Partha Pratim Guha Neogy

Romance Fantasy Others

3  

Partha Pratim Guha Neogy

Romance Fantasy Others

আধুনিক প্রেমিকা

আধুনিক প্রেমিকা

6 mins
250


“দেখো শুভ তুমি জানো যে আমি এই সব অভ্যেস পছন্দ করি না, তবুও তুমি বারংবার একই আচরণ করছ আমার সাথে।“ এই বলে দিশা তার শরীর থেকে শুভর হাত সরাতে উদ্যত হয়। এতে শুভ অনেক রেগে যায়- “তাহলে আমাকে ভালোবাসছো কেন? একটু-আধটু মজা তো করাই যায়। আমাদের সম্পর্কে আসার এক বছর হতে চলল, কিন্তু তুমি এখন পর্যন্ত আমাকে তোমার হাত ছাড়া কোনো কিছুই স্পর্শ করতে দাও নি। এমনকি একটা চুমু দিতে গেলেও তুমি বাঁধা দিয়েছো। তুমি কি আমাকে সত্যি ভালোবাসো, নাকি তুমি শুধু সময় কাটাচ্ছ আমার সাথে।“


দিশা - “আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি…” দিশাকে থামিয়ে দিয়ে শুভ বলে- “তাহলে এত বাঁধা কিসের জন্য।“


এবার দিশা অনেক রেগে যায়- “আমি তোমাকে ভালোবাসি মানে এই নয় যে, তুমি আমার সাথে যা ইচ্ছে তাই করবে। এর মানে এই নয় যে, ইচ্ছে হলেই তুমি তোমার চাহিদা মেটাবে। মন থেকে ভালোবাসা হয় শুভ। শরীর থেকে নয়। শরীর তো শুধু একটা বিলাসিতা মাত্র।“

শুভ - “ও আচ্ছা, তার মানে তুমি তোমাকে টাচও করতে দিবে না, উঁহু তুমি আমাকে একদম ভালোবাসো না।“ এই বলে শুভ পার্কের বেঞ্চ থেকে উঠে যায়। দিশা তার হাত ধরে, কিন্তু শুভ হাত ছাড়িয়ে গনগন করে সেখান থেকে চলে যায়।

দিশা তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। অন্যদিকে শুভ, এক বেসরকারি কোম্পানির ম্যানেজার। তাদের প্রথম দেখা হয় সিটি সেন্টারে। প্রথম দিকে দিশা শুভকে কোনো পাত্তা না দিলেও, অবশেষে শুভর কাছে হার মানে দিশা । প্রথম প্রেমের দিন দেখা করেছিল এই পার্কেই। আর তাই এই পার্কটিই দিশার পছন্দের। দিশা চায় ছেলে শান্ত এবং নম্র স্বভাবের হবে, আর রোজগারও মোটামুটি ভালই থাকবে। আর এই সব গুন সে খুঁজে পেয়েছিল শুভর মধ্যে।


কিন্তু যতই দিন যায়, ততই শুভর আসল রূপ সামনে আসতে থাকে। রাস্তায় মেয়ে চলতে দেখলে তাদের নিয়ে খারাপ মন্তব্য করা, কথা বলার মাঝে মাঝে খারাপ শব্দের প্রয়োগ করা, বন্ধুদের সাথে দিশাকে ব্যাকডেটেড বলে মজা করা ইত্যাদি নানান অবাঞ্ছিত কথা চলে আসত। কিন্তু দিশা ধীরে ধীরে এগুলি সহ্য করতে শিখে গেছে। আর এর কারণ হল একটাই, সে যে শুভকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছে। যদিও প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল সেদিনের শুভ, আর বর্তমানের শুভর মধ্যে রয়েছে এক বিস্তর ফারাক।

হঠাৎ কার ডাকে যেন দিশার দিবা-স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। সে তার চোখের ভারী চশমার লেন্সটা খুলে, চোখের জল মুছে, মাথা উঠিয়ে দেখল শুভ দাঁড়িয়ে আছে আর সঙ্গে এক ঢ্যাড়স মার্কা পশ্চিমী স্টাইলের ছোট ড্রেস পড়া মেয়ে। দিশা কিছু বলার আগেই শুভ বলল- “একে দেখ, একে দেখে কিছু শেখার চেষ্টা কর। আধুনিক কাকে বলে জানো? এই একেই বলে আধুনিক ।


এরকম ভাবে ড্রেস-আপ করতে হয়। কিন্তু তা না করে তুমি এখনও সেই হাল আমলের ড্রেস পড়েই ঘুরছো। আধুনিক হতে শেখো। তোমার চুল থেকে দুটাকার ডাভ শ্যাম্পুর গন্ধ ভেসে আসে, আর এর চুল থেকে সবসময় ৫০০ টাঁকা দামের শ্যাম্পুর গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। তোমার চোখ তো আবার ডবল ব্যাটারি যুক্ত। তোমার ভাগ্য খুবই ভালো যে, একটা বছর আমার মত ছেলের সাথে কাটিয়েছো। বাড়ি গিয়ে আগে আয়নায় নিজের মুখটা দেখো। উউউউ এসেছে প্রেম করতে!!  


