আশার আলো
আশার আলো


-----জানিস তিতির জীবনটা শুধু সংসারের চার দেওয়ালের মধ্যেই কেটে গেল।
-----সেটা আবার কি মা? ছোট্ট তিতিরের কৌতুহলী প্রশ্ন।
----- কিছু না রে সোনাই। এমনি বললাম।ও তুই বুঝবি না। চল্ তোকে খাইয়ে দিই।
------না মা বলো আমাকে।
ছোট্ট তিতিরকে খাওয়াতে খাওয়াতে মা ওকে বললো,
-----কিছু না রে, এই ঘরের কাজ ছাড়া আর তো কিছুই করি না। সেটাই বলছি আর কি।
------কেন মা তুমি তো কতো কিছু করো। রান্না করা,ঘর গোছানো, কাপড় কাচা, ঠামি -দাদুনকে দেখা, আমাকে পড়াতে বসানো, স্কুলে পৌঁছে দেওয়া , আরও কত কি। তাও বলছো তুমি কিছুই করো না।
মনমরা রত্না মনে মনে বললো,"ওই করার কি দাম আছে কোনো। কেউ জিজ্ঞেস করে যদি কি করি ,তখন বলতে হয়, কিছু না ঘরেই থাকি। এখনকার ভাষায় হোম মেকার। না কোনো ছুটি,না কোনো মাইনে,না কোনো বোনাস। বিনিময়ে খাওয়া, পরা, ঘোরা, সাজগোজ করা এইসব আর কি? অসুস্থ হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুখ ভার সকলের। কেউ দেখবে না তুমি কি করেছো এতদিন। খুব সৌভাগ্যবতী হলে অবশ্য সেবা শুশ্রূষা জোটে কারুর কারুর। রত্নার ক্ষেত্রে অবশ্য সেরকম কিছু হয় না। অসুস্থ হলেও করতে হয় ওকে। অথচ যখন তিতিরের বাবার জ্বর হয়, তখন সারাদিন কি সেবা টাই না করে রত্না।টাইমে টাইমে ওষুধ দেওয়া, জ্বরের মুখে ভালো লাগবে বলে গরম গরম চিকেন স্টু্। আর ওর যখন জ্বর হয় শুয়ে থাকে, তখন কত ইচ্ছা করে ওর ও গরম চিকেন স্টু্ খেতে। ঠিক বিয়ের আগে যেরকম মা বানিয়ে খাওয়াতো ওকে। কিন্তু মনের ইচ্ছা মনেই থেকে যায়।কে আর নিজের জন্য ওঠে এই জ্বর গায়ে।তার থেকে বরং থাক।
রত্নার মনে আছে, স্কুলে ছোটবেলায় টিচার যখন জিজ্ঞেস করতেন,কি হতে চাও তোমরা? সবাই একে একে উঠে দাঁড়িয়ে,কেউ বলতো ডাক্তার হবে,কেউ বলতো ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বলতো টিচার। এখন রত্না ভাবে, হ্যাঁ সে সব ই হয়েছে বটে সে এই সংসারে এসে। কেউ অসুস্থ হলে ডাক্তার, মেয়ের স্কুলের প্রোজেক্ট বানাতে ইঞ্জিনিয়ার, সেবা করতে নার্স, মেয়ের টিচার সব । এছাড়াও ভালো কুক। আরও অনেক তকমা আছে সাংসারিক ক্ষেত্রে,সেসব আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু নিজের জন্য কি করলো রত্না সেটা আজও বুঝতে পারল না ও।
সেদিন সন্ধ্যে বেলা তিতিরকে হোম ওয়ার্ক করাচ্ছে রত্না। হঠাৎই তিতির মা'কে বললো,"মা জান
ো স্কুলে আজ মিস্ বলছিলো, তোমার যেটা ভালো লাগে তুমি সেটাই করো মন দিয়ে। তাহলেই তুমি লাইফে এগিয়ে যেতে পারবে।"
রত্না তিতিরকে বকা দিয়ে বললো,"পড়াশোনা করতে করতে তুমি বড্ডো বেশি কথা বলো তিতির।"
মায়ের কথায় ছোট্ট তিতির তখনকার মতো চুপ করে গেল। রত্না বসে আছে, তিতির হোম ওয়ার্ক করছে। হঠাৎই রত্নার মনে হলো , তিতির একটু আগে যেন কি একটা বললো। ওর মিস্ বলেছে , তোমার নিজের যেটা ভালো লাগবে, সেটাই তুমি করো। তাহলেই তুমি এগোতে পারবে নিজের লাইফে। রত্নার হঠাৎই মনে পড়ে গেল, বিয়ের আগে ও জুয়েলারি মেকিং,আর সফ্ট টয়েজ মেকিংয়ের একটা কোর্স করেছিলো। তার জন্য প্রয়োজনীয় সব উপকরণ ওর মা ওকে কিনে দিয়েছিল। বিয়ের পরও এখানে এসে বানাবে বলে ,সেসব সঙ্গে করে নিয়েও এসেছিল। কিন্তু ওই যা হয় আর কি। সংসারের চাপে নিজের সেই শখ প্যাকেট বন্দী হয়ে আলমারির এক কোণে পড়ে আছে সাত বছর ধরে।
মনে পড়তেই রত্না তাড়াতাড়ি নেমে আলমারির কাছে গিয়ে খুঁজে বের করে আনলো সেই প্যাকেট। আর তারপর নিজের মনে বানাতে শুরু করলো । অনেক দিন প্রাকটিস ছিল না। প্রথমটা একটু অসুবিধা হচ্ছিলো ওর। কিন্তু একটু চেষ্টা করতেই ও সুন্দর একটা কানের দুল আর তিতিরের জন্য একটা টেডি বানিয়ে ফেলল। ছোট্ট তিতির এতক্ষণ অবাক চোখে দেখে যাচ্ছিল মায়ের এই অদম্য প্রচেষ্টা। কিন্তু মায়ের বানানো কানের দুল আ্য টেডি দেখে ও এতো খুশি হলো যে, জড়িয়ে ধরে মাকে বললো,"মা তোমার কি এটা করতেই ভালো লাগে?ঠিক মিস্ যেরকম বলেছিল,যার যেটা ভালো লাগে সে সেটাই করলে তার ভালো হবে।"
তিতিরের কথায় রত্না তিতির কে জড়িয়ে ধরে বললো,"তিতির তুই নিজেও জানিস না আজ তুই একটা ছোট্ট কথা বলে,তোর মা'কে তুই কতটা এগিয়ে দিলি তার জীবনে চলার পথে। সংসারের চার দেওয়ালে বন্দী তোর মা আজ তোর একটা ছোট্ট কথায় নতুন করে বাঁচার রসদ পেল তার জীবনে।তোর মা'কে তুই আশার আলো দেখিয়ে দিয়েছিস তোর এই ছোট্ট, অবুঝ মন থেকে আসা কথা দিয়ে।
রত্না র জীবনে তিতির তার ছোট্ট একটি কথার মাধ্যমে স্বাবলম্বী হবার যে আশার আলো জ্বেলে দিয়েছিল, সেই আশার আলো প্রত্যেক মায়ের জীবনে জ্বলে উঠুক ,যারা সংসারের মধ্যে থেকেও নিজের জন্য কিছু করতে চায়, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। সর্বোপরি নিজের একটা আলাদা পরিচয় তৈরি করতে চায়।