আততায়ী কে?(দ্বিতীয় পর্ব)
আততায়ী কে?(দ্বিতীয় পর্ব)
সুহাস এতক্ষণ একমনে মিঃ.দস্তিদারের কথা শুনছিল। এবার সে জিজ্ঞাসা করলো, "আচ্ছা, পুলিশ তো তদন্ত করছে। বিষ্ণুপদবাবুর মৃত্যু সম্পর্কে তাদের কি ধারণা?"
"পুলিশ বলছে চিড়িয়াখানাতেই বিষ্ণুপদর কোন শত্রু ছিল আর সেই খাঁচার চাবি চুরি করে ডুপ্লিকেট বানিয়ে খাঁচার দরজা খুলে দিয়েছিল। কিন্তু যদি তাই হয়, তবে জ্যাক যে খাঁচা খুলল তাকে আক্রমণ না করে বিষ্ণুপদকে আক্রমণ করলো কেন?"
"হুঁম....অবশ্য পুলিশের থিওরিটা খুব একটা ভুল নয়। এই ব্যাপারে যদি অন্য লোক জড়িত না থাকে তাহলে বিষ্ণুপদবাবুর বডিটা খাঁচার বাইরে এলো কি করে? আর যদি ধরেও নিই যে বিষ্ণুপদবাবু নিজেই জ্যাকের খাঁচা খুলেছিলেন তাহলে.....আচ্ছা, মিঃ.দস্তিদার আপনার কি মনে হয়? বিষ্ণুপদবাবুর সত্যিই কোন শত্রু ছিল?"
সজোরে দুপাশে মাথা নাড়লেন রুদ্রনারায়ণ দস্তিদার। বললেন, "বিষ্ণুপদর কোন শত্রু ছিল একথা আমি বিশ্বাস করতে পারি না মিস.সেন। ওরকম নিপাট ভালোমানুষ লোকের কখনো শত্রু থাকতে পারে না। কিন্তু তাও ঘটনাটা ঘটেছে। তাই অবিশ্বাসও করতে পারছি না।"
"আচ্ছা খাঁচার চাবির ডুপ্লিকেট নিশ্চয়ই আপনার কাছেও আছে?"
"হ্যাঁ।"
"সেটা কোথায় থাকে?"
"আমার ঘরে একটা ক্যাবিনেটের মধ্যে থাকে। আজ সকালেও এখানে আসার সময় ওটা ক্যাবিনেটেই ছিল।"
"আর বিষ্ণুপদবাবুর চাবিটা?"
"মৃত্যুর সময়ে বিষ্ণুপদর গায়ে একটা সবুজ রঙের টি-শার্ট আর কালো প্যান্ট ছিল। শার্টের পকেট থেকে জ্যাকের খাঁচার চাবিটা পাওয়া যায়। তবে অন্য কর্মচারীরা বলছে গতকাল রাত দেড়টা নাগাদ তারা একবার জ্যাকের গর্জন শুনেছিল। আমারও শুনতে পাওয়া উচিত ছিল কিন্তু আমার ঘুম বড়ো গভীর। একবার ঘুমিয়ে পড়লে আর কোন শব্দই আমার ঘুম ভাঙাতে পারে না।"
সুহাস কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে কি যেন ভাবলো। তারপর বলল, "আমি আপনাকে আরো কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।"
"বলুন?"
"আপনি আজ থেকে সাত বছর আগে চিড়িয়াখানাটা তৈরি করেছিলেন। বিষ্ণুপদবাবু কি একদম প্রথম থেকেই ওখানে কাজ করছিলেন?"
"হ্যাঁ, আমি কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম যে একটা আফ্রিকান সিংহর দেখাশোনার জন্য লোক চাই। সেটা দেখেই বিষ্ণুপদ এসেছিল।"
"আর অন্য কর্মচারীরা?"
"তাদের জন্য ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা করেছিলাম। আসলে জ্যাকের জন্য আমি একজন স্পেশালাইজড্ লোক খুঁজছিলাম।"
"বিষ্ণুপদবাবু আগে কোথায় কাজ করতেন?"
"বিভিন্ন সার্কাস কোম্পানির বাঘ-সিংহের দেখাশোনা করতো।"
"আচ্ছা, জ্যাক কি আগে কখনো বিষ্ণুপদবাবুকে আঘাত করেছিল?"
"কোনদিন করেনি। শুনতে আশ্চর্য লাগবে ঠিকই, কিন্তু দুজনের মধ্যে একটা বন্ধুত্ব ছিল। আমি তো ভাবতেই পারছি না জ্যাক...... "
বিষ্ণুপদবাবুর বাড়ি কোথায়?"
"মালদায়। বিষ্ণুপদ ব্যাচেলর ছিল। একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতো।"
"আর ওনার মা-বাবা?"