আর রইল তোমাকে স্পর্শ না করার কথা, এই যে এদিকে দেখ-“বলেই শুভ সেই মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে। দিশা লজ্জায় এবং অভিমানে অন্যত্র দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়। “আজ থেকে তুমি তোমার শরীর বাঁচিয়ে তোমার রাস্তায় চলবে, আর আমি আমার রাস্তায়।“ এই বলে শুভ সেই মেয়েটার কাঁধে হাত রেখে সেখান থেকে চলে যায়।


দিশার অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, তার চোখ থেকে জলের পরিবর্তে নিজের প্রতি রাগের স্ফুলিঙ্গ বেড়িয়ে আসছে।


দিশা বাড়ি ফিরে তার রুমে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দেয়। সে তার ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে আয়নায় তার মুখ দেখতে থাকে- সত্যি কি সে এতটাই খারাপ, সে কি একদম মডার্ন নয়, সে কি এখনও সেই পুরানো আমলে পড়ে রয়েছে!


কিভাবে সে নিজেকে উন্নীত করবে, যাতে একজন ছেলে দেখেই তাকে আধুনিক মেয়ে ভাবে! চোখ থেকে জল এসে ঘরের মেঝেতে পড়ে জমা হয়, আর এদিকে দিশার শুভকে নিয়ে দেখা স্বপ্ন গুলি একে একে আকাশে খণ্ড খণ্ড হয়ে উড়ে যায়। -“সত্যি তো, আমি একদম আধুনিক নই , কপালে সেই ছোট কালো টিপ, চোখে কাজল আর পড়নের এই ড্রেস সবই ব্যাক-ডেটেড। কিন্তু ঐ মেয়েটা, কপালে টিপ নেই, ইয়া লম্বা কানের দুল, নাকে ঝুলছে একটা আংটির মত নাকছাবি। ছেঁড়া-ফাটা ড্রেস। ও আধুনিক হয় কি ভাবে।“


এরপর কেটে যায় একটা মাস। কলেজে যাওয়ার সময় এখনও তাদের দেখা করার জায়গাতে এসে নিজের অজান্তেই পা থেমে যায় দিশার। তার নিষ্পাপ চোখ যেন, কাউকে খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু দূরের ওই দেওয়ালে দৃষ্টি পৌঁছে আবার পুনরায় ফিরে আসে, চোখ যেন কাউকে খুঁজছে, মন যেন কাউকে খুবই মিস করছে।


দিশা বিকেলে তার পোষা কুকুরকে নিয়ে সেই পার্কে যায় এবং তাদের শেষ দেখা হওয়ার জায়গায় থমকে দাঁড়ায় “তুমি এখনও আমাকে ভালোবাসো তাই না?” হঠাৎ যেন কার চেনা গলা, মনটা নিজে থেকেই শান্ত হয়ে গেল। পিছন ফিরে দিশা দেখে শুভ দাঁড়িয়ে। “ও হো আপনি?”


শুভ- “প্লিজ আমায় তুমি আপনি করে বল না, আমি তোমাকে অনেক মিস করেছি।“


দিশা -“ও মা তাই, তা আপনার না আধুনিক মেয়ে পছন্দ। কোথায় আপনার সেই আধুনিক মহীয়সী?”


শুভ - “ভালো আছো তো?”


দিশা - “হ্যাঁ একদম ভালো আছি। আপনার কথা মোতাবেক শরীর বাঁচিয়েই চলছি আজকাল।”


শুভ - “আমি আজকেই জেল থেকে ছাড়া পেয়েছি”


তৃষা-“জেল থেকে কেন? কি চুরি করেছিলেন?”


