বড়ো হয়েছে। সে এখন যুবক। এলোমেলো অগোছালো এক যুবক। মাঝে একবার কোথায় যেন গিয়েছিলো চাকরি নিয়ে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ফিরেও এসেছিলো। কেমন ক্লান্ত, শ্রান্ত। বাড়ীতে আর আসতো না বহুকালই। কখনো সখনো রাস্তায় দেখা হয়ে গেলে হালকা হাসি বিনিময়। শম্পা বলেছে, "চা খেতে আসিস মাঝে মাঝে।" হেসে মাথা হেলিয়েছে সে। তবে আসেনি। শম্পারা তো মেয়ে ববিকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছে। শম্পা বিধান কখনো কোনো জোর খাটায়নি ববির ওপর। এ ঘটনা কি তবে তারই বিপরীত ফল? আর ভাবতে পারছে না শম্পা। খুব ঘনিষ্ঠ কেউ কেউ এসেছিলো বাড়ীতে। পারেনি শম্পারা তাদের সাথে একটিও বাক্য বিনিময় করতে। একবারও পারেনি যে পাশের বাড়ীতে একবার যায়, সমবেদনা জানাতে। ইচ্ছেই হয়নি। কী এক অব্যক্ত প্রবল আক্রোশ। বিধানের দৃষ্টিতে শম্পা নিজেকে অপরাধী ভাবছে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? বিধানের কি কোনো দায় ছিলো না বাবা হিসেবে? শম্পা জানে না। কোনো হিসেব মিলছে না। কোথা থেকে কি হয়ে গেলো! একটানে শম্পা বিধানের ছোট্ট দুনিয়াটা কি বেআব্রু হয়ে গেলো এমন নিষ্ঠুরভাবে?
এখন শম্পা বিধানের বাড়ীটা শহরের দ্রষ্টব্য। অথচ পাশের বাড়ীটা? থাক সেকথা। শম্পা কাউকেই কোনো দোষারোপ করবে না। শম্পা এইটুকু বুঝেছে নিজের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার বিনিময়ে, যে মা হওয়ার থেকে সন্তানের বন্ধু হওয়াটা অনেক বেশি জরুরি। এখন আর কী হবে নিজেকে গৃহবন্দী করে? টের পাওয়াটা উচিৎ ছিলো শম্পার। তা না সব ঠিক আছে, এই ভেবেই চূড়ান্ত আত্মতৃপ্তিতে ভুগেছে। তার ফলও পেয়েছে হাতেনাতে। শম্পার একুশ বছরের মেয়ে আত্মহত্যা করে শহরে খবরের শিরোনামে। শুধু এটুকুই নয়, পাশের বাড়ীর বছর চব্বিশের সেই এলোমেলো অগোছালো তরুণও তার সাথে একসাথে আত্মঘাতী। নাহ্, এখানেই শেষ নয়। তাদের সম্পর্ক নিয়ে যতটা না শহরবাসী মুখর, তার থেকে বেশি মারমুখী। কারণ ঐ দুই তরুণ তরুণীর এইচআইভি পজিটিভ... পোস্টমর্টেম রিপোর্ট থেকেই শুধু জানাজানি... তবে তারও আগে থেকেই ববি ও জয়, ওরা নিজেরা কিন্তু জানতো। প্রমাণ জমা ছিলো আখরোট কাঠের বাক্সে। তাই একসাথে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত দুই মাদকাসক্ত তরুণ তরুণীর। কী ভয়ঙ্কর পরিণতি! তাদের চিঠি চালাচালি আর কথাবার্তা খেয়াল করলেই হয়তোবা এমন নির্মম করুণ পরিণতি হতো না। কিন্তু অভিভাবকরা যে বড্ড বেশী রকমের অভিভাবক... সহমর্মী বন্ধুসুলভ কম।
শম্পা বিধানের সংসারের ফাঁকফোঁকরগুলো ভীষণ দৃষ্টিকটুভাবে দৃশ্যমান। শতচ্ছিন্ন তাঁবুর ভেতরে রোদ বৃষ্টি ঢুকে পড়ার মতো। সংসারের কর্তা কর্ত্রী যতই ভালো করে ঢেকেঢুকে ঘর সাজানোর চেষ্টা করুক না কেন, ভেতরের কঙ্কালের মতো সংসারের খাঁচাটা এখন দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বাড়ীর মালিকের অদূরদর্শিতা দেখিয়ে দিয়েছে চোখে আঙুল দিয়ে। শম্পা বিধানের অভিভাবকত্ব আর আঁটোসাঁটো সংসার এখন এক বিরাট প্রশ্নচিহ্নের মুখে। আর অপূরণীয় ক্ষয় ক্ষতির হিসাব নিকাশের কথা নাহয় চাপাই থাক আপাতত।