"তাঁরা অনেকদিন আগেই মারা গেছেন।"
"আপনার সঙ্গে বিষ্ণুপদবাবুর শেষ কখন দেখা হয়েছিল?"
"চিড়িয়াখানার পেছন দিকে একটা কমন ডাইনিং রুম আছে। ওখানেই রাত দশটা নাগাদ আমার সঙ্গে বিষ্ণুপদর শেষ দেখা হয়।"
"ওনার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করেছিলেন?"
"না, তেমন কিছু তো....তবে আমার মনের ভুল কি না জানি না, কিন্তু ওকে দেখে একটু নার্ভাস বলে মনে হচ্ছিল।"
"বিষ্ণুপদবাবুর সঙ্গে কোন লোক দেখা করতে আসতো না?"
"আসতো একজন। নামটা জানিনা কিন্তু বিষ্ণুপদ বলেছিল লোকটা ওর বন্ধু হয়।"
"শেষ কবে এসেছিল সেই লোক?",
সুহাস ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো।
"মাসখানেক আগে হবে।"
"সেই লোকটাকে কেমন দেখতে বলতে পারেন?"
"কেমন দেখতে?", মিঃ.দস্তিদার কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, "একটু পাগলাটে চেহারা লোকটার। মানে মুখ ভর্তি দাড়ি-গোঁফ ছিল। আর কাঁধ অবধি নেমে আসা বড়ো বড়ো চুল। তবে লোকটা যখনই আসতো, ঘন্টাখানেকের বেশি থাকতো না।"
"হুঁম।"
সুহাস কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে কি যেন ভাবলো। তারপর বলল, "দেখুন মিঃ.দস্তিদার, এখানে বসে আমি কিছুই করতে পারবো না। আপনার চিড়িয়াখানায় আমাকে একবার যেতেই হবে। কবে গেলে আপনার সুবিধা হবে বলুন?"
"আজই চলুন না। আমার সঙ্গে গাড়ি আছে। এখন তো একটা বেজে গেছে। ওখানে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধে হয়ে যাবে। আজ রাতটা বরং আপনি আমাদের বাড়িতেই থাকবেন। চিন্তা নেই, আপনার কোন অসুবিধা হবে না।"
"বেশ। আমাকে একটু সময় দিন। আমি তৈরি হয়ে নিই।"
আধঘন্টার মধ্যে সুহাস রেডি হয়ে গেল। সে প্রভাকেও তার সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু প্রভা জানালো অফিসের কিছু জরুরি কাজ সারার জন্য তাকে বাড়িতেই থাকতে হবে। সুহাস যখন রুদ্রনারায়ণ দস্তিদারের সঙ্গে সিউরির উদ্দেশ্য বেরোল তখন দুপুর দেড়টা।
সিউরি পৌঁছতে সাড়ে চারটে বাজলো। রাস্তার একপাশে একটা বড়ো মাঠে একটা সার্কাসের লাল-সাদা রঙের বিরাট তাঁবু দেখা গেল। তাঁবুর দড়িতে লাগানো ছোট ছোট বিভিন্ন রঙের তিন-কোনা পতাকাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মিঃ.দস্তিদার বললেন, "ডায়মণ্ড সার্কাস। আরো অনেক জায়গায় শো করে তিনদিন আগে এখানে এসেছে। আরো সাতদিন থাকবে।"
যে মাঠে সার্কাসের তাঁবু পড়েছে, সেখান থেকে মিঃ.দস্তিদারের বাড়ি আধঘন্টার রাস্তা। রুদ্রনারায়ণ দস্তিদারের গাড়ি যখন তাদের প্রাসাদের মতো বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল, তখন সূর্য ডুবে গেছে। ড্রাইভারকে গাড়ি গ্যারেজ করতে বলার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ভেতর থেকে একজন বয়স্ক লোক বেরিয়ে এলো। তার পরনে একটা সাদা ধুতি আর লাল রঙের সোয়েটার। দেখলেই বোঝা যায় সে এবাড়িতে কাজ করে।
তাকে দেখে মিঃ.দস্তিদার বললেন, "কিছু বলবি?"
"এজ্ঞে, গিন্নিমা আপনাকে ডাকতেছেন। থানা থেকে দারোগাবাবু এয়েচেন।"
"ও ইন্সপেক্টর মণ্ডল এসেছেন? তুই যা, আমি যাচ্ছি।"
এবার মিঃ.দস্তিদার সুহাসকে বললেন, "ইন্সপেক্টর নির্মল মণ্ডল এই কেসটা ইনভেস্টিগেট করছেন। চলুন আপনার সাথে আলাপ করিয়ে দিই।"
"হ্যাঁ, ওনার সাথে কথা কথা বলা দরকার।"
(ক্রমশ)