শুভ - “ সম্মান, সম্মান চুরি করেছি আমি। আমি সেই মেয়েকে আধুনিক ভেবেছিলাম। কিন্তু কে জানত, সেই আধুনিকতার আড়ালে লুকিয়ে ছিল, এক কালো সভ্যতা। আমি তার সঙ্গে কয়েকবার দৈহিক সম্পর্কেও লিপ্ত হই, কিন্তু কে জানত, আমাদের ভিডিও রেকর্ড হচ্ছিল, পাশ থেকে। এরপর আমাকে ব্ল্যাকমেল করা হয়। আমার কাছে জমানো যা ছিল, সবই আমি দিয়ে দিয়েছি, এমনকি আমার সেই প্রিয় বাইকটিও বিক্রি করে, তাদের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করেছি। পড়ে অনেকবার টাকা চাইলেও আমি টাকা দিই নি, কারণ আমার কাছে দেবার মত কিছুই বাকি ছিল না।


এরপর আমি থানাতে বিষয়টি জানানোর সিদ্ধান্ত নিই, কিন্তু আমার আগেই তারা থানাতে জানিয়ে দেয়। এরপর পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করে এবং পক্সো আইনে জেলে পুড়ে দেয়, আজ দুইদিনের জন্য ছাড়া পেয়েছি। ভাবলাম তোমার সঙ্গে দেখা করাটা জরুরী। তোমাকে এই জায়গাতেই পাওয়া যাবে ভেবে, এখানেই চলে এলাম। আমি আবার তোমার সঙ্গে সময় কাঁটাতে চাই“


দিশা - “একটু আগে যে কথাগুলি বললে সেই কথাগুলি শোনার আগে পর্যন্ত তোমার জন্য আমার মনে যেটুকু জায়গা ছিল সেটিও ওই নর্দমার কালো জলে বিসর্জন দিয়ে দিয়েছি। তুমি একজন অপরাধী। কি বলছ, আমার সঙ্গে আবার সময় কাঁটাতে চাও? আমিও সেটাই চেয়েছিলাম একসময়। আমি চাইতাম, ওই গঙ্গার ধারে বসে তুমি আমি গল্প করব, সুখ-দুঃখের কথা বলব। পাশাপাশি বসে ফুচকা খাবো। ভেজা রাস্তায় হাত ধরে হাঁটবো, বৃষ্টিতে ভিজব, তুমি আমাকে গল্প শোনাবে আর আমি মুগ্ধ হয়ে তোমার কথা শুনব।


কিন্তু তুমি কক্ষনোই আমার এই সব ইচ্ছের কথা জানতে চাওনি। তুমি সবসময় আমাকে স্পর্শ করতে চেয়েছো। শুধুমাত্র হাত ধরে থাকতেই তোমার সমস্যা। তুমি শরীর চাও। মন নয়। যাকে হৃদয় থেকে ভালবাসো তার কাছে শরীর নয়, মনটাই হল মৌলিক উপাদান। শরীর দিয়ে কখনো ভালোবাসা হয়না। মনের সাথে মনের যখন মিল ঘটলে তখনই ভালোবাসা হয়। কিন্তু আমার ভাগ্য এতটাই খারাপ যে, যাকে বিশ্বাস করেছিলাম সেও আমার শরীর চাইছে।“


“ভুলু এদিকে আয়” তৃষা তার কুকুরকে ডাক দেয়। “এই যে একে দেখছো, জানো ও কতটা বিশ্বাসী। আমি ওকে কত্ত বকা দিই, কিন্তু বেচারা দেখো আমার এক ডাকেই চলে এলো। আর এর কারণ কি জানো? বিশ্বাস। ও জানে যে আমি ওকে বকা দিলেও আমি ওকে আদর করবই। ও যখন আমার কাছে থাকে, কোনো বদমেজাজি ছেলে আমার দিকে তাকাতেও সাহস পায় না। এটা হল ভরসা। আমি তোমাকে ভরসা করেছিলাম কিন্তু তুমি সেটার মূল্য দিতে পারোনি। পরিবর্তে সারাক্ষণ তোমার বন্ধুদের সাথে আমাকে নিয়ে মজা করেছ। এমনকি সেদিন তোমার ওই তথাকথিত আধুনিক মেয়েটার কাছেও আমাকে নিয়ে মজা করতে ছাড়লে না। জানো তো শুভ একসময় চেয়েছিলাম আমিও আধুনিক হব। কিন্তু পরক্ষনেই আবার মনে হল, না আমি এই সাধাসিধেই ভালো আছি।“


 “চল ভুলু ” এই বলে দিশা চলতে থাকে আর তার পিছনে ভুলু কু কু আওয়াজ তুলে যেতে লাগল। ভুলু যেতে যেতে একটা সাইকেল দেখতে পেয়ে সাইকেলের টায়ারে হিসু করে দিল, আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, এই সাইকেলটা শুভর। যেন সেও বলতে চাইছে- “নে শরীর লোভী প্রেমিক, এই জলে স্নান করে শুদ্ধ হও।”    

আসলে যে যেরকম সে সেইভাবেই সুন্দর। আমাদের তো প্রবাদই আছে - বন্যরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।

অর্থাৎ স্বাভাবিক সৌন্দর্যই সবচেয়ে সুন্দর। তাই সুন্দরী হবার জন্য আধুনিক হবার প্রয়োজন নেই।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance